মহানায়কের সেই কাঁধ

সাল ১৯৮৯!

ভারতীয় দলের জন্যে ভুলে যাওয়ার মত একটা বছর। সে বছরের নভেম্বর অব্দি ভারত যে গোটা চারেক টেস্ট খেলেছিল তাঁর মধ্যে তিনটেতেই ড্রেসিংরুমে ফিরতে হয়েছিল মাথা নিচু করেই। কথায় আছে, ‘শেষ ভাল যার, সব ভাল তাঁর’। সেই শেষটা ভাল করার জন্যেও ভারতীয় দলের কাছে ছিল যুৎসই মওকা।

বছরের শেষে তাঁদের সিরিজটা ছিল পাকিস্তানের মাটিতে, ‘চির-শত্রু’র বিপক্ষে। এমনিতেই ভারত-পাকিস্তান সিরিজ মানে উত্তেজনার পারদ, রন্ধ্রে রন্ধ্রে জেগে ওঠা শিহরণ, হেডলাইনের ছড়াছড়ির সাথে খবরের কাগজের বাড়তি কাটতি। তবে সেই সিরিজটা ‘ভারত-পাকিস্তান’ ছাড়িয়ে জায়গা করে নিয়েছিল আরো একটা জায়গাতে। খবরের কাগজের শিরোনামে সিরিজের চাইতেও ঠাঁই করে নিয়েছিল আরো একটা নিয়ামক!

চার টেস্টের মহা প্রতিদ্বন্দিতামূলক সিরিজ ছাড়িয়ে মিডিয়ার কাভারেজে এসেছিল আরো একটা খবর- ১৬ বছরের একটা কিশোরকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের রমরমা প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দিচ্ছে ভারত!

নামটা এতক্ষণে অনুমান করে ফেলার কথা।

হ্যা, শচীন রমেশ টেন্ডুলকার।

যে বয়সটাতে বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে ছড়ি ঘুরিয়ে উড়িয়ে বেড়ানোর কথা স্বপ্নের নিশানা সেই বয়সটাতে তিনি রীতিমত খেলবেন ভারতীয় দলের সিরিজ, সেটাও আবার যেন তেন সিরিজ নয়। আগুনে উত্তাপের ভারত-পাকিস্তানের চার টেস্টের সিরিজ , সেটাও আবার পাকিস্তানের মাটিতেই।  এমনও কি সম্ভব?

হ্যাঁ সম্ভব। দিনটার তারিখের হিসেবে সেটা ছিল ১৫ নভেম্বর। সালের হিসাবটা তো শুরুতেই বললাম, ১৯৮৯! ভারতীয় ক্রিকেটের সর্বোচ্চ আসনে বসে যাওয়া শচীন রমেশ টেন্ডুলকার সেদিন প্রথম বারের মত ব্যাট প্যাড জড়িয়ে সবুজ গালিচায় নামতে যাচ্ছেন। একটা লিগ্যাসি, একটা যুগ, একটা আবহ, একটা সময়ের শুরু হতে যাচ্ছে। যে লিগ্যাসি ভারত ছাড়িয়ে বুঁদ করে রাখবে সমগ্র বিশ্বকেই, তাও গোটা চব্বিশেক বছরের মত দীর্ঘ সময়ে! শচীন টেন্ডুলকার, আপনাকে স্বাগতম!

শচীনকে নিয়ে ভারতের সবচাইতে জনপ্রিয় উক্তিটা হল, ‘ক্রিকেট এখানে ধর্ম, শচীন যে ধর্মের আরাধ্য’।

ক্রিকেটের সেই নিয়ন্তার শুরুটা কিন্তু সহজ ছিল না মোটেও। তর্কসাপেক্ষে বলা যেতে পারে, নিজের অভিষেকেই তাকে সামলাতে হত ক্রিকেট ইতিহাসেরই সেরা তিন পেসারকে। ইমরান খান, ওয়াকার ইউনুস, ওয়াসিম আকরামে সাজানো পাকিস্তানের পেস বোলিং লাইনআপকে আপনি হয়তো চোখে দেখেননি। ১৬ বছরের শচীন তাই ঠিক কিসের সামনে দাঁড়িয়ে গেছিলেন সেটা অনুধাবন করতে তাই আপনার হয়তো একটু কষ্ট হতে পারে। একটু সাহায্য করা যাক তবে?

