মজার বিষয় পাকিস্তানি অলরাউন্ডার শোয়েব মালিকের যখন অভিষেক ঘটে তখন বর্তমান পাকিস্তান পেস আক্রমণের কাণ্ডারি শাহিন শাহ আফ্রিদি কিংবা মোহাম্মদ ওয়াসিম জুনিয়র অথবা বাটার হাদায় আলী জন্মগ্রহণও করেননি। এমন কি এই যে শোয়েব মালিককে নিয়ে লিখতে বসা লেখকেরও তখন জন্ম হয়নি।
শোয়েব মালিকের অভিষেক ম্যাচের অধিনায়ক ওয়াসিম আকরাম অবসর নিয়েছেন আজ থেকে প্রায় আরো ১৮ বছর আগে। আর বর্তমানে তিনি যাদের নেতৃত্বে খেলতে চলেছেন মালিক তাঁরা ছিলেন তখন ছোট্ট শিশু। অধিনায়ক বাবর আজম ছিলেন শৈশবের পঞ্চম বর্ষে অপরদিকে সহ-অধিনায়ক সাদাব খান ছিলেন বছর খানেকের শিশু।
সেই সময়ের স্মৃতিচারণা করেন ওয়াসিম আকরাম। তিনি বলেন, ‘১৯৯৯ সালে (শোয়েব) মালিকের পাকিস্তান দলে আসার সময়টা আমি মনে করতি পারি। আমিই ওকে দলে নিয়েছিলাম। তখন ওর ১৬-১৭ বছর বয়স। একেবারেই রোগাপাতলা একটা ছেলে। প্রথমে মূলত বোলার ভেবেই দলে নিয়েছিলাম, জানতাম ফিল্ডিংটাও ভাল করে। ওই সময় একদমই টের পাইনি যে ও এতটা ভাল ব্যাটিং করে।’
১৯৯৯ থেকে ২০২১ দীর্ঘ ২২ বছরের ক্রিকেটীয় ক্যারিয়ার শোয়েব মালিকের। এখনই যে শেষ হয়ে যাচ্ছে তাঁর বণাঢ্য ক্যারিয়ার তা নয়। ৩৯ বছর বয়সেও তিনি ডাক পেয়েছেন বিশ্বকাপ দলে। আসন্ন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে তিনি প্রতিনিধিত্ব করবেন পাকিস্তানকে ষষ্ঠ বারের মতো।
তবে এই বিশ্বকাপে তিনিই যে সবচেয়ে বয়স্ক খেলোয়াড় তা নয়। ৪২ বছর বয়সী ক্রিস গেইলও খেলবেন এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ উইন্ডিজদের হয়ে। তাঁর অভিষেক মালিকের মাসখানেক আগেই হয়েছিল।
এই দীর্ঘ প্রায় দুই যুগের পাকিস্তান ক্যারিয়ারে তিনি বারংবার নিজের সামর্থ্য প্রমাণ করে গেছেন। দিয়ে গেছেন আস্থার প্রতিদান। উত্থান পতনের তাঁর ক্যারিয়ারে ২০১৫ তে বিদায় জানিয়েছিলেন বনেদী সাদা পোষাককে। আর ২০১৯ বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে ছিল তাঁর ওয়ানডে ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ। তবে ক্রিকেটের ক্ষুদ্রে সংস্করণে আরো কিছুদিন খেলে যেতে চান হয়ত তিনি। খেলাটা তো আর এত সহজে ছেড়ে দেওয়া যায়?
