দুর্বিনীত স্পর্ধার নি:সংকোচ প্রকাশ

গ্যাবা টেস্ট।

প্রবল উত্তেজনায় কাঁপছে পুরো ক্রিকেট দুনিয়া। চতুর্থ ইনিংসে দৃশ্যত অসম্ভব এক স্কোর তাড়া করতে নেমেছে ভারত। এই টেস্ট ড্র করলেই বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফি ভারতের। তাই প্রাণ লড়িয়ে দিচ্ছেন ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা। এক প্রান্তে দাঁতে দাঁত চেফে উইকেটে টিকে আছেন চেতেশ্বর পুজারা; রান করাটা যেনো কোনো কাজের কথা নয়।

এই সময় উইকেটে এলেন তিনি। একটু দেখলেন। প্যাট কামিন্স তাকে লক্ষ্য করে একটা শর্ট বল করলেন। একটু ডাক করলেন। আবার শর্ট বল। এবার মুখের ভেতরে জিভটা নাড়াতে নাড়াতেই বিনা ভাবনায় পুল করে সেটাকে পাঠিয়ে দিলেন বাউন্ডারির ওপারে। কামিন্সের চোখে চোখ রেখে কী যেনো বললেন।

তার আচার আচরণে একটা শব্দই ফুটে উঠলো-পরোয়া করি না।

হ্যাঁ, তিনি ঋষাভ রাজেন্দ্র পান্ত। আজকের দিনের সবচেয়ে ভয়ডরহীন, পাত্তা না দেওয়া এবং স্পর্ধিত ব্যাটসম্যান সম্ভবত পান্ত।

তিনি নব্বই রানে দাড়িয়ে রিভার্স সুইপ করেন, দফায় দফায় নব্বইয়ের ঘরে আউট হয়েও আবার সেখানে ছক্কা মারেন, তিনি ম্যাচের পরিস্থিতি নিয়ে মাথা ঘামান না, তিনি বোলার বলে কাউকে সমীহ করেন না, তিনি উইকেটের গুন নিয়ে পড়ে থাকেন না; তিনি একটা কথাই জানেন-আক্রমণ।

পান্তকে আমি এই কালে ভিভ রিচার্ডস বা বীরেন্দ্র শেবাগের সাথে তুলনা করতে পছন্দ করি। যদিও তার ব্যাটিং আচরণ, ব্যাটিং পজিশন এবং উইকেটরক্ষনের কারণে লোকেরা তাকে অ্যাডাম গিলক্রিস্টের উত্তরসুরী বলতে চায়। কিন্তু আমি বলি এই নতুন শতাব্দীতে ক্রিস গেইল ছাড়া এতো বড় দুর্বিনীত ব্যাটসম্যান আর আসেনি।

পান্তের জীবনের গল্পই এই পাত্তা না দেওয়ার গল্প।

দিল্লি থেকে বাসে ৬ ঘন্টার পথ দূরের শহর রুরকিতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা পান্তের। বাবা ছিলেন একটা মটরসাইকেল শো রুমের ম্যানেজার। এক রুমের একটা ছোট্ট বাসায় থাকতেন। সেই রুমেই বাবা, মা, বোনের সাথে রাতে ঘুমাতের পান্ত।

সাধারণত গল্পগুলো হয় এরকম যে, মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেটি বাবা-মায়ের অনিচ্ছায় ক্রিকেটার হতে চায়। কিন্তু পান্তের ব্যাপারটা অন্যরকম। তার বাবা-মায়ের ভয়ানক স্বপ্ন-ছেলেকে ক্রিকেটার বানাবেন। ছেলেও খেলাটাকে ভালোবাসে। কিন্তু ছেলের আবার নজরটা বড়। তার চাই দামী দামী জিনিস, দামী কোচিং।

আট বছর বয়সে সে মাকে বললো, তার একটা এসজি ব্যাট চাই। একটা এসজি ব্যাটের দাম বাবার ১৫ দিনের বেতনের সমান! তারপরও জন্মদিনে ছেলেটি প্যাকেট খুলে আবিষ্কার করে ৮ হাজার টাকা দামের একটা ব্যাট।

রুরকিতে পান্তের ক্রিকেট চলছিলো। কিন্তু এতে সন্তুষ্ট নয় তাঁরা। দিল্লীতে ক্রিকেট শেখার প্রক্রিয়া শুরু হলো।

সারারাত ধরে ছেলেকে নিয়ে দিল্লীর পথে চলেন পান্তের মা। ছেলে রাতভর বাসে ঘুমায়। আর পনির পরোটা ভরা টিফিন বক্স, কফি বোঝাই ফ্লাস্ক এবং ক্রিকেট ব্যাগ সামলে পাশে জেগে বসে থাকেন মা। ভোর রাতে বাস পৌছে যায় দিল্লিতে। দু জনে গুরুদুয়ারাতে গিয়ে বাকীটা সময় একটু ঘুমিয়ে নেন। তারপর সনেট ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে তারক সিনহার কাছে শুরু হয় ট্রেনিং।