সাদা পোশাকে ইমরান খান, ওয়াসিম আকরাম আর ওয়াকার ইউনুস একসাথে মিলে নিয়েছেন মোট ১১৪৯ উইকেট! সেই ত্রয়ীর সামনে দাঁড়িয়ে শচীন যে আগমের শাঁখ বাজিয়েছিলেন এমনটা কিন্তু মোটেও বলা যাবেনা। অভিষেক ইনিংসে শচীনের রান ছিল মাত্র ১৫। কিন্তু শচীন কি ১৫ রানে প্যাভিলিয়নে ফিরতে ফিরতে জানতেন , ১৫ দিয়ে যে রথের শুরু তা একসময় গিয়ে থামবে ১৫ হাজারের বেশিতে?

  • ‘গ্রেট’ শচীন টেন্ডুলকারের শুরু

দানে দানে তিন দান, শচীন টেন্ডুলকার খেলে ফেলেছেন ক্যারিয়ারের প্রথম তিন টেস্ট। ঠিক সুবিধা করতে পেরেছেন এমনটা কিন্তু মোটেও বলা যাবেনা। তাহলে কি ‘হীরে’ চিনতে ভুল হয়ে গেল বিসিসিআই এর? নাহ, বিসিসিআই এমন দাবি করেনি কখনও। বরং নিজের মাহাত্ম্যের প্রথম সৌহার্ঘ্য বিশ্ব ক্রিকেটকে শচীন দেখিয়েছিলেন ঠিক তিন টেস্ট পরই, চার নম্বর টেস্টে।

শিয়ালকোটের সেই টেস্টটাকে মানুষ নানা কারণেই মনে রাখে। শচীনের জন্যে যেমন, তেমনি মনে রাখে ওয়াকার ইউনুসের বাউন্সার শচীনের নাকে আঘাত হানার ভিডিও ক্লিপের কারণে। কি বাউন্সারটাই না ওয়াকার ছুঁড়েছিলেন! লাফিয়ে ওঠা বলটা শচীনের নাক বরাবর আঘাত হানতেই পরনের সাদা জার্সিটাও হয়ে গেছিল রক্তবর্ণের লাল।

সেই রক্তাক্ত, সেই আঘাতপ্রাপ্ত হয়েও শচীন কিন্তু থেমে যাননি। অবশ্য গোটা জীবনটাই যার দুই যুগ ধরে শুধু ছুটে চলার গল্প তিনি একটা বাউন্সারে থেমে যাবেন সেটাও আবার হয় নাকি?

হয়নি, শচীন মাঠ ছাড়েননি। ১৬ বছরের একটা কিশোরের জন্যে বিদেশের মাটিতে সাদা পোশাকের ইতিহাসে তর্কযোগ্যভাবে সেরা বোলিং লাইনআপের বিপক্ষে এমন ‘রিফিউজ টু লুজ’ মনোভাব সেদিন আবালবৃদ্ধবনিতা সবার নজর কেড়েছিল। কিন্তু তখনও কি কেউ জানত, বিস্ময়ে দিনাতিপাতের এই সবে শুরু! শচীন সেই ম্যাচে করেছিলেন এক ফিফটি, শিয়ালকোটের পিচে দাঁড়িয়ে ভারতের ম্যাচ বাঁচানো ফিফটিতে শুরু হয়েছিল গ্যালারির ‘শচীইইইইইন…… শচীন’ রবের প্রথম মূর্ছনা কিংবা বলতে পারেন ভোকাল কর্ডের প্রথম রাগ!

