অ্যালেকজান্ডার দ্য গ্রেট

না, রাজার ভাগ্য এতটাও সহায় ছিল না। চোখের পরীক্ষায় পাস করতে পারেননি তিনি। আর যখন চোখের সমস্যাটা ধরা পড়ে, তখন তিনি এয়ারফোর্স কলেজের তৃতীয় বর্ষে। আবার তাঁর সমস্যাটাও বড় কিছু ছিল না। ১০ জনের মধ্যে ৭ জনেরই নাকি চোখে এধরণের সমস্যা থাকে, আর সেটা তাঁদের স্বাভাবিক জীবনে প্রভাব ফেলে না। কিন্তু, এই সমস্যা নিয়ে তো আর বিমান চালানো সম্ভব নয়। ফলে শৈশবের স্বপ্নটা অপূর্ণই রয়ে যায় তাঁর। তখনও তাঁর জীবনে ক্রিকেট আসনি।

সর্বজয়ী অ্যালেকজ্যান্ডার দ্য গ্রেট ভারত মহাসাগরে একটা ‘অনাবিষ্কৃত’ দ্বীপ খুঁজে পেয়েছিলেন। তার নাম তাপ্রোবেন। পরে নাম পাল্টে হয় সেয়লন, এরপর শ্রীলঙ্কা।

অ্যালেকজান্ডারকে এই অঞ্চলের মানুষ বলতো সিকান্দার। শ্রীলঙ্কান ভূখণ্ড আবিষ্কারের ২৩০০ বছর পর আরেকজন সিকান্দারকে পেল শ্রীলঙ্কা। তবে, নিজেদের আবিষ্কারক হিসেবে নয়। এই সিকান্দার চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন, শ্রীলঙ্কার আবার নতুন করে শুরু করার সময় চলে এসেছে।

সেটা ছিল ২০১৭ সাল। সিকান্দার রাজা – পাকিস্তানি বংশদ্ভুত জিম্বাবুয়ের এই অলরাউন্ডারের পারফরম্যান্স এতটাই রাজসিক ছিল যে, ওয়ানডে সিরিজে তার সামনে দাঁড়াতে পারেনি স্বাগতিক শ্রীলঙ্কা। পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে হেরে যায় ৩-২ ব্যবধানে। সিরিজ নির্ধারণের শেষ ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় হন সিকান্দার। ১৬ বছর পর দেশের বাইরে প্রথমবারের মত সিরিজ জয়ের গৌরব অর্জন করে নব্বইয়ের দশকের হারানো গৌরব খুঁজে ফেরা জিম্বাবুয়ে।

ওয়ানডের পরেই টেস্ট সিরিজ। টেস্টে তিনি হয়ে উঠলেন আরো ভয়ঙ্কর। বল হাতে অধিনায়ক গ্রায়েম ক্রেমার ও শন উইলিয়ামসদের দারুণ সঙ্গ দিলেন। তবে, আসল কাজটা করলেন ব্যাট হাতে।

২০৫ বলে খেলেছেন ১২৭ রানের অবিস্মরণীয় এক ইনিংস। এক ছক্কা আর নয় চারের এই ইনিংসের মাঝপথে ম্যালকম ওয়ালারকে সঙ্গী করে ১৪৪ রানের অনন্য এক জুটি গড়েন সিকান্দার। শ্রীলঙ্কাকে সেবার ৩৮৮ রানের লক্ষ্যে শ্রীলঙ্কা চার উইকেটের জয় পেলেও সত্যিকারের নায়ক ছিলেন সিকান্দার রাজাই।

অথচ, সিকান্দার রাজা ক্রিকেটার নয়, হতে চেয়েছিলেন বৈমানিক মানে পাইলট, তাও আবার বিমানবাহিনীর। মুক্ত আকাশে পাখির মত উড়তে চেয়েছিলেন সৈনিক হয়ে।

তাঁর জন্ম পাকিস্তানের শিয়ালকোটে। মাত্র ১১ বছর বয়সেই যুদ্ধ বিমান চালানোর স্বপ্ন দেখতেন। পাকিস্তানের এয়ারফোর্স কলেজে তিনি সুযোগও পেয়েছিলেন। ভর্তি পরীক্ষায় ৬০ হাজার প্রার্থীর মধ্যে রাজা তৃতীয় হন। এবার কি তাহলে স্বপ্নটা সত্যি হবে!

না, রাজার ভাগ্য এতটাও সহায় ছিল না। চোখের পরীক্ষায় পাস করতে পারেননি তিনি। আর যখন চোখের সমস্যাটা ধরা পড়ে, তখন তিনি এয়ারফোর্স কলেজের তৃতীয় বর্ষে। আবার তাঁর সমস্যাটাও বড় কিছু ছিল না। ১০ জনের মধ্যে ৭ জনেরই নাকি চোখে এধরণের সমস্যা থাকে, আর সেটা তাঁদের স্বাভাবিক জীবনে প্রভাব ফেলে না। কিন্তু, এই সমস্যা নিয়ে তো আর বিমান চালানো সম্ভব নয়। ফলে শৈশবের স্বপ্নটা অপূর্ণই রয়ে যায় তাঁর। তখনও তাঁর জীবনে ক্রিকেট আসনি।

মন ভেঙে যায় রাজার। পাকিস্তান ছেড়ে পারি জমান স্কটল্যান্ডে। গ্লাসগো ক্যালেডোনিয়ান ইউনিভার্সিটিতে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় টুকটাক ক্রিকেট খেলতেন। তবে, সেটা পেশাদার কিছু নয়।

পরে জিম্বাবুয়ে চলে যান রাজা। ব্যবসায়িক সূত্র ধরে ২০০২ সাল থেকে তার বাবা-মা বাস করতেন হারারেতে। ২০০৭ সালে জিম্বাবুয়েতে তাঁর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক হয়। এভাবেই তিনি ক্রিকেটার হয়ে যান।

জিম্বাবুয়ের ঘরোয়া ক্রিকেটে আস্তে আস্তে নিজের উপস্থিতি জানান দিতে শুরু করেন, সেটাও গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর। জিম্বাবুয়ের বোর্ড সভাপতি একাদশ সুযোগ পেয়ে যান বাংলাদেশের বিপক্ষে। ২০১১ সালের সেই ম্যাচে করে ফেলেন সেঞ্চুরি। যদিও, ভুসিমুজি সিবান্দা ইনজুরিতে না থাকলে সেই ম্যাচটা খেলাই হয় না রাজার। তারপর আরও কিছু ভাল ইনিংস উপহার দেন জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটের এই ‘পাকিস্তানি’।

জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট (জেডসি) বুঝতে পারে, সিকান্দার রাজাকে তাঁদের দরকার। ‘বিদেশি’ করে রাখা যাবে না তাঁকে, সিদ্ধান্ত নেয় জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট। এরপর রাজাকে আর কিছু করতে হয়নি। তার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজ, অনুমতি সবই জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট বোর্ড নিজেই ব্যবস্থা করে দেয়।

অপেক্ষার অবসান হয় ২০১৩ সালে। সেবার জিম্বাবুয়ের জার্সিতে হয়ে বাংলাদেশের বিপক্ষে অভিষেক করিয়ে দেয়। চার মাস বাদে তাঁর টেস্ট অভিষেকটা আবার সেই পাকিস্তানের বিপক্ষেই। বাকিটাতো রাজার ‘অ্যালেকজান্ডার’ হয়ে ওঠার ইতিহাস।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...