দিনশেষে যখন ক্লান্ত এক হৃদয় হাতরে ফেরে নতুন এক প্রেরণা তখন সাকিব আল হাসান হয়ত ভেসে ওঠেন লক্ষ কিশোরের চোখের সামনে। বিশ্ব ক্রিকেটে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে যে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন তিনি নিশ্চয়ই সাকিব। বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের ভিনদেশীদের সমীহ আদায় করার শুরুটাও তো এই সাকিবের হাত ধরেই হয়েছিল। এমন অলরাউন্ডারকে পাওয়ার সৌভাগ্য ক’জনের কপালে জোটে?
গর্ব করার মত সাকিব তো আর সব দেশে থাকে না। একাধারে তিন ফরম্যাটের র্যাংকিংয়ের শীর্ষস্থান নিজের দখলে তো সবাই রাখতে পারেনা। সেটা তো কেবল এক ও অনন্য সাকিব পারেন। তিনিই করে দেখিয়েছেন। আমাদের কতই স্বাদ তিনি চিরকাল অমর হয়ে রইবেন ক্রিকেটের ইতিহাসে। বড় বড় মহারথী যারা ছিলেন ক্রিকেটের নিবেদিত প্রাণ তাঁদের সাথে উচ্চারিত হবে আমাদের সাকিব আল হাসানের নাম।
আমরা চাই স্যার গ্যারি সোবার্স, ইয়ান বোথামদের সাথে আমাদের সাকিবের নামটাও যুক্ত হয়ে থাকুক টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে। তবে সে জন্যে অবশ্য টেস্ট খেলা চাই। কিন্তু তা আর হচ্ছে কই? বিগত বছর খানেকের যদি একটা ফিরিস্তি টানা যায় তবে দেখা যাবে যে সাকিব ২০২১ সাল থেকে এখন অবধি মাত্র একটি পূর্ণাঙ্গ টেস্ট সিরিজ খেলেছেন।
সেটাকেও আবার অবশ্য সিরিজ বলা চলে না। মাত্র একটি ম্যাচ খেলেছেন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। এ ছাড়া ২০২১ থেকে এখব অবধি যদি হিসেব করা যায় তবে তিনি পাঁচটি পূর্ণাঙ্গ টেস্ট সিরিজে ছিলেন অনুপস্থিত। তবে এর অধিকাংশ টেস্ট সিরিজেই তিনি অনুপস্থিত ছিলেন ব্যক্তিগত নানা কারণে। বাংলাদেশ দলকে একটা লম্বা সময় ধরে সার্ভিস দিয়ে আসছেন সাকিব।
তবে হঠাৎই ঘটে ছন্দপতন। জুয়ারির দেওয়ার প্রস্তাব তিনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তবে সে প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানাননি সাকিব। ব্যাস, অশ্রুসিক্ত নয়ন নিয়ে তিনি চলে গিয়েছিলেন বছর খানেকে নির্বাসনে। এরপর ফিরেই ২০১৯ বিশ্বকাপটা নিজের জন্য, আমাদের জন্যে স্মরণীয় করে রাখলেন। ব্যাটে বলে একাই লড়াই চালিয়ে গেছেন ইংল্যান্ডের মাটিতে। সেবার পুরো বিশ্ব আবারও মুগ্ধ দৃষ্টিতে বাংলার দামাল ছেলেটির খেলা দেখেছিল।
কিন্তু ওই যে ছন্দপতন একটা হয়েছিল ঠিকই। তা যেন ক্রমশ আরও স্পষ্ট হচ্ছে। সাকিবের অনীহা বেড়েছে টেস্ট ক্রিকেটে। লম্বা ফরম্যাটে এই খেলাটা এখন বোধকরি সাকিবকে আর খুব একটা টানে না। কখনো পারিবারিক কারণ তো কখনো মানসিক অবসাদ আবার কখনো ইনজুরি, মাঝেসাঝে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল)। নানান কারণে সাকিব থাকছেন টেস্ট ক্রিকেট থেকে দূরে।
এমন করতে গিয়ে অন্ততপক্ষে দশটি টেস্ট খেলেননি সাকিব। ওই যে শুধু জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এক টেস্ট আর পাকিস্তানের বিপক্ষে ২০২১ এর শেষের দিকের এক টেস্ট ছাড়া সাকিবকে আর দেখা যায়নি সাদা পোশাকে। তিনি যেন লাল বলটা আর ধরতেই চাইছেন না কিংবা পর্দার আড়াল থেকে তাঁর ভাগ্যও চাইছে না তিনি টেস্ট ক্রিকেটকে সময় দিক।
এই যে যেমন দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের আগে কতই না জল ঘোলা হল। সাকিবকে নিয়ে বিসিবির উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বৈঠক শেষে ফলাফল জানা গেল সাকিব যাবেন দক্ষিণ আফ্রিকায়। খেলবেন পূর্ণাঙ্গ সিরিজ। তবে বিধিবাম। নিয়তি যেন তাঁকে সাদা পোশাকের ‘এলিট অলরাউন্ডার’ হতে দিতেই নারাজ। সাকিবের পরিবারের উপর নেমে এল অসুস্থতার কাল ছায়া। পরিবারের সবাইকে অসুস্থ অবস্থায় রেখে আর যাই হোক ক্রিকেট খেলাটা যায় না। সেটা বড় অমানবিক এক কাজ।
এমন করেই টেস্ট ক্রিকেটে কম করে হলেও হাজার খানেক রান থেকে পিছিয়ে রইলেন সাকিব। হয়ত তিনি আরও দু-তিন খানা সেঞ্চুরির দেখা পেয়ে যেতে পারতেন। আরও একটি দ্বিশতক বোধহয় অসম্ভব কিছু হত না। সেই সাথে পঁচিশ-ত্রিশ খানা উইকেটও তিনি পেতে পারতেন। এই দুই মিলিয়ে সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার হওয়ার দিকে আরেকটু এগিয়ে যেতেই পারতেন সাকিব।
তবে না সাকিব বোধ হয় আর সে সুযোগ খুব একটা পাবেন না। সাকিবের অনিচ্ছা কিংবা ভাগ্যের নির্মমতায় সাকিব ঘরের মাঠে শ্রীলংকার বিপক্ষেও টেস্ট সিরিজেও অনুপস্থিত থাকতে চলেছেন। এবার হানা দিয়েছে করোনা। অন্তত প্রথম টেস্ট ম্যাচে তিনি থাকছেন না সেটা সুনিশ্চিত। তবে কি আমরা সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারের দেশ হওয়ার গৌরবটা হারাতে চলেছি? হয়ত!