  • ১৯৯০- ‘শচীন’ হয়ে ওঠার দশক

ঠিক বছর দুই পরে। ক্যাঙারুর দেশে শচীন নিজের শচীনিয় দুই ক্লাসিকের জন্ম দিয়ে বসেন। ভুলে গেলে চলবেনা, সে সময়ে শচীনের বয়স উনিশও হয়নি। আর এই টিনএজ পার করতে না পারা কিশোরই সেদিন অস্ট্রেলিয়ার বোলারদের দম্ভের চূড়া থেকে নামিয়ে আনলেন একেবারে মাটিতে। সিডনির সেই অপরাজিত ১৪৮ যদি শচীনের ট্যালেন্টকে  জানান দেয়, পার্থের সেঞ্চুরি তবে বিশ্ববাসীকে আরো জানিয়ে দেয়- এই ছেলেটার নিজের গ্রেটনেস ছুঁয়ে দেখার পথে একটা নিজস্ব প্রডিজি আছে। সেই প্রডিজি গলির মোড় পেরিয়ে ছুঁয়ে যাবে ঘরের ভেতর রাখা উনিশ ইঞ্চির সাদাকালো টেলিভিশন সেটকেও!

নাহ, আমি লিখে পার্থের সেই মাহাত্ম্যকে বোঝাতে পারছিনা। এখনকার অনেকেই হয়তো সেই ক্রিকেট মোনালিসার ব্যাট ছুঁয়ে যাওয়া অঙ্কন সরাসরি দেখেনওনি। কিন্তু ইন্টারনেটের যুগে এটুকু নিশ্চয়ই আপনি দেখে থাকবেন, ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি উচ্চতার হয়েও কিভাবে ছুটে আসা মারণঘাতি বাউন্সার সামলে নিজের  মাহাত্ম্য সেদিন দৃপ্তস্বরেই ঘোষণা করে যাচ্ছিলেন তিনি।  উচ্চতার সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে সেই ইনিংসের প্রতিটা ব্যাকফুট পাঞ্চ, প্রতিটা কাট জানান দেয় ক্রিকেট সত্যের অমোঘ নক্ষত্রকে।

তবে শচীনের জাত ভক্ত হলে এসবের চাইতে আপনার মনে থাকবে ১৯৯৮ সালকে। শচীন ততদিনে নিজেকে নিয়ে গেছেন আরেকটু উপরে, নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন সময়ের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে, বনে গেছেন গোটা ভারতের ক্রিকেট হার্টথ্রুব, তীব্র কষ্ট বুকে নিয়ে যার ব্যাটিংয়ে সান্ত্বনা খোঁজে ভারতের একটা আস্ত প্রজন্ম। এসবের মাঝেই সে বছরেরই ২রা এপ্রিল ‘দ্যা লিটল মাস্টার’ খেলে ফেললেন না ভোলার মত আরেক ক্লাসিক। শারজাহর সেই রাত অস্ট্রেলিয়ান বোলাররা আর চাইলেও মনে হয় ভুলতে পারবেনা।

ভারতের ওয়ানডে ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা সেই ইনিংস খেলার পথে আরেকটা উপযোগ সেই ইনিংসটার মাহাত্ম্য আরেকটু বাড়িয়ে দিয়েছিল। টনি গ্রেইগের ধারাভাষ্য। শেন ওয়ার্ন, মাইকেল কাসপ্রোভিচ, ডেমিয়েন ফ্লেমিংকে শচীন যখন নেট বোলার বানিয়ে ছাড়ছেন, ধারাভাষ্য কক্ষে টনি গ্রেইগের সেই কাঁপা কাঁপা কণ্ঠের বুলি ‘হোয়াট আ প্লেয়ার’ যে শুনেছে আর কখনও মনে হয়না ভুলতে পারবে।

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে শচীনের সেই টানা দুই সেঞ্চুরিই ভারতকে জিতিয়ে দিয়েছিল কোকা-কোলা কাপের শিরোপা!

