তিনি হতে পারতেন বিশ্বসেরা

২০১০ এ পড়েছিলেন হাঁটুর ইনজুরিতে। সেটা পুরোপুরি সেরে না উঠেই চলে যান বিশ্বকাপ খেলতে। হয়ত এটাই ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল সীদ্ধান্ত। দুঙ্গার ব্রাজিলের প্রাণভোমরা ছিলেন কাকা, তাই না যেয়েও পারেননি। বিশ্বকাপ শেষে মাঠ থেকে ছিটকে যান আট মাসের জন্য। এরপর মাঠে ফিরেন ঠিকই – কিন্তু সত্যিকার কাকাকে আর দেখা যায়নি কখনো।

‘আমি জানিনা আমার সেরা ফর্ম আবার ফিরে আসবে কিনা, কিন্তু সেটা ফিরে পাবার আশাই আমার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা’- উজ্জ্বল ফুটবল ক্যারিয়ারে কাকার অন্ধকার সময়ের কথা এটি। নিজেকে বারবার ফিরে পাবার আকাঙখা কাকাকে টেনে নিয়ে এসেছে এ পর্যন্ত।

২০১০ এ পড়েছিলেন হাঁটুর ইনজুরিতে। সেটা পুরোপুরি সেরে না উঠেই চলে যান বিশ্বকাপ খেলতে। হয়ত এটাই ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল সীদ্ধান্ত। দুঙ্গার ব্রাজিলের প্রাণভোমরা ছিলেন কাকা, তাই না যেয়েও পারেননি। বিশ্বকাপ শেষে মাঠ থেকে ছিটকে যান আট মাসের জন্য। এরপর মাঠে ফিরেন ঠিকই – কিন্তু সত্যিকার কাকাকে আর দেখা যায়নি কখনো।

ব্রাজিলের পাশাপাশি খেলেছেন মোট চারটা ক্লাবের হয়ে, তবে এক দেশের দুইটা ক্লাবে কখনো খেলেননি। সাউ পাওলোতে প্রফেশনাল ফুটবল শুরু করেন, সেখানে থেকে যান মিলান জায়ান্ট এসি মিলানে। এরপর আসেন রাজকীয় মাদ্রিদে। তারপর আবার ফিরে আসেন এসি মিলানে, সেখান থেকে আবার সাউ পাউলো হয়ে এম,এল,এস, ক্লাব অরলান্দো সিটিতে শেষ করেন প্রফেশনাল ফুটবল ক্যারিয়ার।

সাবেক সতীর্থ রোনালদিনহো কিংবা রোনালদোদের মতো চিরাচরিত সাম্বা স্কিল ছিলনা পায়ে। কিন্তু কাকা নিজের স্টাইলেই ছিলেন একই পরিমাণ বিদ্ধংসি এবং কার্যকরী।

বল পায়ে কাকার মুভমেন্টে ছিল রাজকীয় ভাব। উচ্চতায় ছয় ফুট লম্বা কাকার বিশেষত্ব ছিল তার গতি। যখন বল দখলে থাকতো, কাকার জন্য তখন একটু খালি জায়গা ছিল প্রতিপক্ষের জন্য ভয়ের কারণ। কাকার গতি উঠানোর মতো স্পেস থাকলে মুহুর্তেই গুড়িয়ে দিতে পারতো যেকোন রক্ষণ।

‘কাকাকে মার্ক করা ছিল সবচেয়ে কঠিণ কাজ। বল পায়ে তার মুভমেন্ট পার্থক্য গড়ে দিতে পারত। ওর বিপক্ষে ডিফেন্ড করার সময় আপনি বুঝতেই পারবেন না আপনার কি করা উচিত।’ – ২০১৩ সালে ফ্রেঞ্চ ম্যাগাজিন এল ইকুইপকে দেয়া সাক্ষাতকারে বলেছিলেন হাভিয়ের জেনেত্তি।

