বিষণ্ণ এক দানব

জনসন দু’দিকেই স‍্যুইংয়ে চূড়ান্ত দক্ষ ছিলেন। শেষের দিকে রিভার্স স‍্যুইংও তাঁর প্রধান অস্ত্র হয়ে উঠেছিল। ডানহাতি ব‍্যাটসম‍্যানদের ক্ষেত্রে ‘দুর্ভেদ্য কোণ' করে বল বাইরে নিয়ে গিয়ে বারবার বিভ্রান্ত করেছেন। বাঁ-হাতিদের ক্ষেত্রেও বল বারবার ভিতরে আনতেন স্বাভাবিক ভাবেই। আর অস্ট্রেলিয়ান বলে অন‍্যান‍্যদের মত বাউন্সারও ছিল খুবই তীক্ষ্ণ।

২৯ মার্চ, ২০১৫। বিশ্বকাপের মঞ্চ।

নিজেদের মাঠ মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে অস্ট্রেলিয়ার পঞ্চম বার সীমিত ওভারের ক্রিকেটের সেরা নির্ধারক সোনালী ট্রফিটি করায়ত্ত করার মুখে বাঁধা হয়ে দাড়িয়ে আছে প্রথম বারের জন্য ফাইনাল খেলতে আসা প্রতিবেশি নিউজিল্যান্ড দল। গোটা টুর্নামেন্টে দু’দলই নিজেদের সেরাটা দিয়েছে, এমনকি গ্রুপ পর্যায়ের ম‍্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েও দিয়েছিল। ঐই টুর্নামেন্টের তখনও পর্যন্ত অপরাজিত এক আক্রমণাত্মক ব‍্যাটসম‍্যান-অধিনায়কের অসাধারণ ব‍্যাটিং ও অধিনায়কত্বে।

যদিও পুরো দলেরই কৃতিত্ব ঠিক ততখানিই। কিন্তু প্রথম বার ফাইনালে খেলবার চাপ নিতে পারেনি নিউজিল্যান্ড। প্রথম ওভারে অধিনায়ককে ফিরিয়ে শুরু হয়েছিল যা পঞ্চম বার বিশ্বকাপ তথা ক্রিকেট মঞ্চ হতে বিদায় নিতে যাওয়া অসাধারণ ব‍্যাটসম‍্যান ও অধিনায়ক মাইকেল ক্লার্কের হাতে থাকা সোনালী অসাধারণ সুদৃশ্য ট্রফিটি শোভা পাওয়ার মধ্য দিয়ে।

যাই হোক সেই ফাইনালে তিন অসাধারণ বাঁ-হাতি পেসার এই সবকিছুর জন্য দায়ী ছিলেন, যাদের একজন বিশ্বকাপের সেরা বোলার তথা দুরন্ত মিচেল স্টার্ক, একজন ওই ফাইনালের ম‍্যাচের সেরা তথা জেমস ফকনার ও অপরজন গোটা টুর্নামেন্টে সহযোগী বোলার হিসেবে অসাধারণ সঙ্গ দেওয়া, ফাইনালের শুরুতেই নিউজিল্যান্ডের ভবিষ্যতে আরেক ফাইনাল খেলা অসাধারণ ব‍্যাটসম‍্যান-অধিনায়ককে ফিরিয়ে দিয়ে।

জ্বি, মিশেল গাই জনসনের কথাই বলছি। সেই ফাইনালটা ছিল মিশেল জনসনের শেষ ওয়ানডে ম্যাচ। সেই ম‍্যাচে ৩ উইকেট নিয়ে নিজের সেরা অর্জনটি করেছিলেন। সেই জনসন, যার এক সময় টেনিস প্রিয় খেলা ছিল। টেনিস গ্রেট পিট সাম্প্রাসের অন্ধভক্ত জনসন প্রথম থেকেই একজন টেনিস খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে জাহির করতে চেয়েছিলেন, সেই জন্য নিজের জন্মস্থান থেকে উঠে আসেন ব্রিসবেনেও। কিন্তু অল্পসময় পরেই টেনিস এর মোহ থেকে মুক্তি ঘটে এবং ক্রিকেটকেই নিজের ধ‍্যান-জ্ঞান হিসেবে নেন।