  • মহা নায়কের অশ্রু

ক্রিকেট মহা নায়কের কি তবে সবটা পথ এত মসৃণ ছিল? ২০০৪ সালের ঘটনা ভুলে গেলে চলবেনা। ইনজুরিগ্রস্ত শচীন টেন্ডুলকারের ধরা পড়ল ‘টেনিস এলবো’। সেই প্রথমবারের মত মনে হয় ভারতের মিলিয়ন সংখ্যক মানুষ এই মেডিকেল টার্মের সাথে প্রথমবারের মত পরিচিত হল, তাও শচীনের কল্যাণে। সমস্যাটা ছিল জটিল, সেই জটিল সমস্যার সমাধান ছিল আরো ছিল জটিল।

এমনও দিন গেছে শচীন যখন তাঁর ক্রিকেট ব্যাটটা তুলতেও পারছেন না। সেই ক্রিকেট ব্যাট যেটা তাকে এনে দিয়েছে অপরিমিত সাফল্য, বানিয়ে দিয়েছে গোটা ভারতের রাজপুত্র।

শচীনকে এই সমস্যা বয়ে বেড়াতে হয়েছে তাঁর ক্যারিয়ারে ১৫ টা বছর জুড়ে, এই ১৫ টা বছরে ছুরি কাঁচির নিচেও তাকে যেতে হয়েছে বেশ অনেকবার। কিন্তু নাহ, টেন্ডুলকার থামেননি। ঠিক যেমন থামেননি ১৬ বছর বয়সে ওয়াকারের সেই বাউন্সারে। তিনি মাটি কামড়ে পড়ে থেকেছেন। মাঠে দিনের পর দিন ঘাম ঝরিয়েছেন। শচীন টেন্ডুলকার তাঁর অটোবায়োগ্রাফি ‘শচীন – আ মিলিয়ন ড্রিমস’ এ বলেছেন ক্রিকেট খেলাটা তাঁর কাছে নাকি মন্দিরে যাওয়ার মতই । এমনভাবেই একটা ক্রিকেট ব্যাটকে নিজের মধ্যে লালন করে গেছেন শচীন। সেই ক্রিকেট ব্যাট তিনি ছেড়ে দেবেন, এমনটাও কি হয় নাকি?

আর এসবের মাঝে সেই লালন করা ইচ্ছে শচীনকে ফিরিয়েও দিয়েছে অনেক অর্জন। ২০১০ সালের কথাই বলা যাক।  সাদা পোশাকে ২৩ ইনিংসে ৭৮.১০ গড়ে ১৫৬২ রান, ওয়ানডে ক্রিকেটে ক্রিকেট ইতিহাসেরই প্রথমবারের মত ডাবল সেঞ্চুরি- শচীনের হৃদয়ে পরম যত্নে থাকা ক্রিকেট ব্যাট শচীনের প্রতিটা শ্রমকে যেন ফিরিয়ে দিয়েছে।

  • ‘বিশ্বজয়ী’ টেন্ডুলকার

বয়স তখন আটত্রিশ হয়ে গেছে। নিজের গ্রেটনেসকে শিকড়ে তুলতে শচীন খুঁজে মরছেন গ্রেটনেসের মাপকাঠি – বিশ্বকাপ। আর ঠিক তখনই ২০১১ সালে শচীন অংশ নিলেন নিজের ষষ্ঠ আর ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপে। বিশ্বকাপের শুরুতেই ধারণা করা হচ্ছিল, এবারই মনে হয় সেরা সময়।

শচীনের বিশ্বকাপ জেতার, দীর্ঘ অপেক্ষার পর ভারতের বিশ্বকাপ জেতার। সেই জেতাটাও সহজ ছিল না। একে তো বিশ্বমঞ্চের খেলা, তার ওপর ভারতের বিলিয়ন মানুষের আশা ভরসার চাপ। সেই চাপ সামলে তরীকে তীরে ভেড়াতে ভারতের সবচাইতে শক্ত জায়গাটা ছিল ব্যাটিং লাইনআপে শচীন টেন্ডুলকারের উপস্থিতি।

