অভিনব অ্যাকশনের অনন্য অপচয়

অভিনব বোলিং অ্যাকশনের কারণে ক্রিকেট দুনিয়ায় আলাদাভাবে পরিচিতি পেয়েছিলেন পাকিস্তানের বাঁ-হাতি  পেসার সোহেল তানভির। ক্যারিয়ায়ের শুরুতে তাঁর ‘রঙ ফুটেড’ অ্যাকশনের কারণে অনেক ব্যাটারই সমস্যায় পড়তেন। যার কারণে এই অদ্ভুত বোলিং স্টাইলের কারণেই ক্যারিয়ারের শুরুতে বেশ সফল হয়েছিলেন সোহেল তানভির। ইনিংসের শুরুর দিকে দারুন স্যুইং আর বাউন্স জেনারেট করতে পারতেন তিনি। ডেথ ওভারে ইয়র্কার আর স্লোয়ারই ছিল অন্যতম ভরসা।

২০০৪ সালে পেশোয়ারের বিপক্ষে রাওয়ালপিন্ডিতে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক। ক্যারিয়ারের প্রথম দুই ম্যাচেই তিন উইকেট করে শিকার করেন তিনি। দ্বিতীয় ম্যাচে ৩ উইকেটের পাশাপাশি ব্যাট হাতে ৯৭ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলেন তিনি। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে অসাধারণ খেলেছিলেন  তিনি। বাঁ-হাতি পেস বোলিংয়ের পাশাপাশি লোয়ার অর্ডারে হার্ড হিটার ব্যাটার হিসেবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তিনি। তবে ক্যারিয়ার যত এগিয়েছে ব্যাটের সেই ধারটাও কমে যায়। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেকের তিন বছরের মাথায় পাকিস্তান অ্যাকাডেমির হয়ে বাংলাদেশ সফরে আসেন তানভির।

সেখানেও অলরাউন্ড নৈপুণ্য দেখিয়ে জায়গা করে নেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজে পাকিস্তান ‘এ’ দলে। তখন থেকেই তানভির নজরে ছিলেন নির্বাচকদের। তাঁর অদ্ভুত বোলিং স্টাইল, স্যুইং, স্লোয়ার সবকিছুই বিশেষভাবে দৃষ্টি কাড়ে নির্বাচকদের।

আর সেখান থেকেই কপাল খুলে যায় তানভিরের। ২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের স্কোয়াড ঘোষণা করা হলো। স্কোয়াড ঘোষণার পরই হঠাৎ হাঁটুর ইনজুরিতে ছিটকে যায় পেসার শোয়েব আক্তার। বিশ্বকাপের আগমুহূর্তে শোয়েব আখতারের ইনজুরি যেন কাল হয়ে দাঁড়ায় পাকিস্তানের জন্য। তখনি নির্বাচকদের নজরে থাকা তানভিরকে ডাকা হল স্কোয়াডে। ‘এ’ দলের হয়ে এবং ঘরোয়া ক্রিকেটে তখনকার সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সে মুগ্ধ হয়েই তানভিরকে দলে নিতে আগ্রহী হয় টিম ম্যানেজমেন্ট।

২০০৭ বিশ্বকাপে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক। পুরো টুর্নামেন্টেই দুর্দান্ত বোলিং করেন তিনি। ৬ ম্যাচে মাত্র ৭ ইকোনমিতে ৬ উইকেট শিকার করেন তানভির। ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে প্রথমবার ব্যাটিংয়ের সুযোগ পান তিনি। আর সুযোগ পেয়েই গড়েন অনন্য এক কীর্তি। ক্যারিয়ারের প্রথম বলেই হাঁকান ছক্কা! টি-টোয়েন্টি ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম ব্যাটার হিসেবে অভিষেকে প্রথম বলেই ছক্কা হাঁকানোর কীর্তি গড়েন তিনি।

ফাইনালে জয়ের জন্য পাকিস্তানের শেষ ৩ ওভারে দরকার ছিল ৩৫ রান, হাতে ৩ উইকেট। ভারতীয় পেসার শ্রীশান্তের করা ১৮ তম ওভারের প্রথম তিন বলেই ২ ছক্কা হাঁকান তানভির। তবে চতুর্থ বলে বোল্ড হয়ে ফেরেন তিনি। ওই ম্যাচে মাত্র ৫ রানে হেরে শিরোপা জয়ের স্বপ্নভঙ্গ হয় পাকিস্তানের।