অধিনায়ক বাবর আজম ভরসা রাখছেন তাঁর এই অভিজ্ঞ সেনানির উপর। না রেখে তো উপায় নেই। তিনি নি:সন্দেহে এই ফরম্যাটের একজন অন্যতম সেরা খেলোয়াড়। ২০০৭ বিশ্বকাপের রানার্স আপ হওয়া দলে ছিলেন মালিক।
এছাড়াও তিনি ২০০৯ এ যেবার বিশ্বকাপ জিতলো পাকিস্তান সেবারেও তো ছিলেন মালিক। শুধু যে ছিলেন তা বলা ভুল হবে। তিনি ছিলেন এবং অবদান রেখেছিলেন দলের প্রয়োজন অনুসারে। অভিজ্ঞতার মানদণ্ডে তাঁর ধারেকাছেও নেই বর্তমান পাকিস্তান দলের অন্য কেউ।
তাহলে কি শুধু অভিজ্ঞতার জোড়েই তিনি দলে? না বিষয়টা এমন নয়। তিনি পারফর্ম করেই এসেছেন দলে। পাকিস্তানের ঘরোয়া লিগে তিনি গত সাত টি-টোয়েন্টি ম্যাচে রান করেছেন ২২৫। গড় করলে দাঁড়ায় ৭৫ এর আশেপাশে। তাঁর ব্যাট এখনো চলে তিনি এখনো রান করতে জানেন।
ওয়ানিম আকরাম বলেন, ‘ও সীমিত ওভারে পাকিস্তানের জীবনী শক্তি। এমনকি ওর এখনকার ফিটনেসের কথাও যদি বলি, সেখানেও সে অনেকের চেয়ে এগিয়ে থাকবে। ও আজো খুব কঠোর ট্রেনিং করে। তরুণ খেলোয়াড়দের ওকে দেখে শেখা উচিৎ। এই বয়সেও যেভাবে সবার সাথে পাল্লা দিয়ে পারফরম করছে, তাতেই বোঝা যায় ও মানসিক ভাবে কতটা শক্ত। ও নিজেকে আরো উঁচুতে তুলতে চায়।’
তবে এই যে বিশ্বকাপ দলে তাঁর অন্তর্ভুক্তির পেছনের ভাগ্যের এক অদৃশ্য সহয়তা ছিল। এই ভাগ্য বড় নিষ্ঠুর মালিকের ক্ষেত্রে প্রসন্ন হলেও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে আরেক টপ অর্ডার ব্যাটার শোয়েব মাকসুদের দিক থেকে। পিঠের ইনজুরিতে মাকসুদ বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গেলে অভিজ্ঞতা এবং সাম্প্রতিক পারফর্মেন্সের ভিত্তিতে মালিক অটো চয়েস হিসেবে সংযুক্ত হয়ে গেলেন দলের সাথে।
তাঁর আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ার মন্দ নয়। প্রায় ১২৪ স্ট্রাইক রেটে রান তুলতে সক্ষম তিনি। এই স্ট্রাইকরেটে ১০৬ ইনিংস থেকে করেছেন ২৩৩৫ রান। নট আউট থেকেছেন ৩১ ম্যাচে। এই বয়সে এসো তাঁর ম্যাচ খেলার মতো শারীরিক সামর্থ্য প্রশংসনীয় পাশাপাশি তাঁর পরিসংখ্যান তাঁর পক্ষে কথা বলে, তাঁকে ভরসা করতে উদ্বুদ্ধ করে।
মালিক একজন অলরাউন্ডার। ব্যাট যেমন চলে তাঁর, ঠিক তেমনি করে আঙ্গুলের কারসাজিতে স্পিন বল করতেও জানেন তিনি। এখন পর্যন্ত খেলা আন্তর্জাতিক টি-২০ ম্যাচের মধ্যে ৪৮ ম্যাচে বোলিং করে ২৮ উইকেট নিয়েছেন তিনি। বিপদের সময় বল হাতেও তিনি হয়ে যেতে পারেন পাকিস্তানের ত্রাণকর্তা।
সেই একবিংশ শতাব্দীর প্রাক্কাল থেকে দুই দশক বাদেও শোয়েব মালিক হতে পেরেছেন পাকিস্তানের ভরসার প্রতীক। ছোকড়া থেকে হয়েছেন পুত্র সন্তানের বাবা। কৈশর থেকে এসে পৌছেছেন মধ্যবয়সে। ক্রিকেট খেলাটা ভোলেননি মালিক। সময়ের এই পরিক্রমায় ভুলে যাননি কি করে মাঠ ছাড়া করতে হয় বল।
পরিপক্কতা এসেছে ব্যাটিংয়ের সাথে মানসিকতায়। ধ্বংসস্তুপ থেকে দলকে বাঁচিয়ে নিয়ে আসতে যানেন মালিক, আরো জানেন কি করে আশার জাহাজ ভেরাতে হয় জয়ের বন্দরে। অভিজ্ঞ এই নাবিকের হতে পারেন পাকিস্তানের কাণ্ডারি।
মালিকের এটাই শেষ বিশ্বকাপ। ২০২২ সালে তিনি যে খেলবেন না আগেই বলে দিয়েছেন। এবারের বিশ্বকাপে যাওয়ার আগে মালিক বলে গেছেন, ‘আমি বিশ্বকাপ খেলতে চাই, সেখান থেকে ফিরতে চাই মাথা উঁচু করে।’
মালিকের লক্ষ্যটা কি তা নিশ্চয়ই আর ভেঙে বলে না দিলেও চলে!