তার মধ্যে এক কিংবদন্তির উত্থান দেখেছিলো বিশ্ব।
ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুসের একজন উত্তরসুরী দেখতে পেয়েছিলো সবাই। দূরন্ত গতিতে ছুঁটছিলেন তিনি। সারা পৃথিবী অপেক্ষায় ছিলো আরেকজন সর্বকালের সেরা দেখার জন্য। কিন্তু হায়! ফিক্সিংয়ের কালো অধ্যায়ে নিভে গেল আশার প্রদীপ। অন্ধকার কালো জগত থেকে ফিরে এলেন ঠিক। কিন্তু সেই কিংবদন্তি হয়ে ওঠা হল না মোহাম্মদ আমিরের।
মোহাম্মদ আমিরের নাম শুনলেই আপনার মনে হতে পারে লর্ডসের সেই কালো মেঘে ঢাকা ফিক্সিং কান্ডের কথা। কিন্তু সেটাকে পাশ কাটিয়ে যদি তাঁর প্রতিভা বা সামর্থ্য নিয়ে ভাবেন তাহলে বুঝতে পারবেন বিশ্ব ক্রিকেটে আমির ছিলেন ব্যাটারদের জন্য এক আতংকের নাম। খোদ পাকিস্তানি কিংবদন্তি তারকা ওয়াসিম আকরাম মনে করেন তাঁর চেয়ে বেশি প্রতিভা ছিলো আমিরের মাঝে!
পাকিস্তানের সম্ভাব্য সেরা পেসারদের মধ্যে একজন ধরা হত মোহাম্মদ আমিরকে। তাঁর বোলিং টেকনিক আর স্যুইংয়ে ওয়াসিম আকরামের ঝলকটা দেখা দিয়ে ছিল ক্যারিয়ারের শুরুতেই। নতুন বলে দুর্দান্ত ইনস্যুইং করতে পারেন তিনি।
১৩, এপ্রিল ১৯৯২ – রাওয়ালপিন্ডির গুজারখানে জন্মগ্রহণ করেন মোহাম্মদ আমির। পাঞ্জাবের সবচেয়ে বড় অঞ্চল হিসেবে বেশ পরিচিত এক জায়গা গুজরখান। সাত ভাই বোনের মধ্যে আমির ছিলেন ষষ্ঠ৷ বাবা রাজা মুহাম্মদ ফাইয়াজ একজন সাধারণ হতদরিদ্র মানুষ। অনেকটা কষ্ট করেই সংসার চালাতেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই পেশাদার ক্রিকেট খেলার স্বপ্ন দেখতেন আমির। তাই ছোটবেলা থেকেই তিনি ক্রিকেট অনুসরণ করতেন। প্রিয় বোলারও ছিলেন ওয়াসিম আকরাম।
টিভিতে পাকিস্তানের খেলা হলেই বসে পড়তেন ওয়াসিম আকরামের বোলিং দেখার জন্য আর ম্যাচ শেষে সেটা অনুসরণ করে নিজে আবার অনুশীলন করতেন।
গুজারখানের যে এলাকায় তিনি থাকতেন সেখানে খেলার কোনো মাঠ ছিল না। গ্রামের চারপাশে ছিল শুধু ফসলের ক্ষেত। কিন্তু আমির যে মনে মনে স্বপ্ন দেখেছিলেন ক্রিকেটার হবেন৷ তা পূরণের জন্য একমাত্র পথ ছিলো গ্রাম ছেড়ে শহরে আসা।
গ্রাম থেকে প্রায় ৫০ কি.মি দূরে ছিল রাওয়ালপিন্ডি শহর। বয়সে বেশ ছোট হওয়ায় পরিবার থেকেও সেখানে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি আমিরকে।
এরপর ২০০৩ সালে সব বাঁধা পেরিয়ে মাত্র ১১ বছর বয়সে রাওয়ালপিন্ডির একটি বড় অ্যাকাডেমিতে যাওয়ার সুযোগ পান আমির। বাজওয়া ক্রিকেট অ্যাকাডেমির স্যার আসিফ বাজওয়া এক লোকাল টুর্নামেন্টে তাঁকে দেখার পরই নিজের অ্যাকাডেমিতে খেলার সুযোগ করে দেন।
ওয়াসিম আকরাম সেসময় একটি পেস বোলিং হান্ট ক্যাম্পের জন্য পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের (পিসিবি) কাছে আবেদন করেন। আর এই আবেদনে সাড়া দিয়ে পিসিবি থেকে একটি ক্যাম্প আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন জেলার মধ্যে রাওয়ালপিন্ডিতেও তরুণ প্রতিভাবান পেসারদের খোঁজার জন্য আকরামের নেতৃত্বে একটি দল গেল। সেখানেই প্রথমবার আমিরকে বোলিং করতে দেখেন আকরাম।
