সামর্থ্য স্মরণ করালেন শামি

টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে সাউদাম্পটনের আবহাওয়া নিয়ে আলোচনার আগে ভারতের একাদশে চার পেসার খেলবে কিনা সেটা নিয়েই ছিলো বেশ আলোচনা। তিন পেসার খেললেও কোন তিনজন থাকবেন সেটা নিয়েও দেখা দিয়েছিলো সংশয়।

অভিজ্ঞতা আর স্যুইং দক্ষতার কারণে ইশান্ত শর্মা থাকছেন সেটা নিশ্চিত ছিলো। এক্স-ফ্যাক্টর হিসেবে দলে জাসপ্রিত বুমরাহও ছিলেন নিশ্চিত। তবে তৃতীয় পেসার হিসেবে কে খেলবেন সেটা নিয়ে কিছুটা জলঘোলা হয়েছিলো। ভারতের সাবেক বেশ কিছু ক্রিকেটারই চেয়েছিলেন মোহাম্মদ শামিকে না নিয়ে একাদশে তরুন মোহাম্মদ সিরাজকে সুযোগ দেওয়া হোক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভারতীয় ক্রিকেট ভক্তদের একটা বড় অংশ সিরাজকেই একাদশে দেখতে চাচ্ছিলেন। তবে সবশেষে বাইরের মাটিতে শামির দুর্দান্ত রেকর্ডের কারণে একাদশে টিকে গেলেন তিনিই।

আর শেষ পর্যন্ত অনিশ্চিত থাকা সেই শামিই ভারতের নায়ক। ভারত যে এখনও টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালের লড়াইয়ে আছে, তার কারণ এই শামির বৈচিত্রময়, বুদ্ধিদীপ্ত বোলিং।

মোহাম্মদ শামির ওপরে ওয়াকার ইউনুসই একমাত্র বোলার যিনি এশিয়ার বাইরে সবচেয়ে ভালো স্ট্রাইক রেটে বল করেছেন। ৫০ টেস্ট খেলার পর ওয়াকার ইউনুসের এশিয়ার বাইরে স্ট্রাইক রেট ছিলো ৪০.৮। অপরদিকে, মোহাম্মদ শামির বোলিং স্ট্রাইক রেট ৪৯.৭। দেশের বাইরে শামির স্ট্রাইক রেট এবং গড় প্রায় কাছাকাছি। তার গড়ের তুলনায় প্রতি উইকেট নিতে তিনি মাত্র ১০ রান বেশি খরচ করেছেন।

ঘরের মাটিতের ভারতের বোলিং বিভাগের বেশিরভাগ ওভারই মূলত স্পিনাররা করতেন। যার কারণে পেসারদের স্ট্রাইক রেট কিংবা গড় কিছুটা বেশি। গতদিন মঙ্গলবার টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালের পঞ্চম দিনে মোহাম্মদ শামি দুর্দান্ত বোলিং করেন। তার ফিটনেস, পারফরম্যান্স নিয়ে যেসব প্রশ্ন উঠছিলো সবকিছুর জবাবই তিনি বল হাতে দিয়েছেন।

সবশেষ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজে অ্যাডিলেডে ব্যাট করার সময় ইনজুরিতে পড়ে ছিটকে যান তিনি। এরপর ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) ফিরেন। সেখানে প্রথম আট ম্যাচে ১৭২ বল করেন তিনি! সেখান থেকে সরাসরি খেলতে নামেন টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল। প্রথম ইনিংসে নিউজিল্যান্ডের প্রথম ২ উইকেটে ১০১ রানের মধ্যে তিনি কোনো উইকেটই নিতে পারেননি। দুর্দান্ত বোলিং করলেও ভাগ্য সহায় না হওয়ায় উইকেট মেলেনি তার।

জাসপ্রিত বুমরাহও পারছিলেন না উইকেট নিতে। ইশান্ত শর্মা কনওয়েকে ফেরালেও তাদের যেই পেস আগ্রাসন, স্যুইং কিংবা গতি সেটা থেকে তারা উইকেট আদায় করতে সমর্থ হচ্ছিলেন না। নিউজিল্যান্ডের ব্যাটসম্যানরা ভারতীয় পেসারদের ৩২ শতাংশ বলই ছেড়ে দিচ্ছিলেন। বল তখন প্রায় ৫৬ ওভার পুরোনো হয়ে গেছে। ভারতের পেস অ্যাটাকের সামনে রান বের করতে না পারলেও উইকেট দিচ্ছিলেন না কিউই ব্যাটসম্যানরা৷ এরপর মোহাম্মদ শামি বোলিংয়ে আসলেন নিজের পরিকল্পনার কিছুটা পরিবর্তন এনে।