সিনহা বলেছিলেন, পান্ত যেনো সপরিবারে রাজস্থানে চলে যান। তাতে দিল্লির চেয়ে যুব দলে খেলাটা সোজা হবে। সেটা তার পরিবার পারেনি। আর পান্ত বলেছিলেন, ‘পারলে দিল্লীতেই পারবো।’

কালক্রমে পান্তের বাবা দিল্লিতে চলে আসার সিদ্ধান্ত নেন। আর এই সময় কোচ তারক সিনহা একটা ভয়াবহ কথা বলেন পান্তকে। তিনি বলেন যে, ক্রিকেটে বড় হতে চাইলে এই কিশোরকে তার হাত-চোখ সমন্বয় সর্বস্ব ব্যাটিং বদলে ফেলতে হবে। টেকনিক আমূল বদলাতে হবে।

পান্ত হতভম্ব হয়ে গেলেন। এই ‘হ্যান্ড আই কম্বিনেশন’ দিয়ে তিনি রানের স্রোত বইয়ে দিচ্ছেন। ক দিন আগেও স্কুল ক্রিকেটে ১০ ওভারের একটা টুর্নামেন্টে ১০ মস্যাচে ৮ ম্যাচেই সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন। তিনি কেনো টেকনিক বদলাবেন। তারক সিনহা জোর করলেন।

আবার রাত জাগা শুরু করলেন পান্ত। এবার রাগ জেগে শ্যাডো করেন, নতুন টেকনিকে ব্যাট করেন। কিন্তু রান আর পান না। মাঝে মাঝেই ক্রিকেট ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবেন পান্ত। তারক সিনহা বলেন, ‘আরেকটু ধৈর্য্য ধরো।’

অবশেষে ফল এলো। নতুন টেকনিকেই রান পাওয়া শুরু করলেন। তারক বললেন, ‘এবার আর তোকে কেউ আটকাতে পারবে না।’

আসলে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠলেন পান্ত।

বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে প্রথম আর্ন্তজাতিক দুনিয়া তার সম্পর্কে জানলো। এই বিশ্বকাপে ১৮ বলে ফিফটি করেছিলেন। টুর্নামেন্টে একটা সেঞ্চুরিসহ ২৬৭ রান করেছিলেন। যেদিন সেঞ্চুরি করেন, ওই দিনই আইপিএলে ১.৯ কোটি রূপীতে কিনে নেয় তাকে দিল্লী ডেয়ারডেভিলস।

এরপর পান্তের কেবলই সামনে পথচলা। ২০১৭ সালে তখনকার সবচেয়ে কমবয়সী ভারতীয় হিসেবে টি-টোয়েন্টি অভিষেক; পরে যে রেকর্ড ওয়াশিংটন সুন্দর ভেঙে দেন। ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টিতে পান্তকে নিয়ে কোনো কথা নেই। এই সীমিত ওভারের ক্রিকেটের জন্যই যেনো তিনি তৈরি হয়েছেন। তাই বলে টেস্ট?

হ্যা, পান্তের টেস্ট ক্যারিয়ার নিয়ে এই কয়েক মাস আগেও খুব বিতর্ক হয়েছে। যদিও এরই মধ্যে ৪৫.২৬ গড়ে ব্যাট করে ৩টি সেঞ্চুরি করে ফেলেছেন; সাথে ৬টি পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংস আছে। কিন্তু তাকে লড়তে হচ্ছিলো ঋদ্ধিমান সাহার ছায়ার সাথে। সাহাকে বলা হচ্ছে এই সময়ের সেরা উইকেটরক্ষক। আর পান্তের গ্লাভস থেকে অহরহ গলে পড়ে ক্যাচ। সেই সাথে তার ব্যাটিংটাই বড় বেশী মারমার কাট কাট। তাহলে পান্ত টেস্টে চলবেন কী করে?

২১ জন খেলোয়াড় যখন ম্যাচ বাঁচাতে ব্যস্ত, তখন এক পান্ত এসে কলার উচু করে বলেছেন-দেখি কী হয়েছে! এইটুকু ক্যারিয়ারে অনেকবারই বার নব্বইয়ের ঘরে আউট হয়েছেন। সেটা তাকে মনে করিয়ে দিলে এমন একটা ভাব করেন, তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। আবারও পরের ইনিংসে সেই নব্বইয়ে দাড়িয়ে রিভার্স সুইপ করেন।

পান্ত তার ক্যারিয়ারে কতদূর যাবেন, সেটা বলা মুশকিল। তবে এটা মেনে নিতেই হবে যে, ক্রিকেটে স্পর্ধার এক দারুণ প্রকাশ তিনি করে গেছেন।

এই স্পর্ধাই তাকে স্মরণীয় করে রাখবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link