টেন্ডুলকারও যেন সেই টুর্নামেন্টে নিজেকে একেবারে নিংড়ে দিয়েছিলেন গোটা ভারতের স্বপ্নের সামনে। পুরো টুর্নামেন্টে তিনি করেছিলেন ৪৮২ রান। শুধু রানসংখ্যার হিসাবেই না, ব্যাট হাতে তিনি ছিলেন ভারতের ইনিংস সূচনার পথপ্রদর্শক। আর সেই স্বপ্নের, শচীনের সেই গ্রেটনেস ছোঁয়ার মাপকাঠির হিসাবে ২০১১ এর ২রা এপ্রিল মহেন্দ্র সিং ধোনি যখন ট্রেডমার্ক হেলিকপ্টার শটে বলকে গ্যালারিতে পাঠিয়ে দিলেন, ঠিক তখন- ‘ঈশ্বর’ শচীন, গোটা ভারতের হার্টথ্রুব শচীন, দীর্ঘ যুগ ধরে ভারতের দায় বয়ে বেড়ানো শচীন বনে গেলেন ‘বিশ্বজয়ী’ শচীন।

সেই বিশ্বকাপ জয়ের পর ‘বিশ্বজয়ী’ শচীনকে কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন সে সময়কার বিরাট কোহলি। শচীনকে নিয়ে সবচাইতে চমৎকার উক্তিটা সেসময় বেরিয়েছিল বিরাটের মুখ থেকেই। নিজের কাঁধে শচীনকে চাপিয়ে তিনি বলেছিলেন,

‘This man has carried the burden of the nation for 21 years, It is time we carried him on our shoulder’

২১ টা বছর ভারতকে নিজের কাঁধে বয়ে বেড়ানোর পর ভারত শচীনকে ‘বিশ্বজয়ী’র খেতাব এনে দিয়েছিল!

কিংবা, হয়তো তিনিই ভারতকে এনে দিয়েছিলেন! যেটাই হোক শচীন সেদিন ‘বিশ্বজয়ী’ হয়েছিলেন।

  • নক্ষত্রেরও মরে যেতে হয়

জীবনানন্দ দাস লিখেছিলেন, “ প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়’’

আসলেই তো। ষোল বছর বয়সে ওয়াকারের বাউন্সার যাকে থামাতে পারেনি, ভয়ংকর মেডিকেল কন্ডিশন টেনিস এলবো যার গ্রেটনেসকে একটুও ছুঁতে পারেনি, সেই শচীন টেন্ডুলকারকেও একসময় থেমে যেতে হল প্রকৃতির নিয়ম মেনে নিয়েই। আর সেই দিনটা ছিল ২০১৩ এর নভেম্বরের একদিন!

ঠিক সেই সময়, যখন গোটা একটা জাতি কাঁদছে, ঠিক সেই সময় যখন সেই জাতির সবচাইতে বড় নায়ক যাকে তাঁরা মহা নায়কের মর্যাদা দিয়েছে সেই নায়ক সিদ্ধান্ত নিয়েছে – এবার সময় থেমে যাওয়ার।

১৬ ই নভেম্বর, ২০১৩! ভারতের জার্সি গায়ে ঠিক শেষবারের মত মাঠে নামছেন শচীন টেন্ডুলকার। গোটা ভারত শচীনকে দেখেছে তিনি কিভাবে প্রডিজি থেকে হয়ে উঠেছেন অমর এক ক্রিকেট কিংবদন্তী, সেই শচীনকে সেদিন ভারত আরেকবার দেখছে- চূড়ায় বসা এক রাজপুত্র কিভাবে ছেড়ে যাচ্ছেন নিজের ময়দান!

শচীন ভারতকে কখনও নিরাশ করেননি। গ্যালারির ছন্দময় ‘শচীইইইইইন……শচীন’ কে কখনও একটুও থামতে দেননি। নিজের শেষেও দেবেন তাই বা কি করে হয়? নাহ, নিজের শেষ সময়েও ক্রিকেট রোম্যান্টিকদের নিরাশ করেননি শচীন। ব্যাকফুট পাঞ্চ থেকে নান্দনিক কাভার ড্রাইভ, সবই ছিল নিজের শেষ সেই ইনিংসে।

দ্রুতই তিনি পেরিয়ে গেলেন পঞ্চাশের কোটা আর গোটা একটা জাতি আরেকবার অপেক্ষা করছিল কখন তাঁদের মাঠের ক্রিকেটের মহা নায়ক আরেকটাবার তিন অঙ্কের রান ছুঁয়ে ব্যাট আকাশে তুলে দেখাবেন। কিন্তু, সবটাই যদি দুয়ে দুয়ে চার মিলে যেত তিনি তো আর রক্তমাংসে গড়া মানুষ হতেন না, তাইনা? নিজের ৭৪ রানের সময় নারসিং ডিওনারিনের বলে স্লিপে দাঁড়ানো ড্যারেন স্যামির হাতে ক্যাচ দিয়ে বসলেন তিনি।