ওই বছরই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষিক্ত হন তিনি এবং পরের সিরিজেই ভারতের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক! অভিষেক টেস্টে তানভির শিকার করেন ৩ উইকেট। টেস্ট ক্যারিয়ারের মেইডেন উইকেটটি ছিল ক্রিকেটের ‘দ্যা ওয়াল’ খ্যাত রাহুল দ্রাবিড়ের। আর ওই উইকেটটিকেই ক্যারিয়ারের সেরা ডেলিভারি মানে তানভীর।

টেস্ট অভিষেকটাও যে হয়েছিল হুট করে। ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে দলে ছিলেন। সেখান থেকে উমর গুলের ইনজুরিতে জায়গা পান টেস্ট দলে। এরপর বল করতে এসে উইকেট তুলে নেন দ্রাবিড়ের। লেগ স্টাম্পে পিচ করা বল দুর্দান্ত এক স্যুইংয়ে রাহুল দ্রাবিড়ের অফ স্টাম্পে আঘাত হানে! আর তানভির শিকার করেন মেইডেন টেস্ট উইকেট।

ওয়াসিম আকরাম একবার দ্রাবিড়কে এই একই লেন্থেই আউট করেছিলেন। সেই থেকেই তানভিরের স্বপ্ন ছিল এমন একটা বলে উইকেট নেওয়া। আর স্বপ্ন পূরণ হল নিজের অভিষেকে টেস্টেই। নিজের ড্রিম ডেলিভারিতেই শিকার করেন মেইডেন উইকেট।

২ টেস্টে ৫ উইকেট শিকারের পর টেস্ট দল থেকে বাদ পড়লেন। সেই যে সাদা জার্সি খুলেছেন; আর গায়ে জড়াতে পারেননি সেটি! ক্যারিয়ারে আর টেস্ট খেলার সুযোগই যে তিনি পাননি। পরের বছর ২০০৮ সালে এশিয়া কাপে সুযোগ পান। আর হংকংয়ের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচেই ব্যাট হাতে অষ্টম উইকেটে ফাওয়াদ আলমের সাথে শতরানের জুটি গড়েন তানভীর। ওই ম্যাচেই মেইডেন ফিফটির দেখা পান তিনি। পরের ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মেইডেন ফাইফর শিকার করেন এই পেসার। ১০ ওভারে ৪৮ রানে ৫ উইকেট নেন তানভীর।

ওই বছরই ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) উদ্বোধনী আসরে রাজস্থান রয়্যালসের হয়ে খেলার সুযোগ পান তানভির। চেন্নাই সুপার কিংসের বিপক্ষে দুর্দান্ত এক স্পেলে মাত্র ১৪ রানে ৬ উইকেট শিকার করেন তিনি। সেবার উদ্ভোধনী আসরে ১১ ম্যাচে ২২ উইকেট শিকার করে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি হন তানভীর। ফাইনালে শেন ওয়ার্নের সাথে ২১ রানের জুটির পথে তানভিরের ব্যাটে উইনিং রানে শিরোপা জয় করে রাজস্থান। সেবার আইপিএলের দ্বিতীয় মোস্ট ভ্যালুয়েবল প্লেয়ার নির্বাচিত হন তানভির। ইএসপিএন ক্রিকইনফোর সেরা আইপিএল একাদশের পাশাপাশি সেবার তিনি জায়গা করে নেন বিশ্বসেরা ওয়ানডে একাদশেও।

পরের বছর ২০০৯ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পাকিস্তান দলে জায়গা পান তিনি। সেবার প্রথমবার শিরোপা ঘরে তোলে পাকিস্তান। তবে পুরো টুর্নামেন্টে মাত্র দু’ম্যাচ খেলার সুযোগ হয় তানভিরের। ওই ২ ম্যাচে ৫ ওভার বোলিং করে ৩৯ রান দিয়ে উইকেট শূন্য থাকেন তিনি। বিশ্বকাপের পরই হাঁটুর ইনজুরিতে দল থেকে ছিটকে যান তানভীর। এক বছর ছিলেন দলের বাইরে! এক বছর বাদে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ফিরলেও ফিটনেস ইস্যুতে সিরিজের আগ মূহুর্তে আবার ছিটকে যান তিনি!

