তবুও কেন লিটনকে ওপেনিংয়ে চাই না!

উপমহাদেশের ব্যাটাররা সেনা দেশগুলোতে গেলে- পেস সামলাতে হিমশিম খায়, সেনা দেশের ব্যাটাররা উপমহাদেশে এসে স্পিনের সামনে কাত হয়ে পড়ে। মুরালিধরন, সাকলাইন মুশতাক বা অনিল কুম্বলেকে লাগে না, আমাদের মিরাজ, নাঈম হাসানের সামনেই ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকার কি অবস্থা হলো! একটু ভালো করে খেয়াল করলে বুঝা যায়- এরকম স্ট্রং জোন - উইক জোনের পেছনে বড় কারণ হচ্ছে, সেই ক্রিকেটারের বেড়ে ওঠা, গড়ে ওঠা, দিনের পর দিন বিশেষ উইকেটে, কন্ডিশনে বিশেষ বোলারদের খেলে খেলেই বিশেষ দক্ষতা যুক্ত হয়েছে! সেটা চাইলে সবার পক্ষে জাতীয় দলে আসার পরে দুই চার বছরে আয়ত্ব করা সম্ভব নাও হতে পারে।

লিটন কুমার দাসের ভালো ব্যাটিং এর আমি ভক্ত। লিটন যেদিন ছন্দে থাকে, সেদিন তার ব্যাটিং মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়! কিন্তু, মুশকিল হচ্ছে সাদা বলে লিটন কবে ছন্দে থাকবে, আর কবে মুগ্ধ হয়ে ব্যাটিং দেখবো- সেই প্রশ্নটা সবার আগে মাথায় আসে, কেননা শুরুর দিকে নতুন বলে লিটন খুব শেকি থাকে। পেসাররা একটু মুভমেন্ট পেলে তো কথাই নাই, ভয়ে থাকি- কখন ১৫-২০ টা বল পার হবে তার জন্যে বল গুনতে থাকি।

কেননা এই ১৫-২০ বলের ফাঁড়া কাটলেই একটা বড় ইনিংসের আশা করা যায়। বড় ইনিংস মানে ৪০-৫০-৬০ না, তারও বড়। লিটন ওডিআইয়ে ফিফটি পার করতে পেরেছে আট বার, তার পাঁচটাকেই সে সেঞ্চুরিতে পরিণত করেছে, তার মধ্যে একটা ১৭৬, এছাড়া আছে ১৩৬, ১২৬*, ১২১। ফলে, সেট হয়ে গেলে, কনফিডেন্স পেয়ে গেলে- অনেক বড় ইনিংস খেলতে পারে। কিন্তু তেমন দিন তো সহজে আসে না।

আসলেও আসে জিম্বাবুয়ে, আফগানিস্তানের মত দলের বিরুদ্ধে, বা একটু স্লো উইকেটে। পেস সহায়ক, বাউন্সি, সুইঙ্গি সবুজ উইকেটে, মেঘলা – বাতাসি কণ্ডিশনে, যেখানে নতুন বল একটু মুভ করে, বা ভালো পেস এটাক থাকলে- লিটন পাওয়ার প্লে পার করতে পারে না! ফলে, সেই মহাসুন্দর বড় বড় ইনিংসগুলোও আর দেখাও হয় না! লিটনের মত ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে মোনালিসা আঁকতে পারা ব্যাটারকে নিয়ে মহা আফসোসের মধ্যে ডুবে থাকতে হয়!

  • পরিসংখ্যান কি বলে?

ওডিআইয়ে লিটন এখন পর্যন্ত ৪৯ ইনিংসে ব্যাট করেছে, যার ৩৫ বার ওপেন করেছে। ৯ বার নেমেছে তিনে। তিনে এই ৯ বারের মধ্যে ৫ বারই তাকে নামতে হয়েছে পাওয়ার প্লেতে। অর্থাৎ, ক্যারিয়ারে ৪০ বার লিটনকে পাওয়ার প্লে’তে ব্যাট করতে হয়েছে। কি ভয়ানক বিপদে পড়তে হয়েছে তাকে?

