একটা নির্দিষ্ট দশকের সেলেকাও বললে ব্যাপারটা একতরফা হয়ে দাঁড়াবে। তাই পুরোটা বলাই সমীচীন। এই যুগে যেখানে কোঅর্ডিনেশন ফুটবল অস্তাচলে চলে যাওয়ার মতলব করছে, সেই রক্তাক্ত সময়ে দাঁড়িয়ে লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে বড় টুর্নামেন্ট ক্ষতের মলম তৈরি করছে। গোটা ইউরোপ জুড়ে ফুটবলের দামামা বেজেছে। ইউরো কাপে যখন মেক্সিকান ওয়েভে, কান ফাটানো চিৎকারে আবেগ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে, তখন অপর মহাদেশের ফুটবল টুর্নামেন্টটি তুলনায় অতীব শান্ত।
ইউরো কাপে যখন রোনালদো, লুকাকু, ইমমোবাইলরা গর্জে উঠছেন, গোল করেই সাইডলাইনের অ্যাডভার্টাইস বোর্ড টপকে সরাসরি চলে যাচ্ছেন দর্শকদের কাছে, সেখানে দর্শকহীন কানা স্টেডিয়ামে পিন পড়া নিস্তব্ধতা। লিও টলস্টয় বোধহয় এদের জন্যই লিখেছিলেন – ওয়ার অ্যান্ড পিস!
অথচ সেই নিঝুম অন্ধকার ভরা রাতে মায়ের ঘুমপাড়ানি গানের মতো অদ্ভুত প্রশান্তি নিয়ে আসছে ব্রাজিল। এই কোপাতে তারা রেখে যাচ্ছে একটা বিশ্বাস, সাম্বার বিশ্বাস। কোচ তিতেকে এতটা পরিণত গত বিশ্বকাপেও লাগেনি, যেভাবে দলটাকে আগলে এতটা কণ্টকাকীর্ণ পথ পেরিয়ে এলেন। আসলে এই ব্রাজিল টিমে প্রতিভার প্রাচুর্য দেখে তাকে লালন করার মোক্ষম শিক্ষাটি তিতে অলরেডি অর্জন করে ফেলেছেন।
ফলত একেবারে সামনে রিচার্লিয়েসনের মতো ফরোয়ার্ড কখনও ডানদিকে, কখনও বাঁদিকে আবার কখনও একটু নিচ থেকে অপারেট করেই চলেছে। সঙ্গে ডানদিকে একটু পাশ থেকে অর্থাৎ কার্যত উইং থেকে খেলছে গ্যাব্রিয়েল জেসুস, মাঝে হোল্ডিং এবং প্রেসিংয়ে রয়েইছে কাসেমিরো। ডিফেন্সে সেন্টারব্যাক দুটিকে নিয়ে সমস্যা না হলেও, দুই সাইডব্যাক শুরুতে একটু নড়বড়ে ছিল।
আর তাই বাঁদিকে এই টুর্নামেন্টের শুরুতে মিলিতাও থাকলেও পরে সেই জায়গা অপারেট করতে শুরু করেন রেনেতো লোদী। সঙ্গে ভরসা যোগানো সেন্টারব্যাক মার্কুইনহোস। গোলে টুর্নামেন্টের শুরুতে অ্যালিসন খেললেও, নকআউট ম্যাচ থেকে তিতে বহুদিন পর ভরসা করছেন এডারসনকে। রেজাল্ট হিসেবে সেমিফাইনালে পেরুর দুটো অব্যর্থ শট বাঁচিয়ে শেষ প্রহরীর ভূমিকা পালন করছে এডারসন।
পরিবর্ত হিসেবে গোল করার লোক রয়েছে, গ্যাব্রিয়েল বারবোসা এবং রবার্তো ফিরমিনো। আদতে দু’জনেই অফফর্মে, কিন্তু একটু স্পেস পেলে ট্যাপিংয়ে গোল করার অভ্যাস সেই অ্যানফিল্ড থেকেই রয়েছে ফিরমিনোর। বারবোসা আনকোরা, তবে প্রতিশ্রুতিমান এতে সন্দেহ নেই।
আর এই সবকিছুর মধ্যভাগে রয়েছে দুই বাউল। একজন বেলফুলের গন্ধ নিয়ে এসে তার সুবাসে মোহিত করছে রিও ডি জেনিরোকে, আরেকজনের সৌন্দর্য ছাড়াও রয়েছে যুদ্ধ করার এক আলাদা মানসিকতা। দু’জনেই এই টিমের লাস্ট অফ দ্য মোহিকান্স। নেইমার যেমন কখনও মাঝখান থেকে উঠে এসে হঠাৎ ছোট্ট ব্যাকহিলে গান শুনিয়ে যাচ্ছে, তখন ওভারল্যাপে রেনেতো লোদি বা দানিলো উঠে গেলে নিচে একা অতন্দ্র প্রহরীর মতো আগলে দাঁড়িয়ে রয়েছে থিয়াগো সিলভা।
