দ্য রাইজিং স্টার

রিজওয়ান এখন পাকিস্তানের টি-টোয়েন্টির বড় সম্পদ। গত একটা বছর তিনি এই ফরম্যাটে পাশবিক গতিতে রান করে চলেছেন। চলতি পঞ্জিকাবর্ষে তাঁর রান দেখলে রীতিমত আকাশ ভেঙে পড়ার অবস্থা হবে। ১৮ ইনিংসে তাঁর রান ৯৪১। এর মধ্যে একটি সেঞ্চুরি আর নয়টি হাফ সেঞ্চুরি। স্ট্রাইক রেট প্রায় ১৪০। গড় ৯৫-এর ওপরে। আট ম্যাচে ছিলেন অপারজিত, অথচ তিনি পুরোপুরি ওপেনার।

কামরান আকমল ও উমর আকমল দীর্ঘদিন উইকেটের পিছনে গ্লাভস হাতে পাকিস্তানের হয়ে উইকেট সামলেছেন। তারপর সেই যায়গা নেন সাবেক পাকিস্তানি অধিনায়ক সরফরাজ আহমেদ। তার নেতৃত্বে ২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফিও জয়লাভ করে পাকিস্তান৷ কিন্তু এরপরই তার ব্যাটে রান খরা আর বাজে পারফরম্যান্স। এর মধ্যেই একটা ছেলে ঘরোয়া ক্রিকেটে পারফরম্যান্স দিয়ে নির্বাচকদের নজর কাড়তে শুরু করলো।

সেই ছেলেটাই এখন জাতীয় দলের উইকেটরক্ষক হিসেবে নিয়মিত মুখ মোহাম্মদ রিজওয়ান।

ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেট প্রতি একটা ঝোঁক কাজ করতো রিজওয়ানের। রিজওয়ানের বাবা ক্রিকেট খেলা পছন্দ করতেন না, তিনি ছিলেন ক্রিকেটের বিপক্ষে। বাবা চাইতেন ছেলে ভালো করে পড়াশোনা করে ডাক্তার হবেন। কিন্তু রিজওয়ান ক্রিকেট ছাড়া কিছুই বুঝতো না, লুকিয়ে লুকিয়ে হলেও তিনি ক্রিকেট খেলতেন।

তার ক্রিকেট খেলার প্রতি ঝোঁক কমাতে না পেরে, তার বাবা তার প্রতি আরো কঠোর হন। এবং একটা সময় তার খেলার সমস্ত কিট পর্যন্ত জ্বালিয়ে দেন। যেদিন খাইবার পাকতুনওয়ার সবচেয়ে বড় ইসলামিয়া কলেজে ‘স্পোর্টস’ কোটায় রিজওয়ান ভর্তির সুযোগ পেয়ে গেলো, সেদিন থেকে তার বাবা আর তাকে ক্রিকেটের জন্য না করেননি। সেদিন তার বাবা বুঝতে পেরেছিলেন ছেলের প্রতিভা কিসে।

১৯৯২ সালের ১ জুন খাইবারপাকতুনওয়ার পেশোয়ারে জন্ম নেন রিজওয়ান। স্কুল জীবন থেকেই তিনি প্রচন্ড রকমের ক্রিকেট পাগল ছিলেন। ২০০৮ সালে পেশোয়ার প্যান্থার্সের হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে অভিষেক হয় তার। এরপর ২০১১ সালে কায়েদে আজম ট্রফিতে সুই নর্দান গ্যাস পাইপলাইন লিমিটেডের হয়ে অভিষেক হয় তার৷ সুই নর্দানের হয়ে রিজওয়ানের দূর্দান্ত পারফরম্যান্সে তিনবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে দলটি।

২০১৪ কায়েদে আজম ট্রফিতে সুই নর্দানের হয়ে ফাইনালে ডাবল সেঞ্চুরি করেন তিনি এবং সেবার দ্বিতীয় বারের মতো শিরোপা জেতে সুই নর্দান।

২০১৫ সালে প্রথমবার ঘরোয়া ক্রিকেটে দূর্দান্ত পারফর্মেন্স দেখিয়ে বাংলাদেশের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় তার৷ অভিষেক ম্যাচেই তিনি ফিফটি করে সবার নজর কাড়েন। একই সিরিজে তার টি-টোয়েন্টিতেও অভিষেক হয়। ২০১৫ বিশ্বকাপের পর মোহাম্মদ ইউনুস ও মিসবাহ উল হকের অবসরের পর মিডল অর্ডারে ভরসা করার মতো কেউ ছিলো না। তখন সে জায়গাতে খুটি গাড়ার চেষ্টা করেন রিজওয়ান।

