আজকাল একটা যুক্তি খুব বেশি করে কানে আসে। বর্তমান বোর্ড প্রেসিডেন্ট ও সাবেক অধিনায়ক, সৌরভ গাঙ্গুলি নাকি একটা দীর্ঘ সময় শুধু অধিনায়ক কোটার জোরে খেলে গেছেন। সেই মন্তব্যের সারবত্তা কিছুটা কৌতূহল বশত: হঠাৎ পরখ করে দেখতে ইচ্ছা হল।
কিছু পরিসংখ্যান এবং নিজের চোখে দেখা কিছু ব্যাপার দিলাম। বাকি মতামত পাঠককুলের। আজকে প্রথম পর্ব। এবং পুরোটাই বিদেশে অধিনায়ক ও ব্যাটার সৌরভের বিশ্লেষণে নিয়োজিত হলো। পরে আরো দুটি পর্ব আসবে, যার একটি দেশের মাটিতে ও অপরটি বড়ো একদিনের টুর্নামেন্টে অধিনায়ক ও ব্যাটার সৌরভকে নিয়ে আলোচনা থাকবে।
একজন ভারত অধিনায়কের বর্তমানে সবচেয়ে বিশ্বস্ত দাঁড়িপাল্লা হলো, সেই অধিনায়কের শাসনকালে তিনি নিজে এবং তাঁর দল সেনা দেশগুলোতে ঠিক কেমন খেলেছে। সৌরভ অধিনায়ক থাকাকালীন ভারত একবার দক্ষিণ আফ্রিকা (২০০৩ বিশ্বকাপ বাদ দিয়ে), একবার ইংল্যান্ড, একবার অস্ট্রেলিয়া ও একবার নিউজিল্যান্ড সফর করেছে। এছাড়াও একবার ওয়েস্টইন্ডিজ সফর করেছে।
সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ লয়েড বা ভিভের প্রবল প্রতাপশালী না হলেও, সৌরভের উত্তরসূরিরা যে ওয়েস্টইন্ডিজকে পেয়েছেন তার চেয়ে একটু পদের তো বটে। এছাড়াও সৌরভের শাসনকালে ভারত একবার শ্রীলংকা, একবার পাকিস্তান, দু বার করে জিম্বাবুয়ে ও বাংলাদেশ সফর করেছেন। এবার এক এক করে দেখা যাক প্রতিটি সফরে সৌরভের নিজের ও দলের পরিসংখ্যান।
২০০১ এর দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে ভারতের আদতে তিনটি টেস্ট খেলার কথা থাকলেও, খেলা হয় দুটি। মাইক ডেনিসের কল্যানে তৃতীয় টেস্টে সৌরভ খেলেননি । পরে সেই টেস্টটি বেসরকারি ঘোষিত হয়ে যায়। সেই সিরিজে ভারতের মাত্র ৪ জন খেলোয়াড় তিরিশ বা তার ওপরে গড় ধরে রাখেন। সচিন, সেহওয়াগ, লক্ষণ এবং সৌরভ। প্রথম টেস্টে ৩০ করেন। দ্বিতীয় টেস্টে একটি ৪২।
এমনকি পোর্ট এলিজাবেথে ম্যাচ বাঁচানোর নায়ক দ্রাবিড়ের গড় মাত্র ২৮। কাজেই একেবারে ব্যর্থ বোধহয় সৌরভকে বলা যায় না। যদিও ভারত টেস্ট সিরিজ ১-০ হেরেই শেষ করে। সেই সফরের ওয়ানডে সিরিজে সৌরভ তো সর্বোচ্চ রানের মালিক ছিলেন। সময়ানুক্রমে এরপর আসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর। সেই সফরে টেস্ট সিরিজ ভারত হারে ২-১ ফলে। কিন্তু ব্যাটার সৌরভ এই সিরিজে উজ্জ্বল।
ভারতীয় দের মধ্যে চতুর্থ এবং দুই দল মিলিয়ে ষষ্ঠ স্থানে। ৫৩.৬৬ গড়ে ৩২২ রান। যার মধ্যে আবার রয়েছে পোর্ট অফ স্পেনে ম্যাচ জেতানো ৭৫। লক্ষণের সাথে জুড়ি বেঁধে। ওয়ানডে সিরিজে তো সৌরভ প্লেয়ার অফ দা সিরিজ। ৩ ম্যাচে ৪৫.৩৩ গড়ে ১৩৬ রান। কাজেই এই সফরেও ‘সৌরভ অধিনায়ক ছিলেন বলেই দলে ছিলেন’ যুক্তিটি খাটে না।
এরপর ২০০২ এর ইংল্যান্ড সফর। সেই সফরে সর্বোচ্চ রানকারীর তালিকায় সৌরভ ছিলেন ৪ নম্বরে। ৬ ইনিংসে ৩৫১ রান। গড় ৫৮। ১ টি সেঞ্চুরি ও ৩ টি অর্ধশতক, যার একটা আবার ৯৯। অর্থাৎ এই সফরে সৌরভ ছিলেন অসম্ভব ধারাবাহিক। ওয়ানডে সিরিজে অবশ্য খানিক স্তিমিত ছিলেন, এক ফাইনাল বাদে। এরপর ২০০২-০৩ এর নিউজিল্যান্ড সফর।