ব্যাস, পুরো স্টেডিয়াম যেন থমকে গেল। স্লিপে দাঁড়িয়ে ব্লাইন্ডার নেওয়া ড্যারেন স্যামিও দাঁড়িয়ে রইলেন পাথুরে মূর্তির মত।  স্লিপে একবার দেখে নিয়ে শচীনও নির্বিকার, নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে হেঁটে ফিরে যাচ্ছেন ড্রেসিং রুমে।  ওয়েস্ট ইন্ডিজ তখন আরেকবার ভারতকে ব্যাটিংয়ে পাঠাবে এমনটা আসলে সম্ভব ছিল না। শচীনও বুঝে গেছিলেন তিনি আরেকটাবার ২২ গজের এই দুনিয়াতে আসবেন না, যেটাকে তিনি ভক্তিভরে মন্দির মনে করতেন।

যাবার আগে তাই তিনি গ্যালারির সামনে দাঁড়িয়ে ব্যাট উচিয়ে ধরলেন। সেই উঁচু করে ধরা ব্যাটে কি লেখা আছে কে জানে, কিন্তু ভারতবাসী ঠিক বুঝে গেল- ২৪ বছরের রূপকথা শেষ হয়ে যাচ্ছে। আরেকবার ভারত খেলতে নামবে, আরেকবার ভারতের সিরিজ থাকবে, আরেকজন কেউ তুলে নেবে ভারতের ব্যাটিং লাইনআপের ব্যাটন কিন্তু সেটা কোনভাবেই আর শচীন রমেশ টেন্ডুলকার হবে না।

ভারতবাসীর প্রেম, ভারতবাসীর ভক্তি, ভারতবাসীর জ্বলজ্বলে নক্ষত্র ফিরে যাচ্ছেন প্যাভিলিয়নে- শেষবারের মত!

  • শচীইইইইইইইন………শচীন

এবার আসা যাক সবচাইতে বড় প্রশ্নে। কেন শচীন টেন্ডুলকার সেরা হলেন? কেন তাকে ক্রিকেটের কিংবদন্তী বলা হয়? সেটা কি শুধুই তাঁর অর্জন করা সংখ্যার খাতিরে যেটা সবসময়ই তাঁর মাহাত্ম্যকে জানান দেয়?

হ্যা, সংখ্যা তো বটেই। কিন্তু সেই সংখ্যাও তো কখনও কখনও ম্লান হতে পারে, তাইনা?

তাহলে?

উত্তরটা সোজা। শচীন ছিলেন ভারতবাসীর কাছে দেবতাতুল্য। ভারত শচীনের মাধ্যমে গর্ব করার মত কিছু পেয়েছিল, শচীনও ব্যাট হাতে এমন সব মিরাকলের জন্ম দিয়ে যেতেন যেটা নিয়ে গোটা ভারত দীপ্তস্বরে বলতে পারত- আমাদের একটা শচীন টেন্ডুলকার আছে! গ্যালারিতে সবাই যখন ‘শচীইইইইইন’ স্লোগানে মুখরিত হত, তাঁরা শুধু একটা স্লোগানই বলত না। তাঁরা তাঁদের হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে তাঁদের নায়ককে, তাদের দেবতাকে ডেকে যেত। শচীনের সাফল্যও ভারতকে দিনের পর দিন আশা জুগিয়ে যেত। আর সেই আশা তাঁদের জুগিয়েছিল শচীনই যার কারণে আজও  গোটা ভারত শচীনের সামনে শ্রদ্ধাভরে নুয়ে পড়ে।

আর তাই, অবসরের সাতটা বছর পরও তিনি এখনও হয়ে আছেন গোটা ভারতের মহা নায়ক!

লেখক পরিচিতি

আদ্যোপান্ত স্টোরিটেলার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link