সেখান থেকেই পালটে যায় আমিরের ক্যারিয়ার। আমিরের নজরকাঁড়া স্যুইংয়ে মুগ্ধ হয়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের জন্য অনূর্ধ্ব-১৯ দলে তাঁকে সুযোগ করে দেন আকরাম।
ওই সফরে দূর্দান্ত বোলিং করে ৮ উইকেট শিকার করে নিজের সামর্থ্যের ঝলক দেখান আমির। এরপর ঘরোয়া ক্রিকেটে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের হয়ে ৫৫ উইকেট শিকার করেন এই পেসার। সেই পারফরম্যান্সের পর ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের স্কোয়াডে রাখা হয় আমিরকে।সেবার পাকিস্তান প্রথমবারের মত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শিরোপা জয় করে।
১৭ বছর বয়সী আমিরের বোলিং দক্ষতা আর স্যুইং দেখে সেই বিশ্বকাপে বড় বড় ক্রিকেটারও অবাক হয়েছিলেন। গড়ে ১৪৫ কি.মি. গতিতে বোলিং করে সবার নজর কেঁড়েছিলেন তরুন আমির। ফাইনালে ব্যাট হাতে ভয়ংকর রূপ ধারণ করা তিলেকারত্নে দিলশানের উইকেট নেন তিনি। ওই ম্যাচে সর্বোচ্চ ১৫২ কি.মি. ঘন্টায় বল করে তাক লাগিয়ে দেন এই তরুণ পেসার।
৩০ জুলাই, ২০০৯। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেক হয় আমিরের। এরপর চার দিন বাদেই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্টেও অভিষেক হয় এই প্রতিভাবান তরুণের। অভিষেক টেস্টে তিনি শিকার করেন ৬ উইকেট। যার মধ্যে দুই ইনিংসেই কুমার সাঙ্গাকারা ও এক ইনিংসে মাহেলা জয়বর্ধনের মত তারকা ক্রিকেটারের উইকেটও ছিলো।
এরপর ২০১০ সালে অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের জন্য ডাক পান আমির। মোহাম্মদ আসিফের সাথে পেস বোলিং বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। সেখানে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মেলবোর্ন টেস্টে ৫ উইকেট শিকার করেন আমির! দাপুটে বোলিং দেখে সেবার আমিরকে প্রশংসায় ভাসিয়ে ছিলেন মি.ক্রিকেট খ্যাত অজি তারকা মাইক হাসি ও রিকি পন্টিং।
এরপরই সেই ইংল্যান্ড সিরিজ। কালো আঁধারে ডুবে থাকা লর্ডসের সেই ফিক্সিং কান্ড। ক্রিকেট ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়ের জন্ম হয়েছিল যে সিরিজে। সেখানে স্পট ফিক্সিংয়ের দায়ে অভিযুক্ত চার পাকিস্তানির একজন ছিলেন মোহাম্মদ আমির।
ফিক্সিংয়ের দায়ে ৫ বছরের নিষেধাজ্ঞা পেলেন৷ থমকে গেল সবকিছু। সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ারের অপমৃত্যু। নিজের উজ্জ্বল ক্যারিয়ারের প্রদীপ যেন নিজেই নিভিয়ে দিয়েছেন আমির। পাঁচ বছরের নিষেধাজ্ঞায় তারকা থেকে বনে গেলেন এক আক্ষেপ!