এরপর শ্রীলঙ্কা ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ম্যাচে উভয় দলের বিপক্ষেই রিজওয়ান ফিফটি করেন। ২৫ নভেম্বর ২০১৬ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্টে অভিষেক হয় তার। কোনো স্কোর না করেই আউট হওয়া রিজওয়ানেই ভাগ্য এই ফর্মেটেও সহায় হয়নি৷ এরপর তিনি বাদ পড়েন। এরপর এক বছর পর ২০১৮ সালে ইমার্জিং এশিয়া কাপে পাকিস্তানের হয়ে নেতৃত্ব দিয়ে দলকে সেমিফাইনালে তুলেন তিনি। ২০১৮ সালে ঘরোয়া ক্রিকেটে পাকিস্তান কাপে পাঞ্জাব স্কোয়াডের সহ অধিনায়ক ঘোষণা করা হয় তাঁকে।

২০১৯ সালে পিএসএলে করাচি কিংসের হয়ে ব্যাট হাতে ও উইকেটরক্ষক হিসেবে দূর্দান্ত ফিল্ডিং করেন। একই বছর জানুয়ারিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজের ২য় ওয়ানডেতে সরফরাজ আহমেদ ৫ ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ হলে সুযোগ পান রিজওয়ান। এরপর মার্চে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজের জন্য রিজওয়ানকে সুযোগ দেওয়া হয়৷ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজে রিজওয়ান নিজের মেইডেন ওয়ানডে সেঞ্চুরি করেন। ৫ ম্যাচের এক ম্যাচেও পাকিস্তান জয় না পেলেও সেখানে রিজওয়ান দুইটি সেঞ্চুরি করেন।

বাবর আজমের ইনজুরিতে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্টে অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পান রিজওয়ান। একই সফরে টি-টোয়েন্টি সিরিজেও ডাক পান তিনি। ৩য় টি-টোয়েন্টিতে নিজের ক্যারিয়ার সেরা ৮৯ রানের ইনিংস খেলেন রিজওয়ান এবং দলকে জয়ের বন্দরে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে হোয়াইটওয়াশের লজ্জা থেকে রক্ষা করেন।

২০২১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে ঘরের মাঠে নিজের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি করেন তিনি। এবং টেস্ট সিরিজে সিরিজ সেরার পুরষ্কারও জেতেন তিনি। একই সফরের টি-টোয়েন্টি সিরিজে রিজওয়ান দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে নিজের মেইডেন সেঞ্চুরি করেন। ফেব্রুয়ারি ২০২১, পাকিস্তান সুপার লিগের (পিএসএল) ষষ্ঠ আসরে মুলতান সুলতান্স শান মাসুদকে বাদ দিয়ে মোহাম্মদ রিজওয়ানকে অধিনায়ক ঘোষণা করে।

রিজওয়ান এখন পাকিস্তানের টি-টোয়েন্টির বড় সম্পদ। গত একটা বছর তিনি এই ফরম্যাটে পাশবিক গতিতে রান করে চলেছেন। চলতি পঞ্জিকাবর্ষে তাঁর রান দেখলে রীতিমত আকাশ ভেঙে পড়ার অবস্থা হবে। ১৮ ইনিংসে তাঁর রান ৯৪১। এর মধ্যে একটি সেঞ্চুরি আর নয়টি হাফ সেঞ্চুরি। স্ট্রাইক রেট প্রায় ১৪০। গড় ৯৫-এর ওপরে। আট ম্যাচে ছিলেন অপারজিত, অথচ তিনি পুরোপুরি ওপেনার।

এই বছর তো বটেই, কোনো বছরেই কোনো ব্যাটসম্যান এর আগে রিজওয়ানের এই এত রান করার কীর্তি ছুঁতে পারেননি। আর সব ঠিকঠাক থাকলে হয়তো তিনিই আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে এক পঞ্জিকাবর্ষে এক হাজারের ওপর রান করবেন। রিজওয়ানের ব্যাটে ভর করেই বিশ্বকাপের শিরোপা স্বপ্ন দেখছে পাকিস্তান।

মাত্র জাতীয় দলে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিখেছে রিজওয়ান। এখনো পাড়ি দিতে হবে অনেকটা পথ। তবে তার সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স প্রমাণ করে তিনি নিজেকে যেভাবে মেলে ধরেছেন তার স্বপ্নটা অনেক উঁচুতেই। দ্যা রাইজিং স্টার অব পাকিস্তান ক্রিকেট মোহাম্মদ রিজওয়ান ক্যারিয়ারের শুরুটা বেশ হতাশভাবে করলেও বর্তমানে পাকিস্তান ক্রিকেটে তিনি এক ভরসার নাম৷ পাকিস্তানের সাম্প্রতিক বেশ ভালো অবস্থানের পেছনের কারিগরদের একজন এই রিজওয়ান।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...