  • ৪০ বারের মধ্যে ৫০%, মানে ২০ বারই লিটন আউট হয়েছে সিঙ্গেল ডিজিটে, যার ৭ বারই মেরেছেন ডাক, বাংলায় রসগোল্লা।
  • এই ৪০ ইনিংসের মধ্যে ১২ বারই লিটন সিঙ্গেল ডিজিট বল (১-৯ টা বল) খেলেই আউট হয়েছে, ১০-২০ টা বলে খেলে আউট হয়েছে ১০ বার। ২৫ বা তার কম বল খেলে আউট হয়েছে ২৪ বার। এই ২৪ ইনিংসে স্ট্রাইক রেট মাত্র ৬০।
  • লিটন যে ২৫ বা তার কম বল খেলে ২৪ বার আউট হয়েছে, তার মধ্যে একবার রান আউট হয়েছে, একবার আফগানিস্তানের মুজিব উর রহমান, আর একবার আউট হয়েছে ওয়েস্ট ইণ্ডিজের আকিল হোসেনের বলে। বাকি ২১ বারই আউট হয়েছে পেসারদের বলে। চলমান সিরিজের প্রথম ম্যাচে আফগানিস্তানের ফারুকির বলে আউট হয়েছে, তেমনি আউট হয়েছে জিম্বাবুয়ের জার্ভিস, চাতারা, জঙ্গে, পানাঙ্গারার বলে, সাউথ আফ্রিকারা রাবাদা, নিউজিল্যাণ্ডের বোল্ট, হেনরি, সাউদির বলে, শ্রীলংকার মালিঙ্গা, ওয়েস্ট ইণ্ডিজের কিমো পল, জোসেফের বলে।

লিটন শুধু যে ওডিআইয়েই নতুন বলে এমন শেকি থাকে, তা নয়। টিটুয়েন্টিতেও তার একই অবস্থা। এখন পর্যন্ত টিটুয়ন্টি ইন্টারন্যাশনাল ম্যাচ খেলেছে ৪৫ টা, এখানেও ওপেন করেছে ৩৫ টা ইনিংসে। তিনে খেলেছে ৫ বার, চারে এক বার, তিনে খেলা ৫ ইনিংসের তিনটা এবং চারে খেলা একটা ইনিংসই তাকে নামতে হয়েছে পাওয়ার প্লে’তে। অর্থাৎ টিটুয়েন্টিতে লিটনকে ৩৯ বার পাওয়ার প্লে’তে নতুন বল সামলাতে হয়েছে। সেখানে কি অবস্থা?

  • ৩৯ ইনিংসের মধ্যে ১৯ বারই সিঙ্গেল ডিজিট রানেই আউট হয়ে গিয়েছে, যার মধ্যে ৪ বার ডাক মেরেছে।৩৯ ইনিংসের ম
  • ধ্যে ১৭ বারই সিঙ্গেল ডিজিট বল খেলে (১-৯ টা বল) আউট হয়েছে।
  • ১৫ বা তার কম বল খেলে আউট হয়েছে ২৪ বার। এই ২৪ ইনিংসে স্ট্রাইক রেট মাত্র ৮৭।টেস্টেও লিটন ১০ ইনিংস ওপেন করেছে, একবার তিনে খেলেছে। এই ১১ ইনিংসে সেঞ্চুরি তো দূরের কথা একবারও ফিফটিও করতে পারেনি। গড় মাত্র ১৬.৯০।

পাওয়ার প্লে’তে লিটন দাস, সৌম্য ও তামিম

পাওয়ার প্লে’র প্রথম দশ ওভারে পেস এটাক কে কেমন সামলায়? ডট খেলতে খেলতে “ডটবাবা” নাম হয়েছে তামিমের, সেই তামিম একটা বেঞ্চমার্ক হতে পারে। লিটন ও সৌম্য পাওয়ার প্লে’তে পেস এটাকের বিরুদ্ধে তামিমের তুলনায় কেমন খেলে, তাদের এভারেজ কত, স্ট্রাইক রেট কত, আর ডট পার্সেন্টেজই বা কত?

গড়: পাওয়ার প্লে’র ১০ ওভারে পেসারদের বিরুদ্ধে তামিমের গড় সবচেয়ে বেশি, ৩৭.৫। সৌম্যর গড় ৩১.৬। আর লিটনের গড় সবচেয়ে কম- ২৩.৫।

স্ট্রাইক রেট: সবচেয়ে বেশি স্ট্রাইক রেট সৌম্য সরকারের, ৯৩.২। অবাক ব্যাাপার হচ্ছে- পাওয়ার প্লে’তে পেসারদের বিরুদ্ধে লিটনের চেয়ে তামিমের স্ট্রাইক রেট বেশি। তামিমের ৭৪.১, আর লিটনের ৭১.৯। তামিমের স্ট্রাইক রেট কম হওয়ার কারণ বোধগম্য, সে টিকে থাকার জন্যে রিস্ক কম নেয়, সেটা দেখা যাচ্ছে তার গড় থেকে। কিন্তু লিটনের গড়টাও খুব কম। একই সাথে স্ট্রাইক রেট ও গড় দুটোই কম থাকার অর্থ হচ্ছে, এত স্লো খেলার পরেও পাওয়ার প্লে’তে পেসারদের বিরুদ্ধে সে টিকে থাকতে পারছে না।