১৯ আগস্ট, ২০১৫। পাঁচ বছর সাজা কাটানোর পর এবার যেন মুক্তির পালা। উঠে গেল নিষেধাজ্ঞা। আবারও সব ধরনের ক্রিকেট খেলার অনুমতি পান আমির। অবশ্য তাঁর ফেরা নিয়ে অনেক বড় বড় পাকিস্তানি ক্রিকেটার বেশ নাখোশ ছিলেন। অনেকেই চাননি এমন কান্ডের পর আমিরকে আর জাতীয় দলে সুযোগ দেওয়া হোক।
১৫ই জানুয়ারি, ২০১৬। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি ম্যাচ দিয়ে পুনরায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রত্যাবর্তন আমিরের। একই বছর ২০১৬ সালে পাকিস্তান সুপার লিগে (পিএসএল) করাচি কিংসের হয়ে খেলার সুযোগ পেয়ে হ্যাট্রিক করেন আমির৷
২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফির কথা নিশ্চয়ই সবার মনে আছে? ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে আমিরের সেই দুর্দান্ত স্পেল! অগ্নিঝরা বোলিংয়ে সেদিন আমিরের সামনে অসহায় আত্মসমর্পণ করে ভারতের টপ অর্ডারের। টপ অর্ডারের তিন তারকা শিখর ধাওয়ান, রোহিত শর্মা, ও বিরাট কোহলিকে স্যুইং এর তালে নাঁচিয়েছিলেন আমির। তাঁর ম্যাজিকেল স্পেলে ভারতকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জয় করে পাকিস্তান।
শোয়েব আক্তারের মত আক্রমণাত্মক পেসার হিসেবেই বেশ পরিচিতি পেয়েছিলেন আমির। ২০১০ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে এক ওভারে তিন উইকেট ও দুই রান আউট সহ মেইডেন দিয়ে ৫ উইকেট শিকার করেন আমির! এক ওভারে ৫ উইকেট শিকারের মধ্যে দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ওভারে সবচেয়ে বেশি উইকেট ফেলার বিশ্বরেকর্ড গড়েন আমির।
১২ই জুন, ২০১৯। বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলতে নেমে প্রথমবারের মতো ওয়ানডেতে পাঁচ উইকেট শিকার করেন এই পেসার। সেবার আট ম্যাচে ১৭ উইকেট নিয়ে ওই বিশ্বকাপে পাকিস্তানের হয়ে সেরা বোলার নির্বাচিত হন তিনি।
২০১৯ সালের জুলাইতে হুট করেই টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দেন আমির। ৩৬ টেস্টে ১১৯ উইকেট শিকার করা আমির সাদা পোশাককে বিদায় জানানোর এক বছরের মাথায় ১৭ই ডিসেম্বর ২০২০ সালের নির্বাচক প্যানেলের উপর ক্ষুব্ধ হয়ে হঠাৎ করেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দেন। যদিও তিনি ঘরোয়া ক্রিকেট এবং ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট চালিয়ে যাবেন বলে জানান।
ওয়াসিম আকরামের মত প্রতিভা নিয়ে আসা আমির লর্ডসে ফিক্সিং কান্ডে জড়িয়ে নিজের সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ারের টুটি চেপে ধরেন। ক্যারিয়ার শেষে সেরাদের কাতারে থাকবেন এমন সামর্থ্য আর সম্ভাবনা সবটাই ছিল আমিরের মাঝে।
সামর্থ্য আর প্রতিভার সবটুকু দিতে পারলে নিঃসন্দেহে বিশ্বক্রিকেটে নিজেকে সেরাদের তালিকায় রেখে যেতে পারতেন। শুধু পাকিস্তান ক্রিকেটই নয় বিশ্ব ক্রিকেটেও আমিরের মতোন প্রতিভাবান খুব কমই আসে। পাকিস্তান ক্রিকেটে সবচেয়ে বড় আক্ষেপের একটি হয়ে থাকবেন আমির!