এটাই সত্যিকার কাকা! পূর্ণ উদ্দামে থাকা অবস্থায় এতটা ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যেত, ওর গতির সামনে প্রতিপক্ষ কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে যেত। পায়ে মোহনিয় স্টেপ ওভার কিংবা প্রতিপক্ষকে বোকা বানানোর জন্য কোন শো বোটিং ছিলনা, কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত টার্ন, মাথার উপর দিয়ে বল নিয়ে যাওয়া, নাটমেগ, ক্রিয়েটিভ পাস – এইসবই ছিল তার দখলে। শারিরীকভাবে শক্তিশালী, গতি এবং দুর্দান্ত ক্লোজ কন্ট্রোলের সাথে যুক্ত ছিল তার পাসিং এবং প্লেমেকিং স্কিল।

এসি মিলানের প্রথম দিকে খেলেছেন দুইজন স্ট্রাইকারের পিছনে। তখন কাকার মূল কাজ ছিল বল বানিয়ে দেয়া। কাকার থ্রু পাস গুলো ছিল একেবারে সুক্ষ্ম। ২০০৫ চ্যাম্পিয়ন্স লীগ ফাইনালে লিভারপুলের বিপক্ষে প্রথমার্ধে কাকা একাই প্রতিপক্ষকে নাকানিচুবানি খাইয়ে ছিলেন। তার প্রায় প্রতিটা আক্রমনই যেন এসি মিলানের গোলের সুযোগ তৈরি করছিল। মাঝমাঠ ছিল ২৩ বছর বয়সী কাকার দখলে, ফলস্রুতিতে প্রথমার্ধেই মিলান এগিয়ে গিয়েছিল ৩-০ তে। যদিও ইস্তাম্বুলের সেইরাতে দুর্ভাগা মিলান ম্যাচটি হারে টাইব্রেকারে।

কাকার জন্য নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল গতিতে প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করে প্রায় ২০/৩০ ফুট ড্রিবল করা, এরপর সঠিক জায়গায় সতীর্থকে খুজে নেয়া। অন্যসময় নিজের অফ দ্যা বল মুভমেন্টেও রক্ষণ ভেঙ্গে দিতেন সহজে। এই সব মিলে জিদান পরবর্তি সময়ে কার্যকরী এটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে নিজেকে তৈরি করেছিলেন কাকা। সেই সাথে তার অসাধারণ ফিনিশিং স্কিল, দূর পাল্লার বাঁকানো শট কিংবা সলো ড্রিবলে মাঝমাঠ থেকে টেনে নিয়ে গোল – কাকা ছিল একটা পারফেক্ট প্যাকেজ।

‘তার সবই আছে – চমৎকার কৌশল, গতি, ভিশন, অসাধারণ পাসিং এবং গোল করার ক্ষমতা। চেলসিতে খেললে আপনাকে সেরাদের পক্ষে বিপক্ষে খেলতে হবে, কিন্তু কাকা হচ্ছে একমাত্র প্লেয়ার যার খেলা দেখতে আমি টাকা খরচ করতে রাজি।’ – ২০০৯ এ একটি সাক্ষাতকারে বলেছিলেন ল্যাম্পার্ড।

কেউ যখন সেরা ফুটবলটাই খেলেন একমাত্র তখনি ল্যাম্পার্ডের মত কেউ এমন মন্তব্য করতে পারেন।

কাকার কথা উঠলেই ব্রাজিল ফ্যানদের মনে দুইটি দৃশ্য ভেসে উঠে। প্রথমটা হচ্ছে ২০০৬ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের প্রথম ম্যাচে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে কাকার বাম পায়ের বাকানো শটে করা গোল। আরেকটি হচ্ছে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনার বিপক্ষে মাঝমাঠে থেকে বল নিয়ে ‘সলো’ ড্রিবলে করা গোলটা। সত্যিকার অর্থে কাকার করা সেরা গোল গুলাকে এই দুইটা ভাগেই ভাগ করা যায়।

ডান পা, বাঁ পা – দুপায়েই ছিল সমান দক্ষ। মাদ্রিদের সময়ে ইনজুরি এবং বয়সের কারণে গতি কমে যায়। কিন্তু গোল করার ক্ষেত্রে কাকার মান একটুও কমেনি। মাদ্রিদে কাকার একেবারে পরিচিত দৃশ্য ছিল ৩০ গজ দুর হতে বাকানো শটে গোল। ২০১৩ তে মিলানে ফিরেও সেই ধারা অব্যাহত রেখেছিলেন। তবে কাকার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গোল আসে অন্যভাবে।