এই একটিমাত্র বিদেশ সফরে সৌরভকে জোরগলায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ বলা যায়। অবশ্য সেই সিরিজে ভারতের কোনো ব্যাটারই খুব একটা ভালো খেলতে পারেননি। একমাত্র দ্রাবিড়ের গড় ছিল ৩০ এর ওপর। সচিনের ২৫। সৌরভ ও লক্ষণের গড় শুনলে হাসি পাবার মতো। যথাক্রমে ৭.২৫ ও ৬.৭৫। ওয়ানডে সিরিজেও সৌরভের ৭ ইনিংসে সংগ্রহ মাত্র ৫৮ রান। সর্বোচ্চ ২৩।
গড়ের কথা বলে তাঁকে আর লজ্জা না দেওয়াই ভালো। সেনা দেশগুলিতে অধিনায়ক সৌরভের শেষ সফর, ২০০৩ এর অস্ট্রেলিয়া সফর। সৌরভের সেই টেস্ট সিরিজে ৪ টেস্টে ৬ ইনিংসে সংগ্রহ ৪৭.৩৩ গড়ে ২৮৪ রান। একটি ১০০ ও একটি ৫০। একেবারেই খারাপ বলা যায় কি? ওয়ানডে সিরিজে অবশ্য সৌরভের মানে একেবারেই ভালো খেলতে পারেননি তিনি। গড় মাত্র ২২।
সেনা সফর শেষ হলে বাকি রয়ে যায় শ্রীলংকা ও পাকিস্তান। ২০০১ এর শ্রীলঙ্কা সফরের সময়, সৌরভ চরম অফ-ফর্মে। অধিনায়কত্ব প্রায় যায় যায়। সেই সিরিজে তাঁর গড় ৩৩। তার মধ্যেও একটি ম্যাচ জেতানো ৯৮। ওয়ানডে সিরিজে তাঁর গড় মাত্র ২৩। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ওয়ানডে সিরিজে সৌরভ দারুণ কিছু না করলেও, ধারাবাহিক রান করে গেছেন।একটিও পঞ্চাশ অবশ্য নেই তাঁর।
টেস্ট সিরিজে একটিই ম্যাচ খেলেন। একটিই ইনিংস। দ্রাবিড়ের নায়কোচিত ২৭০ এর পাশে সৌরভের ৭৭ নিতান্তই জনি লিভার জাতীয় পার্শ্ব চরিত্র। কিন্তু রান টা ফেলে দেবার মতো একেবারেই না। আরেকটি সিরিজ যেটায় সৌরভকে সম্পূর্ণ রূপে ব্যর্থ বলা যায়, তা হলো ২০০১ এর জিম্বাবুয়ে সফর। সর্বোচ্চ মাত্র ৯।
সফরে একদিনের ম্যাচে অবশ্য তিনি প্রায় স্বমহিমায় বিরাজমান। ৩৯ গড়ে ১৯৭ রান। এছাড়া সৌরভের শেষ সফরে (অধিনায়ক হিসাবে) তিনি অত্যন্ত দুর্বল জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে একটি শ্রমসাধ্য সেঞ্চুরি করেন। বাংলাদেশ সফর নিয়ে আর না হয় নাই বা বললাম।
এবার একটু তলিয়ে যদি সেনা দেশে (ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ) অধিনায়ক সৌরভের ব্যাটিং পরিসংখ্যান দেখা যায়, তবে দেখবো তাঁর গড় ১৭ টেস্টে ৪৩.০৬। নিউজিল্যান্ড সফরকে ব্যতিক্রম ধরলে, তাঁর গড় ১৫ টেস্টে ৪৯.৮৫। মানে প্রায় ৫০ ছুঁইছুঁই। সৌরভের উত্তরসূরি, দ্রাবিড় অধিনায়ক হিসাবে নিউজিল্যান্ড যাননি। ওয়েস্ট ইন্ডিজে, দক্ষিণ আফ্রিকায় ও ইংল্যান্ডে গেছেন। সব মিলিয়ে তাঁর গড় ৪৩.৯৪। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে ৮২।
দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইংল্যান্ডে যথাক্রমে ২১ এবং ২৫। ধোনির গড় অধিনায়ক হিসাবে সেনা দেশে ৩৮.৭৫। কোহলির ২৯ টেস্টে ৪৭.৯২। অর্থাৎ এতো রথি-মহারথিদের মধ্যেও অধিনায়ক হিসাবে সেনা দেশে অন্যতম সেরা ব্যাট সৌরভ। নেভিল কার্ডাস যতই গাধা বলুন, পরিসংখ্যানই সম্ভবত শেষ কথাটি বলে থাকে। বাকিটা না হয় পরের পর্বের জন্যেই তোলা থাক।