ডট পার্সেন্টেজ: পাওয়ার প্লে’তে সাধারণভাবেই ডট বল বেশি খেলতে হয়, কেননা ফিল্ডিং রেস্ট্রিকশন বেশি থাকে। এ সময়ে রানের জন্যে মূলত বাউণ্ডারির উপরে নির্ভর করতে হয়। পেসারদের বিরুদ্ধে পাওয়ার প্লে’তে সৌম্য সরকারের ডট পার্সেন্টেজ সবচেয়ে কম, ৫৯.৪%। খ্যাত তামিম ইকবালের ৬৫.৯%। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, তামিমেরও চাইতে লিটনের ডট পার্সেন্টেজ বেশি, ৬৬.৫%।

  • ওপেনার হিসেবে লিটন মহাব্যর্থ

এখান থেকেই বুঝা যাচ্ছে, লিটন আসলে ওপেনার হিসেবে মোটামুটি ব্যর্থ। তাহলে, এমন ব্যর্থ ওপেনারকে জাতীয় দলের একাদশে বা স্কোয়াডে রাখার দরকার কি? তাকে দল থেকে বাদ দেয়ার কথা না বলে আমি কেন ওপেনিং পজিশন থেকে সরানোর কথা বলছি? লিটনের ব্যাটিং সৌন্দর্য, লিটনের ব্যাটিং নিয়ে মুগ্ধতা, ইত্যাদি ইত্যাদি, তাই লিটনকে আমার জাতীয় দলে চাই-ই চাই, ওপেনিং-এ না পারলে, তিনে, সেখানে না পারলে চারে বা পাঁচে, দরকারে কিপার হিসেবে সাতে, যেখানেই হোক- লিটনকে আমি একাদশে চাই- আমি লিটনের মহাভক্ত মুরিদ — ব্যাপারটা তা নয়। লিটনের ব্যাটিং এর কিছু স্পেশালিটির দিকে তাকানো যাক।

  • লিটনের স্পেশালিটি

পাওয়ার প্লে’র পরে, মানে ১১ তম ওভার থেকে ৫০ তম ওভার পর্যন্ত কার স্ট্যাট কেমন সেই স্ট্যাট দিয়ে শুরু করছি।
গড়ঃ পাওয়ার প্লে’তে লিটনের গড় যেখানে মাত্র ২৪.৪, পাওয়ার প্লে’র পরে সেই গড় হচ্ছে ৪০। তামিম ও মুশির পরেই লিটনের অবস্থান (স্লগার হিসেবে অল্প ম্যাচ খেলা আফিফকে বাদ দিয়ে)। সৌম্য সরকারের গড় ৩৭.২, তামিম ইকবালের গড় ৪৩, সাকিবের গড় ৩৮.৬, মুশির গড় ৪০.৯।

স্ট্রাইক রেট: পাওয়ার প্লে’র পরে লিটনের স্ট্রাইক রেট বাংলাদেশি ব্যাটারদের মধ্যে সর্বোচ্চ, ১০৪.৫। এর পরে সৌম্যের অবস্থান, ১০২.৯। তামিম, সাকিব, মুশফিকের স্ট্রাইক রেট ৮০ এর ঘরে।

ডট পার্সেন্টেজ: বাংলাদেশি ব্যাটারদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো স্ট্রাইক রোটেট করতে পারে কে? মুশফিকের নাম আসে, সাকিবের নাম আসে, নতুনদের মধ্যে আফিফের নামটাও আসে। কিন্তু, এ কাজে আক্ষরিক অর্থে সবচেয়ে সেরা হচ্ছে লিটন কুমার দাস। মুশকিলটা হয়েছে, পাওয়ার প্লে’তে নতুন বলে প্রচণ্ড শেকি থাকায় ঠিকমত ব্যাটে বলেই করতে পারে না, সে কারণে ওভারল ডট পার্সেন্টেজ স্ট্যাট দেখে বুঝার উপায় নেই, লিটন কতখানি স্কিল ফুল এই স্ট্রাইক রোটেট এর ক্ষেত্রে। সেটা বুঝা যাবে, যদি আমরা ১০ ওভারের পরের থেকে স্ট্যাট হাতে নেই। পাওয়ার প্লে’র পরে লিটন ডট পার্সেন্টেজ মাত্র ৪১.৪, এত কম আর কারোরই নেই। কাছাকাছি হচ্ছে আফিফের, ৪৩। সাকিব ও মুশফিকের ৪৭.৯।