তিনি এমনভাবে উইকেটে বল ফেলছিলেন যাতে করে রস টেইলর, কেন উইলিয়ামসনদেরকে বাধ্য হয়েই বল খেলা লাগে। সেই সাথে বলে তখন দুর্দান্ত স্যুইং হচ্ছিলো। রস টেইলর ছাড়বেন কি ব্যাটে খেলবেন বুঝতেও পারছিলেন না। উইকেটের পেছনে স্লিপ থেকে অধিনায়ক বিরাট কোহলি শামিকে বলছিলেন ‘বাড়িয়া, খেলনে দেনা উসকো’ (ভালো হচ্ছে, ওকে বল খেলতে বাধ্য করো)।

শামি ব্যাটসম্যানের প্যাড আর স্টাম্প ফলো করেই ওই চ্যানেলেই প্রতিটা বল করার চেষ্টা করছিলেন যার দরুন রস টেইলর, উইলিয়ামসনের বল ডিফেন্স করতে কিছুটা সমস্যা হচ্ছিলো। স্যুইংয়ের কারণে উইকেটের পেছনে ঋষাভ পান্তেরও বেশি সতর্ক থাকতে হচ্ছিলো। এভাবে তিন ওভার স্যুইং ভেলকি দেখানোর পর সফল হন শামি।

ফুল লেন্থের বল ড্রাইভ করতে যান রস টেইলর, শর্ট কাভারে থাকা শুভমান গিল ডাইভ দিয়ে দুর্দান্ত এক ক্যাচ লুফে নেন। এই ব্রেক থ্রুর পরেই মূলত কিউদের উপর চেপে বসেন শামি-ইশান্তরা। এরপর দ্রুতই হেনরি নিকোলসে তুলে নেন ইশান্ত শর্মা। এরপর শেষ টেস্ট খেলতে নামা বিজে ওয়াটলিংকে ড্রিম ডেলিভারিতে বোল্ড করে মোহাম্মদ শামি। মিডল স্টাম্পে বল পিচ করে অফ স্টাম্পের একদম টপে আঘাত হানে শামির ড্রিম ডেলিভারি! এতেই বিদায় নিতে হয় বিজে ওয়াটলিংকে।

এরপর লাঞ্চ বিরতির পর নতুন বল নিলে অ্যাটাকে আসেন শামি। কলিন ডি গ্র‍্যান্ডহোমকে স্যুইংয়ে বোকা বানিয়ে লেগ বিফোরের ফাঁদে ফেলে নিজের তৃতীয় শিকার বানান তিনি। পর পর দুই আউটস্যুইংয়ের পরের পর ইনস্যুইং হওয়ায় বল বুঝতেই পারেননি গ্র‍্যান্ডহোম। অবশ্য উইলিয়ামসনের উইকেটও প্রায় নিয়েই ফেলেছিলেন তিনি! তবে আম্পায়ারস কলের কারণে বেঁচে যান কিউই অধিনায়ক। এরপর উইকেটে এসেই কাউন্টার অ্যাটাক করতে থাকেন জেমিসন। মোহাম্মদ শামির বলে লং অন দিয়ে ছক্কা হাঁকানোর পরের বলেই আবারো থার্ড ম্যান দিয়ে ছক্কা মারতে যান তিনি! তবে সেখানেই ধরা পড়েন জেমিসন।

জেমিসনকে নিজের চতুর্থ শিকার বানান শামি। তবে পঞ্চম উইকেট নেওয়ার আশা আর পূরণ হয়নি। টিম সাউদির ব্যাটে রান আসতে থাকায় নিজের স্পেলের শেষ ওভারগুলোতে কিছুটা খরুচে ছিলেন তিনি! যার কারণে শেষ দিকের উইকেট নিতে স্পিনারদের ব্যবহার করেন অধিনায়ক বিরাট কোহলি৷ রবিচন্দ্রন অশ্বিন ও রবীন্দ্র জাদেজা শেষ দুই উইকেট তুলে নিলেও কিউইরা ৩৩ রানের লিড নেয়।

২৬ ওভারে ৮ মেইডেন সহ ৭৬ রানের বিনিময়ে চার উইকেট শিকার করেন শামি। যেই শামি একাদশে থাকবে কিনা সেটা নিয়েই ছিলো বড় সংশয়! সেই শামিই কিনা ভারতীয় বোলিংয়ের সেরা স্পেল করলেন! তার লাইন লেন্থ আর এক্যুরেসি দিয়ে কিউই ব্যাটিং লাইন আপ ধসিয়ে দিয়েছেন শামি। ইনজুরি থেকে ফিরে তিনি নিজেকে আবারো প্রমাণ করলেন দেশের বাইরে তার স্ট্রাইক রেট কেনো সেরা। তিনি প্রমাণ করলেন ভারতীয় পেস অ্যাটাকের অন্যতম সেরা অস্ত্র তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link