থিয়াগো সিলভা লুসিওর উত্তরসূরি। থিয়াগো সিলভা কর্নার থেকে হেডে গোল করে, আবার দৌড়ে নিচে চলে আসে বিপক্ষের প্রতি আক্রমণ ঠেকাতে। এই আক্রমণ-প্রতি-আক্রমণের অসম লড়াইয়ে একা কুম্ভ হয়ে নিজের ডিফেন্সে প্রতিরোধের একটা অদৃশ্য দেওয়াল গড়ে তোলে থিয়াগো সিলভা। সেখান থেকে বল ফেরত যায় নেইমারের কাছে। আর ওর পায়ে বল পড়া মাত্র সুমনের গান শুনতে ইচ্ছে করে – ‘তোমাকে দেখেছি ল্যাম্পপোস্টের নিচে, তোমাকে দেখেছি কালীঘাট ব্রিজে একা…’
একসঙ্গে দু’জনে খেললেই মাঠে অনবরত চোখ ঘুরবে কিছু খুঁজে পাওয়ার আশায়। ব্রাজিলের জার্সিতে, পিএসজিতেও তাই। আগের মরসুমে ল্যাম্পার্ডের ডাক থিয়াগোকে নিয়ে ফেলল পুরোনো লণ্ডনের স্ট্যানফোর্ড ব্রিজের পাশে। মাঝপথে টুখেল এসে চেলসির এক্সপ্রেস দুর্বার গতিতে এগিয়ে নিয়ে গেলেন, যার মধ্যমণি ছিল কোভাকিচ, পুলিসিচ, অ্যাসপিজিকুয়েতা-রুডিগার, কন্তে এবং এই থিয়াগো সিলভা।
উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালের তিন মিনিটের মাথায় চোট যার স্বপ্ন কেড়ে নেওয়ার মতলব এঁটেছিল, সেই পোর্তোর মাঠ এবার আর খালি হাতে ফেরায়নি। থিয়াগো সিলভার ট্যাকলে থাকে না কোনও মালদিনিসম শিল্পত্বের ছোঁয়া, স্লাইডিং ট্যাকেল হোক বা বল কেড়ে নেওয়ার জন্য লড়াই – দেখে কখনও আহা, উহুটা আসে না। মনে হয় এটাই তো একজন ফুলব্যাকের কাজ। অথচ আরও গভীরে ঢুকলে দেখা যায়, সেখানে প্রেম আছে। সব কিছুকে আগলে রাখার তীব্র বাসনা। থিয়াগো সিলভার মতো করে তো সবাই পারে না আগলে রাখতে।
এই দুই স্তম্ভের কাঁধে ভর করে আজ ব্রাজিল কোপার ফাইনালে। পেরুকে খাতায়-কলমে এক গোলে পরাস্ত করলেও, যারা ম্যাচটা দেখেছেন তারা জানেন ব্রাজিল আজ মাঠে ছবি আঁকছিল। নেইমারের ডান পাটা উল্কিতে এবং অবিশ্বাস্য প্রতিভায় ভরা। শুধু ওর জন্য ভোরে উঠে চা খেতে খেতে আরামে খেলাটা দেখা যায়। দুটো ডিফেন্ডারকে উইং দিয়ে টাচলাইন অব্দি টেনে এনে ছোট্ট নাটমেগ করে বাঁ পায়ে যে মাইনাসটা লুকাস পাকুয়েতাকে করল, ওটার জন্য একছুট প্রেমিকার বাড়িতে গিয়ে বলে আসতে হয়, ‘আমি তোমাকে ভালবাসি। ভীষণ ভালবাসি।’
ব্রাজিল ফাইনালে জিতুক বা হারুক, আসলে এই ব্রাজিলকে ঠিক জেতা-হারার যান্ত্রিক প্যারাডাইমে ফেলে দিতে মন চাইছে না। নেইমারের শিল্পীসুলভ ছোঁয়া, লুকাস পাকুয়েতার অসম্ভব ভাল বল কন্ট্রোল, কাসেমিরোর পাসিং আর থিয়াগো সিলভার ব্যাকিং সেটা ভাবতে দিচ্ছে না। এই ব্রাজিল ফুটবল খেলছে, সেলেকাওদের প্রতীক হয়ে, সাম্বা ঘরানার বাহক হয়ে। কিছু কিছু কথা বলা উচিত নয়, ওতে ছন্দপতন ঘটে। এক এক সময় শব্দহীন হয়ে শুধু চেয়ে দেখে যেতে হয়।
শিল্প জিনিসটা নিস্তব্ধতার থেকেও আরও বেশি নিস্তব্ধ!