(পাওয়ার প্লে’র পরে তামিম ইকবালেরও ডট পার্সেন্টেজ তাদের চাইতে খুব বেশি না, ৪৮.৬, কিন্তু এ সময়ে তামিম যেহেতু মুশফিক ও সাকিবের চেয়ে বেশি বাউণ্ডারি মারে, সেহেতু ডট পার্সেন্টেজ কম হওয়ার পরেও তার স্ট্রাইক রেট সাকিব-মুশির চাইতে বেশি। )

স্পিনে পারদর্শিতা: আমাদের ব্যাটারদের মাঝে সবচেয়ে ভালো স্পিন খেলে কে? সবার প্রথমে দুটো নাম আসবে, মুশফিক ও লিটন। দুজনের মাঝে সেরা কে? ১১ তম ওভার থেকে ৫০ তম ওভারের স্ট্যাট বলছে- লিটন দাস বাংলাদেশের যেকোন ব্যাটারের তুলনায় স্পিনের বিপরীতে সবচেয়ে সাবলীল। বাঁহাতি অর্থডক্স স্পিনারদের বিরুদ্ধে একটু দুর্বল, গড় মাত্র ৪২, স্ট্রাইক রেট ৯৪। ডানহাতি অফব্রেক স্পিনারের বিরুদ্ধে একটু কম গতিতে রান তুলেছে, স্ট্রাইক রেট ৯২, কিন্তু আউট কম হয়েছে, মাত্র ২ বার, ফলে গড় ৭০.৫।

আর, লেগব্রেক স্পিনারদের বিরুদ্ধে ভালো গতিতে রান তুলেছে – স্ট্রাইক রেট ১০৪.৭, গড় ৪৫। বাঁহাতি ব্যাটার সৌম্য বাঁহাতি অর্থডক্স স্পিনারের বিরুদ্ধে কিছুটা ভালো হলেও- ওভারল স্পিনারদের বিরুদ্ধে লিটনের চাইতে বেশ পিছিয়ে থাকবে। তামিম, সাকিবও ১১ থেকে ৫০তম ওভার পর্যন্ত স্পিনারদের বিরুদ্ধে পারফর্মেন্সে পিছিয়ে থাকবে। ডানহাতি ব্যাটার মুশফিক স্পিনে ভালো হলেও (বিশেষ করে লেগব্রেক ভালো খেলে, ৫১ গড়) বাঁহাতি অর্থডক্স স্পিনে বেশ দুর্বলই বলা যায়, গড় মাত্র ৩৪.১, স্ট্রাইক রেট ৬৪.৩।

পেস বোলিং-এ পারদর্শিতা: লিটনের সমস্যা নতুন বলে। কিন্তু বলটা একটু পুরান ও নরম হলে, পেসারদের সে অনায়াসে খেলে। বলে যত গতি, লিটনের ব্যাট যেন তত হাঁসে। লেফট আর্ম ফাস্ট বোলারদের বেশি খেলেনি, স্ট্রাইক রেটটা তাই একটু কম, কিন্তু এখনো পর্যন্ত আউট হয়নি।

লেফট আর্ম মিডিয়াম পেসারদেরও খেলেছে কম, গড়টা একটু কম হলেও স্ট্রাইক রেট ১০৬। আর, রাইট আর্ম মিডিয়াম পেসারদের বিরুদ্ধে স্ট্রাইক রেট ১১৫, গড় ৩৬। রাইট আর্ম ফাস্ট বোলাররা এখনো লিটনকে আউট করতে পারেইনি, উল্টো রান দিয়েছে প্রচুর- মানে স্ট্রাইক রেট ১১৭। পেসারদের বিরুদ্ধে এমন মারমুখী ব্যাটার বাংলাদেশে এক সৌম্য সরকার বাদে আর কেউই নেই।

কনভার্সন রেট: লিটনের সমস্যা হচ্ছে রান সিঙ্গেল ডিজিট থাকতে থাকতেই আউট হয়ে যায়। কিন্তু, কোন রকমে যদি ইনিংস আরো কিছুদূর টেনে লম্বা করতে পারে, মানে একবার কনফিডেন্স পেয়ে যায়, তাহলে তাকে ঠেকানো বেশ কঠিন। এ পর্যন্ত ৮ টা ইনিংসে লিটন ৫০ পার করতে পেরেছে, তার ৫ বারই সেঞ্চুরি ছুয়েছে, সেঞ্চুরি পার করেই থামেনি, আরো বিধ্বংসী হয়ে সেটাকে আরো বড় করেছে। লিটনেরই কনভার্সন রেট সবচেয়ে বেশি।