ক্রিকেটে থিঁতু হলেও সময় সহজ ছিল না। ব্রিসবেনের ক্লাবে ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলে লাভ হচ্ছিল না। ইনজুরি জনিত সমস্যাও ছিল। কুইন্সল্যান্ডের চুক্তি থেকে বাদ পড়েন। বাধ্য হয়ে প্লাম্বিং ভ্যানও চালিয়েছেন ওই সময়।

তাঁর ক্রিকেট ক‍্যারিয়ার বদলে যায় অনন্য এক কিংবদন্তির হাতে পড়া পর। ক্রিকেট রত্ন চিনে নেওয়ার জহুরি ডেনিস লিলির বুঝতে পেরেছিলেন জনসনের সামর্থ্য। টিনএজ বয়স থেকে লিলিকে মেন্টর হিসেবে পাওয়া জনসনকে প্রভূত উন্নতি করতে সাহায্য করেছে। অস্ট্রেলিয়া দলে সুযোগ পাওয়ার পর নিজেকে আরও ধারালো করে তুলে এক দশক ধরে দেশের অন‍্যতম সেরা অস্ত্র হয়ে উঠেছিলেন।

জনসন দু’দিকেই স‍্যুইংয়ে চূড়ান্ত দক্ষ ছিলেন। শেষের দিকে রিভার্স স‍্যুইংও তাঁর প্রধান অস্ত্র হয়ে উঠেছিল। ডানহাতি ব‍্যাটসম‍্যানদের ক্ষেত্রে ‘দুর্ভেদ্য কোণ’ করে বল বাইরে বল বাইরে নিয়ে গিয়ে বারবার বিভ্রান্ত করেছেন। বাঁ-হাতিদের ক্ষেত্রেও বল বারবার ভিতরে আনতেন স্বাভাবিক ভাবেই। আর অস্ট্রেলিয়ান বলে অন‍্যান‍্যদের মত বাউন্সারও ছিল খুবই তীক্ষ্ণ।

উপমহাদেশের ক্রিকেটারদের এই অস্ত্রে বারবার অবদমিত করেছেন। ক‍্যারিয়ারের বিভিন্ন খামখেয়ালীপনার জন্য সমালোচিত হতে হলেও ইনি যে আধুনিক ক্রিকেটের অন‍্যতম সেরা বাঁ-হাতি পেসার তা মেনে নিতে কারোর আপত্তি থাকবার কথা নয়।

যুদ্ধের সময় আপনার তূণে যদি কিছু অতিরিক্ত তীর অথবা আপনার বন্দুকে অতিরিক্ত গুলি থাকে তা অবশ্যই আপনাকে কিছুটা এগিয়ে রাখে। জনসন বোলিংয়ের পাশাপাশি ব‍্যাটিংকেও সময় দিতেন। লোয়্যার অর্ডারে প্রয়োজনে ইনিংস মেরামত, কিংবা ঝড়ো ইনিংস খেলতে পারতেন।

খামখেয়ালি পনায় তিনি নিজের সময়ের অজি দলে ‘সেরা’ ছিলেন। তাই তো, মাত্র ৩৪ বছর বয়সে খেলা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছেন। তখন ছিল তাঁর ক্যারিয়ারের স্বর্ণালী সময়।

ক্রিকেট থেকে দূরে থেকে কেমন আছেন জনসন? নি:সন্দেহে খুব ভাল নেই। নিজেই এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ক্রিকেট থেকে বিদায় জানানোর পর সব কিছু কঠিন মনে হতে শুরু করে। একটা সময় মনে হয়, আমার তো কিছুই করার নেই, বেঁচে থেকে কি লাভ! এটা খুব বিষণ্ণতায় ভোগায়। এটা নিয়ে এখনও সংগ্রাম করছি।’

প্রলয়ঙ্করী ঝড়ের শেষে নামে এক পশলা বৃষ্টি। সেই বৃষ্টির মাঝে মন খারাপ করে বসে আছেন ঝড় নামানো দানব।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...