২০০৭ এ চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনালে প্রথম লেগে ওল্ড ট্রেফোর্ডে কাকার এসি মিলান মুখোমুখি হয় ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের। সেদিনই আসলে নির্ধারণ হয় সে বছরের ব্যালন ডি অর এর দাবিদার কে। ম্যাচের শুরুতে রোনালদোর হেডে লিড নেয় ইউনাইটেড। এরপরই মঞ্চস্ত হয় কাকার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে ডিফাইনিং মুহুর্ত। ওই ম্যাচে কাকা করেন দুই গোল। প্রথম গোলটি ছিল চোখধাঁদানো। ম্যানচেস্টারের ডিফেন্স তখন গোছানোই ছিল।

দলও এগিয়ে এক গোলে। তবে কাকা, সিডর্ফ মিলে বারবার হানা দিচ্ছিল। গোলও আসে তাদের অসাধারণ বোঝাপড়ার ফলে। সিডর্ফ মধ্যমাঠের বাম পাশ থেকেকে যখন কাকার উদ্দেশ্যে পাসটা দেন তখনো কাকা প্রায় পঁয়ত্রিশ গজ দূরে গোলপোস্ট থেকে। কাকাকে মার্ক করছিলেন ক্যারিক।

সিডর্ফের বাড়ানো বল রিসিভ করতে গতি বাড়ান কাকা, ক্যারিককে পছনে ফেলেন এবং সামনে ব্লক করার জন্য অপেক্ষায় থাকা হেইঞ্জে কাকার গতি এবং শক্তির কাছে পরাস্ত হন। এরপর দুরুহ কোণ থেকে বাম পাঁয়ের দুর্দান্ত ফিনিশিং টাচে গোলকিপার ভ্যান ডার সারের সামনে দিয়ে মাটি কামড়ে বল খোঁজে নেয় জাল। তবে দ্বিতীয় গোলটা ছিল সবচেয়ে স্মরণীয়। গাব্রিয়েল হেইঞ্জে আর পেট্রিক এভরাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে কাকা করেন তার ক্যারিয়ারের সেরা গোল।

এক, মিলান কিপার দিদার গোলকিকে বল আসে একেবারে ইউনাইটেড এর ডিবক্সের মুখে। বাতাসে ভাসা অবস্থায় কাকা দৌড় শুরু করেন।

দুই, মাথা দিয়ে সুক্ষ্ম ছোঁয়ায় বল রিসিভ করার আগে ফ্লেচারকে পরাস্ত করেন ডুয়েল ব্যাটেলে।

তিন, সামনে আসতে থাকা হেইঞ্জের মাথার উপর দিয়ে বল নিয়ে যান। হেইঞ্জেও পরাস্ত।

চার, এরপর অনেকটা পাগলের মত ছুটে আসেন এভরা কাকাকে থামাতে। বলের অবস্থান বুঝতে ভুল করায় এভরা লাফ দেন কাকাকে থামাতে। কাকার পিছনে তখনো ছিলেন হেইঞ্জে।

পাঁচ, ঠান্ডা মাথায় কাকা বলটাকে মাথা দিয়েই টুকা দিয়ে বের করে নেন – এভরা গিয়ে পড়েন হেইঞ্জের গায়ে। লন্ডভন্ড ইউনাইটেড ডিফেন্সের শেষ বাধা ছিল ভ্যান ডার সার যিনি কাকার গোলের মাঝে কোন বাঁধা হয়ে দাড়াতে পারেননি।

ওল্ড ট্রাফোর্ড সাক্ষী হলো একজন অসাধারণ ফুটবলারের কিংবদন্তি হওয়ার দৃশ্য। দ্বিতীয় লেগে বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যায় সানসিরোকে কাকা উপহার দেন আরেকটি মোহনিয় মুহুর্ত। আগের লেগের দুইটা ব্রিলিয়্যান্ট গোলের পর এবার যুক্ত হয় বাঁ পায়ের দুর্দান্ত ভলি। সানসিরোতে উচ্ছাসের বাঁধ ভেঙ্গে যায়। কাকা স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে দুহাত উচিয়ে ধরেন সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে।