  • লিটনকে মিডল অর্ডারে চাই

তার মানে দাঁড়াচ্ছে, লিটন কুমার দাসের ব্যাটিংটা শুধু সুন্দরই নয়, তার ব্যাটিং এর কিছু স্পেশালিট আছে। তার উইক জোন হচ্ছে – পেসারদের নতুন বলে বাউন্স, সুইং। এই একটা উইক জোনের বিপরীতে লিটনের স্ট্রং জোন রয়েছে অনেক।

স্পিনের দেশসেরা বা অন্যতম সেরা, পাওয়ার প্লে’র পরে সবচেয়ে স্ট্রাইক রোটেট করার এবিলিটি আছে, হাতের অসংখ্য শট রয়েছে, উইকেটের চারদিকে খেলতে পারে, একবার টিকে গেলে ইনিংস অনেক লম্বা করতে পারে, তখন স্পিনার ও পেসার – সবার বিপরীতেই বেশ আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে। এমন একজনকে আমি তার উইক জোনে ঠেলে দেয়ার চাইতে স্ট্রং জোনকে বেশি করে ক্যাপিটালাইজ করতে চাইবো। সে কারণেই, টেস্টের মত ওডিআইয়েও লিটনকে ওপেনিং থেকে সরিয়ে মিডল অর্ডারে দেখতে চাই। কারণ –

  • লিটন স্পিনে ভালো। স্পিনে সবচেয়ে সাবলীল ব্যাটাররা সাধারণত চারে, পাঁচেই ব্যাট করে।
  • লিটন পাওয়ার প্লে’র পরে আমাদের ব্যাটারদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো স্ট্রাইক রোটেট করতে পারে। উইকেটের চারদিকে গ্যাপ বের করে রান নিতে ওস্তাদ। তিন ও চার নাম্বারের ব্যাটারের জন্যে এটা সেরা গুন।
  • লিটন স্লগেও ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। একজন ওপেনারের তুলনায় ৪-৫ এর ব্যাটারের স্লগ পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ বেশি। লিটন ওপেনার হিসেবে যখন বড় ইনিংস খেলে স্লগ পর্যন্ত ইনিংস টেনে নিয়ে যায়, শেষদিকে বেশ টায়ার্ড হয়ে যায়। লিটন ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বিধ্বংসী ইনিংস এই পাঁচেই খেলেছে। তার ১৭৬ রানের ইনিংসটার চাইতেও ৯৪* রানের ইনিংসে বাংলাদেশ দলের রান রেট অনেক বেশি ছিল (দুটোতেই বাংলাদেশ ৩২২ রান করেছে, তবে একটিতে ৪৩ ওভারে, অপরটিতে ৪১.৩ ওভারে এই রান করেছে)।
  • লিটন টিকে গেলে বড় রান করতে পারে, মানে তাকে আউট করা কঠিন হয়ে যায়। ম্যাচ ফিনিশিং এর এবিলিটিও তার মাঝে আছে। সিঙ্গেলস-ডাবলস যেমন নিতে পারে, তেমনি বিগ হিটও করতে পারে। ফলে, ইনিংস বিল্ড আপ করে, ফিনিশিং পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া, এ কাজটার জন্যে ভালো ব্যাটিং পজিশন হচ্ছে চার ও পাঁচ।

এত বছর খেলেও নতুন বলে পেসের দুর্বলতা কাটাতে না পারলে কিসের ভালো ব্যাটার? দুর্বলতা নিয়ে কাজ করুক আগে, মিডল অর্ডারে পাঠানো কোন সমাধান নয়!

হ্যাঁ, এতদিন খেলেও লিটন এই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। অবশ্যই ওপেনার হিসেবে সে ভালো ব্যাটার নয়, এটা স্বীকার করে নিচ্ছি। কিন্তু, দুনিয়ার অসংখ্য বাঘা বাঘা ব্যাটারেরই স্ট্রং জোন যেমন থাকে, উইক জোনও থাকে! কালিনান নামে সাউথ আফ্রিকার এক ব্যাটার ছিল, আমার খুবই প্রিয়, এত সুন্দর কাভার ড্রাইভ খেলতো। কিন্তু, স্পিনটা খেলতে পারতো না। শেন ওয়ার্ণ বলে কয়ে আউট করতো।