২০১১ ওয়ানডে বিশ্বকাপের স্কোয়াডেও জায়গা পান তিনি। কিন্তু শেষ মূহুর্তে হাঁটুর সেই ইনজুরিতে ছিটকে যান দল থেকে। পরের তিন বছর দলে আসা যাওয়ার মধ্যে খুব বেশি ম্যাচ খেলতে পারেননি। ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে তিন ওয়ানডেতে মাত্র ১ উইকেট শিকারের পর দল থেকে বাদ পড়েন তিনি! এরপর তরুন পেসারদের ভিড়ে নিজের জায়গা মেলাতে পারেননি ওয়ানডে দলে।

ওয়ানডে দল থেকে বাদ পড়লেও টি-টোয়েন্টি খেলছিলেন নিয়মিতই। ২০১৩ সালে ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বেশি টি-টোয়েন্টি (১০) খেলার সুযোগ পান তিনি। এরপরই ধীরে ধীরে যত বছর গড়িয়েছে ম্যাচের সংখ্যাও কমে আসে তানভিরের ক্যারিয়ারে। গড়ে ৪-৫ টা করে ম্যাচ খেলতে পারছিলেন বছরে। দলের অনেকটাই অনিয়মিত এক মুখ ছিলেন তিনি। অধারাবাহিকও বলা চলে। খারাপ করলেই বাদ পড়তেন! কখনোই লম্বা সময় সুযোগ পেতেন না নিজেকে প্রমাণের। অবশ্য প্রতিদ্বন্দ্বীও তখন দলে কম ছিল না।

সব মিলিয়ে ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তানভিরের সময়টা ফুরিয়ে যায়। বলতে গেলে কেউ ইনজুরিতে পড়লেই নির্বাচকদের স্মরণ হত তাঁকে।সর্বশেষ ২০১৭ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজে সুযোগ পান তিনি। তিন ম্যাচে সুযোগ পেলেও বল হাতে ছিলেন সাদামাটা। ওই সিরিজ শেষে দল থেকে বাদ পড়লেন! আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরতে পারেননি তিনি।

টেস্টে সুযোগ পাননি বলে আক্ষেপটা তো রয়েছেই। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয় আমি টেস্ট ক্রিকেটে আরও অনেক কিছু দিতে পারতাম। মানুষ আমাকে টি-টোয়েন্টি স্পেশালিষ্ট ও হোয়াইট বল ক্রিকেটার ডাকে। কিন্তু কেউ আমার শক্তিমত্তা সম্পর্কে জানে না। তারা জানে না আমি টেস্টেও কতটা সক্ষম। যদি ঘরোয়া ক্রিকেটের পরিসংখ্যান দেখেন বা তাদের জিজ্ঞেস করেন তাহলে আপনি জানতে পারবেন। আমার দূর্ভাগ্য যে আমি খুব বেশি সুযোগ পাইনি।’

ফ্র‍্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল), ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (সিপিএল), ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল), পাকিস্তান সুপার লিগ (পিএসএল) সহ কাউন্টি ক্রিকেট ও বিভিন্ন ঘরোয়া ক্রিকেট টুর্নামেন্টে তিনি খেলেছেন। প্রথম হোয়াইট বল ক্রিকেটার এবং পরবর্তীতে টি-টোয়েন্টি স্পেশালিষ্ট হিসেবেই আখ্যা পান তানভির। তবে নিজের নামের পাশে টি-টোয়েন্টি স্পেশালিষ্ট তকমায় খুশি নন তিনি।

আইপিএলে যে গুটিকয়েক পাকিস্তানি ক্রিকেটার খেলেছেন, তাঁদের মধ্যে সোহেল তানভিরই ছিলেন পারফরম্যান্সের দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে। মাত্র ১১ ম্যাচে নেন ২২ উইকেট, জেতেন আসরের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারীর বেগুনি টুপি। আইপিএলের প্রথম আসরে তাঁর পারফরম্যান্সের সুবাদেই শিরোপা জেতে রাজস্থান রয়্যালস।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকটাও ইনজুরির কারণে! টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি দুই ফরম্যাটেই সুযোগ পেয়েছিলেন কারো না কারো ইনজুরিতে। এরপর নিজের হাঁটুর ইনজুরিতে হয়ে যান অনিয়মিত আর অধারাবাহিক। আর ক্যারিয়ারের শেষ বেলায় অনন্য এক অপচয় – ইনজুরিটা না হলে নির্ঘাত চলে যেতেন কিংবদন্তিদের কাতারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link