ফুটবল রোমান্টিকদের জন্য বাঁধিয়ে রাখার মত দৃশ্য ছিল সেই রাতে কাকার উদযাপন। সেদিন কাকার অদম্য ছুটে চলা দেখে মনে হচ্ছিল সে কোন অভিযাত্রায় আছে। ২০০৫ এর মতো আর ভুল করা যাবেনা। শেষ পর্যন্ত কোন ভুল হয়নি, ফাইনালে সেই লিভারপুলকে হারিয়েই তুলে ধরেন আরাধ্য চ্যাম্পিয়ন্স লীগ ট্রফি। সাথে সেবছর জিতে নেনে যাবতীয় যত ব্যাক্তিগত পুরষ্কার। সিরি আ থেকে কাকাই শেষ কোন ব্যালন ডি অর বিজয়ী খেলোয়াড়। এমনকি ব্রাজিলের ক্ষেত্রেও তাই।

জাতীয় দলে কাকার সবচেয়ে বড় অর্জন বিশ্বকাপ। কিন্তু তার অবদানে ব্রাজিলের বড় সাফল্য আসে কনফেডারেশন কাপে। ২০০৫ এবং ২০০৯ এ টানা দুইবার জিতে নেন এই ট্রফিটি। ২০০৯ এর কনফেডারেশন কাপে ছিলেন সেরা খেলোয়াড়। সেবার ফাইনালে ২-০ গোলে পিছিয়ে থেকেও তার অনুপ্রেরণায় শেষ পর্যন্ত ব্রাজিল জেতে ৩-২ ব্যাবধানে। এছাড়া ২০১০ বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে কাকা ছিলেন ব্রাজিলের প্রধাণ খেলোয়াড়।

ফ্যাবিয়ানো’র রবিনহোকে সাথে নিয়ে ব্রাজিলকে সাউথ আমেরিকা কোয়ালিফায়ারে এক নাম্বারে রেখে বিশ্বকাপে যায় কাকা। তবে বিশ্বকাপের গল্পটা শেষ পর্যন্ত সুখকর ছিলনা। টুর্নামেন্টের বড় তারকা হিসেবে খেলতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত ন্যাদারল্যান্দের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে হেরে বিদায় নেয় ব্রাজিল। সেই ম্যাচের হাইলাইটস দেখলে যাকারোরই কাকার করা বাঁকানো শটটার জন্য আফসোস করবে। প্রায় গোল হয়েই যাচ্ছিল, এমন সময় ডাচ গোলকিপার সেটি শেষ মুহূর্তের ছোঁয়াই গোলবঞ্চিত করেন কাকাকে। আসলে এরপর কাকার ক্যারিয়ারের পুরাটাই ছিল আফসোসে ভরা।

ব্রাজিলের দরিদ্র পরিবার উঠে এসে বড় তারকা হওয়ার গল্প কাকার সাথে খাটেনি। বাবা ছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, মা ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা। ব্রাজিলের মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হলেও এটা কাকার গল্পের মাহাত্ম্য কমায়নি কোন অংশে। কাকার সবচেয়ে বড় গুণ ছিল পেশাদারিত্ব এবং একনিষ্ঠতা। ধর্মীয়ভাবে অনুগত কাকাকে সবসময় মিডিয়া দেখেছে হাসিমাখা ভদ্রলোক হিসেবে।

মিলানে যখন সাফল্যের চূড়ায় ছিলেন তখনো ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী। মাঠে চিত্তাকর্ষক প্রদর্শনীর পাশাপাশি মাঠের বাইরে কাকার সৌজন্যতা, সাথে তার মায়াবী চেহারা মিলে নিজেকে তৈরি করেছিল দর্শকদের সবচেয়ে পছন্দের ক্রীড়াব্যক্তিত্বে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কাকার অযুত ভক্তকূল। ফুটবলার হিসেবে সফল কাকার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় অর্জন বোধয় তার ভক্তদের ভালবাসা। এদিক থেকে হয়ত মেসি রোনালদোকেও টক্কর দিতে সক্ষম তিনি। তাই কাকার বিদায়টা হয়ত আরো সুন্দর হতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link