উপমহাদেশের ব্যাটাররা সেনা দেশগুলোতে গেলে- পেস সামলাতে হিমশিম খায়, সেনা দেশের ব্যাটাররা উপমহাদেশে এসে স্পিনের সামনে কাত হয়ে পড়ে। মুরালিধরন, সাকলাইন মুশতাক বা অনিল কুম্বলেকে লাগে না, আমাদের মিরাজ, নাঈম হাসানের সামনেই ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকার কি অবস্থা হলো! একটু ভালো করে খেয়াল করলে বুঝা যায়- এরকম স্ট্রং জোন – উইক জোনের পেছনে বড় কারণ হচ্ছে, সেই ক্রিকেটারের বেড়ে ওঠা, গড়ে ওঠা, দিনের পর দিন বিশেষ উইকেটে, কন্ডিশনে বিশেষ বোলারদের খেলে খেলেই বিশেষ দক্ষতা যুক্ত হয়েছে! সেটা চাইলে সবার পক্ষে জাতীয় দলে আসার পরে দুই চার বছরে আয়ত্ব করা সম্ভব নাও হতে পারে।

বাংলাদেশের ব্যাটারদের কোয়ালিট পেসে ও স্পিনে যে দুর্বলতা- তার পেছনে বড় কারণ আমাদের উইকেট। ওয়েস্ট ইন্ডিজে টেস্টে আমরা ৪৫ রানেও প্যাকেট হয়েছিলাম। আফগানিস্তান সিরিজেও প্রথম ওডিআইয়ে ফারুকির সুইং-এ পরাস্ত হয়ে টপাটপ চার উইকেট! পাকিস্তান সিরিজে আফ্রিদি, হাসান আলীর বলে সকালের সেশনে ও নতুন বলে সবাই চোখে সর্ষে ফুল দেখলাম।

মূল কারণই হচ্ছে, আমাদের ব্যাটারদের এমন পেস খেলার অভ্যস্থতা নেই। শুধু লিটন কেন, তামিম বাদে প্রতিটি ওপেনারই ভুগছে (তামিমও ভুগে, তবে তামিম তুলনামূলক কম ভুগে)। সে কারণেই টিম ম্যানেজমেন্ট বিকল্প না পেয়ে (বাকিরা লিটনের চেয়েও খারাপ করছে) লিটনের উপরেই ভরসা করছে, ফলে লিটনকেই ঘুরে ফিরে ওপেন করার দায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছে।

লিটন যদি তার দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারতো, খুব ভালো হতো। এখনও যদি পারে, খুব ভালো হয়। ওপেনার হিসেবেই সে ধারাবাহিকভাবে রান পেত, বাংলাদেশের অনেক জয় এনে দিত। কিন্তু, বাস্তবতা হচ্ছে- এত বছরেও পারেনি। দায় দিতে চাইলে- দায় লিটনেরই হয়তোবা, যদিও জানি সে এটা নিয়ে অনেক চেস্টা করেছে, করে, মানে এখনো করে যাচ্ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- লিটন যদি এই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে না পারে, তাহলে কি হবে? সাউথ আফ্রিকা ট্যুরেই রাবাদা, নরকিয়া, লুঙ্গির সামনে আবার টানা সিঙ্গেল ডিজিটে ডুব দেয়ার সম্ভাবনা প্রচুর দেখি, তারপরে আয়ারল্যান্ড, জিম্বাবুয়ে হয়ে ইংল্যান্ড। এই ১২-১৩ ম্যাচের বেশিরভাগেই ব্যর্থ হবে।

দুর্বলতা নিয়ে টানা ব্যর্থ হলে করণীয় কি? তাকে দল থেকে ড্রপ করা। কিন্তু, একজনের একটা উইক জোনের বিপরীতে যখন অনেকগুলো স্ট্রং জোন থাকে, তখন একটু ভিন্নভাবে পরখ করার সুযোগ আছে বলে মনে করি। কেননা, মাঝে মধ্যে দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার চাইতে সবলতার দিকে অধিক দৃষ্টি দেয়াটাও একটা ভালো স্ট্রাটেজি হতে পারে।

ঘরোয়া ক্রিকেটে আজীবন ওপেন করলো, এখন তাকে মিডল অর্ডারে পাঠানোর কি মানে?

এর জন্যে আমাদের ঘরোয়ার ক্রিকেট সম্পর্ক ভালোভাবে জানতে হবে। লিটনের পারফর্মেন্স আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটে দুর্দান্ত। এনসিএল ও বিসিএল-এ লিটনের গড় ওপেনিং এ ৫০ এর উপরে। সারাজীবন ডমেস্টিক ফার্স্ট ক্লাসে ওপেনিং-এ ব্যাট করে টেস্টে কেন সে সাতে, ছয়ে ব্যাট করছে? ঠিক একই কারণে ৩৮ লিস্ট এ গড়ের লিটনকে ওডিআইয়েও মিডল অর্ডারে পাঠানো যেতে পারে।

ঘরোয়ায় ওপেনিং -এ ৫০ গড়ের একজন আন্তর্জাতিকে নতুন বলে পেস আক্রমণ সামলাতে হিমশিম খাওয়ার কারণ হচ্ছে, আমাদের স্লো, টার্নিং উইকেটে খেলে অভ্যস্থ ওপেনাররা ভালো পেস এটাকের মুখোমুখি হয় না। আমাদের ডমেস্টিক ক্রিকেটে পেসারদের চেয়ে স্পিনাররা বেশি বল করে, এমনকি অসংখ্য ম্যাচে নতুন বলেও স্পিনাররা বল শুরু করে, ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে কখনো কখনো কোন কোন দল ৩-৪ স্পিনারের সাথে ফরহাদ রেজা, আরিফুল, সৌম্য টাইপের এক পেসার নিয়ে একাদশ গড়ে। একদম বাচ্চাকাল থেকে শুরু করে, এইজ লেভেল, আঞ্চলিক, জাতীয়- সব জায়গাতেই ন্যাড়া উইকেটে খেলে খেলেই সবাই বড় হয়! ফলে, এই ক্রিকেট অবকাঠামো থেকে বের হওয়া লিটন দাস আন্তর্জাতিকে এসে নতুন বলে পেস সামলাতে হিমশিম খায়!

লিটন তো ওপেনিং-এই খেলতে আগ্রহী বলে জানিয়েছে!

সেরকমটাই তো জানানোর কথা। টিম ম্যানেজমেন্ট লিটনকে ওপেনার হিসেবে খেলাচ্ছে। লিটন সারাজীবন ওপেনার রোলেই খেলেছে। ফলে, ওপেনিং-এ ব্যাট করাটা সে এনজয় করে- এমনটাই তো বলবে। তার পক্ষে কি এটা বলা, এমনকি মনেও করা সম্ভব যে, আমি নতুন বলে ওপেনিং-এ খুব দুর্বল, আমার পক্ষে আর সম্ভব না, আমাকে মিডল অর্ডারে একটা সুযোগ দাও! সে তো এটা চিন্তাও করতে পারবে না, বরং সে যদি নিজের দুর্বলতা পায়, সেই দুর্বলতা দূর করাটাকেই সে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিবে। ফলে, লিটন কি বললো না বললো, তা দিয়ে এই সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না।

এই সিদ্ধান্ত নিতে হবে টিম ম্যানেজমেন্টকে (সেখানে দরকার স্টিভ রোডসের মত কোচকে), টিম ম্যানেজমেন্টকে বুঝতে হবে, লিটনকে কেন ওপেনিং থেকে মিডল অর্ডারে দরকার। এবং সেটা লিটনকে বুঝাতে হবে, দুর্বলতা আছে জন্যেই অন্য জায়গায় ট্রাই করা হচ্ছে, ব্যাপারটা এমন নয়, বরং লিটনের যে শক্তির জায়গা- সেটা ক্যাপিটালাইজ করতেই- মিডল অর্ডারে সবচেয়ে ভালো আউটপুট পাওয়া যাবে।

সেই সাথে তাকে কিপিং এর দায়িত্বের কথাটাও বলা যেতে পারে। লিটনের ওপেনিং এ আগ্রহের পরেও টেস্টে সাতে ব্যাট করছে, সেখানে রান পাওয়ার পরে- ছয়ে, সাতেও এঞ্জয় করছে। ওডিআইয়েও এর আগে ওপেনিং বাদে, ৩, ৪ ও ৫-এ, টিটুয়েন্টিতে তো এমনকি সাতে, আটেও ব্যাট করেছে। ফলে, টিম ম্যানেজমেন্ট চাইলেই লিটনকে ভিন্ন ব্যাটিং অর্ডারে থিতু করতে পারবে। নট আ বিগ ডিল এট অল!

রাব্বি – আফিফের কি হবে?

রাব্বি – আফিফ খেলছে বলে প্রশ্ন উঠতে পারে, আমাদের ফার্স্ট ক্লাস ও লিস্ট এ ক্রিকেটে সর্বোচ্চ গড়ের অধিকারী মোসাদ্দেক সৈকত ও তৌহিদ হৃদয়ের কি হবে? এমন প্রশ্ন ওঠা খুব ভালো, বিকল্প তথা পাইপলাইনের খেলোয়াড়ের সাপ্লাই যখন অব্যাহত থাকে, তখনই ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তাটা কমে। আমাদের মিডল অর্ডারে অনেকগুলো অপশন দেখা যাচ্ছে, এটা বেশ সুখবর। এরকম ক্ষেত্রে, একাদশ/ জাতীয় দলের বাইরের যারা তাদের নিয়ে এ দল বা ইমার্জিং দলের ট্যুর রাখাটা সবচেয়ে বড় কাজ। আমাদের বাংলাদেশ টাইগার্সও ভালো একটা ইনিশিয়েটিভ।

আমার মতে, লিটনকে ভবিষ্যতে চারে ধরা যেতে পারে, বিশেষ করে মুশফিকের অবসরের পরে। সেই চারে অভ্যস্থ করতে এখন তাকে পাঁচে সেট করা যায়। রাব্বির জায়গা হতে পারে ৬ এবং, মুশি চলে গেলে সেও পাঁচে উঠে আসবে। এতে আফিফের উপরে কোপটা পড়বে। তবে, আমি আফিফকে তিনে দেখতে চাইবো (সাকিবের প্রস্থানের পরে)। সাকিব, মুশি, তামিম যাওয়ার পরে, আমাদের তিনে, চারে, ও পাঁচে আফিফ, লিটন ও রাব্বি জায়গা নিলে ব্যাপারটা দারুণ হয়।

লিটন গেলে ওপেনার পাবো কোথায়?

বাংলাদেশ জাতীয় দলের স্কোয়াড বা একাদশ নির্বাচনে ওপেনার সংকটই প্রধান সংকেট। অন্যসব ওপেনারদের ব্যর্থতাতেই লিটন বারে বারে সুযোগ পাচ্ছে। ফলে, লিটনকে মিডল অর্ডারে নিয়ে যাওয়া অর্থ, ওপেনিং স্লটে একটা গ্যাপ তৈরি হয়ে যাওয়া। সেই গ্যাপ পূরণ করা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ডমেস্টিকের কোথাও ওপেনারদেরদের পারফর্মেন্স খুব একটা আশাপ্রদ নয়। এটা মেনে নিয়েই নতুন বিকল্পের সন্ধান করতে হবে। তামিমের পার্টনার হিসেবে সৌম্যকে আমার পছন্দ ছিল, কিন্তু সৌম্য তো নিজেকে হারিয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে।

মুনিম শাহরিয়ার টিটুয়েন্টিতে মাত্র যুক্ত হলো, তবে আমি আফগানিস্তান সিরিজের দুই টিটুয়েন্টির সাথে সাথে খুব আগ্রহী- আসন্ন ডিপিএল আসর নিয়ে। সেখানেও মুনিম কেমন করে, তা গুরত্ব দিয়ে দেখবো, ভালো করলে- তাকে দ্রুত ওডিআইয়েও যুক্ত করার পক্ষে, বিশেষ করে তামিমের এংকরিং রোলের পাশে মুনিমের ব্যাটিংটা খুব মানাবে, বিশেষ করে এবারের বিপিএল এর ফর্মটা যদি ওডিআই বিশ্বকাপে নিতে পারে, তাহলে সম্ভবত বাংলাদেশ তো বিশ্বকাপই মাতাবে। এর বাইরেও অপশন হিসেবে থাকবে – পিনাক ঘোষ, পারভেজ ইমন, তানজিদ, শান্ত, জয়। সবার জন্যেই সামনের ডিপিএলটা হবে এসিড টেস্টের মত।

তবে, দীর্ঘমেয়াদে কোয়ালিটি ওপেনার তৈরি করতে চাইলে- ভালো স্পোর্টিং উইকেট, পেস সহায়ক উইকেট এবং টার্ণিং উইকেট- ডমেস্টিকে তিন ধরণের উইকেটেই নিয়মিত খেলার ব্যবস্থা করা দরকার। বগুড়ার ঘাসের উইকেটে এনসিএল, বিসিএল, লিস্ট এ, টিটুয়েন্টির খেলা ফেলা দরকার, এরকম উইকেটে সারাদেশে আরো তৈরি করা দরকার। মূল কথা হচ্ছে- আমাদের ক্রিকেটের যেকোন সমস্যার যে মূল- সেই আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটের অবকাঠামো – সেটাকেই আসলে ঢেলে সাজাতে হবে!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...