গুরু ডেভ

কাঁচাপাকা চুলের এক ভদ্রলোক বিমানবন্দর থেকে শ্রীলঙ্কা দলের পিছনে বের হলেন। লংকানদের এই বিশ্বজয়ের বীজটা পুঁতে দিয়েছিলেন তিনি। দলটির হেডকোচ ডেভ হোয়াটমোরই আসলে বদলে দিয়েছেন দেশটির ক্রিকেটের ইতিহাস। বলতে গেলে এই দলটাকে নিয়ে তিনি একটা ক্রিকেট সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিলেন।

ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর গল্পগুলোর একটি ছিল শ্রীলঙ্কার বিশ্বজয়। ১৯৯৬ সালে লাহোরের গাদ্দাফী স্টেডিয়ামে সেই গল্পগুলো গেঁথে ছিলেন অর্জুনা রানাতুঙ্গারা। বিশ্বজয় করে যখন দেশে ফিরেছেন তখন বিমান বন্দর থেকে রাষ্ট্রপতির বাসভবন পর্যন্ত ছিল জনতার ঢল। রানাতুঙ্গাদের একবার দেখার জন্য সে কী আকুতি। তবে গল্পগ্রন্থের অন্যতম গল্পকার ছিলেন সবার আড়ালেই।

কাঁচাপাকা চুলের এক ভদ্রলোক বিমানবন্দর থেকে শ্রীলঙ্কা দলের পিছনে বের হলেন। লংকানদের এই বিশ্বজয়ের বীজটা পুঁতে দিয়েছিলেন তিনি। দলটির হেডকোচ ডেভ হোয়াটমোরই আসলে বদলে দিয়েছেন দেশটির ক্রিকেটের ইতিহাস। বলতে গেলে এই দলটাকে নিয়ে তিনি একটা ক্রিকেট সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিলেন।

ডেভ হোয়াটমোরের জন্ম আসলে এই শ্রীলঙ্কাতেই। ১৯৫৪ সালে কলম্বো শহরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। এরপর ১৯৬২ সালে তাঁর পরিবার পাড়ি জমায় অস্ট্রেলিয়ায়। এরপর সেখানেই বেড়ে ওঠা এই ক্রিকেটারের। এরপর ১৯৭৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও নাম লেখান। ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান স্লিপ ফিল্ডার হিসেবেও ছিলেন দারুণ।

তবে নিজের ক্রিকেটীয় ক্যারিয়ারটা খুব বেশি লম্বা করতে পারেননি। অজিদের হয়ে মাত্র ৭ টি টেস্ট ও ১ টি ওয়ানডে ম্যাচেই থেমে যায় তাঁর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। এরপর অবশ্য আরো দশ বছর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলেছেন। তবে ডেভ হোয়াটমোরের নিজের জীবনের মূল চিত্রনাট্যটা লিখেছেন কোচিং ক্যারিয়ারে এসে।

১৯৮৯ সালে কোচিং করানোর জন্যই ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়ে নেন। এরপর দুই দফায় শ্রীলঙ্কা দলের দায়িত্ব নেন। তবে ডেভ হোয়াটমোর ইতিহাসটা লিখেছিলেন প্রথম দফাতেই। ১৯৯৬ সালে একটা আনকোরা দল হিসেবেই বিশ্বকাপ খেলতে গিয়েছিল অর্জুনা রানাতুঙ্গারা। শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটাররা মাঠে তাঁদের সেরাটা নিঙরে দিয়েছেন ঠিকই তবে মাঠের বাইরে ছকটা একে দিয়েছিলেন এই অজি ক্রিকেটারই।

শ্রীলঙ্কা দলটায় সেই নব্বইয়ের দশকে এসেই ফিটনেসে জোর দিয়েছিলেন। পেশাদারিত্ব ও ফিটনেসের বীজ রোপন করেছিলেন। প্রতিটি ম্যাচের আগে এবং পরে প্রতিপক্ষ দলগুলো নিয়ে বিস্তর বিশ্লেষণ করতেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে একবার বলেছিলেন, ‘ম্যাচের আগে প্রতিপক্ষ দল নিয়ে চুল-চেরা বিশ্লেষণ করা হতো। পুরনো ভিএইচএস টেপে রেকর্ড করা ভিডিও ফুটেজ চালিয়ে প্রতিপক্ষের ক্রিকেটারদের শক্তি এবং দুর্বলতা নিয়ে কথা হতো। প্রতিটি প্রতিপক্ষ দল নিয়েই আমরা এটা করতাম।’

এমনকি বিশ্বকাপ জয়ের পর শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি অবধি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতা জানাতে ভোলেননি। গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত শ্রীলঙ্কার জন্য ওই বিশ্বকাপটা যে কতটা বড় প্রাপ্তি ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এছাড়া ওই বিশ্বকাপই দেশটির ক্রিকেট সংস্কৃতি গড়ে দিয়েছিল। দেশটিকে ক্রিকেট বিশ্বের পরাশক্তি করে তোলে। বিশ্বকাপ জয়ের পর লংকান প্রেসিডেন্ট তাই বলেছিলেন, `দলের এ সাফল্যে দেশ যারপরনাই গর্বিত।’  প্রেসিডেন্টের কাছে অভিনন্দন বার্তা হোয়াইটমোরের আসলে প্রাপ্য ছিল। এই সাফল্যের নেপথ্যের সবচেয়ে বড় কারিগর তো তিনিই।‘

তবে কোচ ডেভ হোয়াটমোরের উপখ্যান এখানেই থামে না। এই ভদ্রলোক আরেকটি দেশে ক্রিকেট সংস্কৃতি গড়ে তুলতে কাজ করেছেন। আজ বাংলাদেশ ক্রিকেট যে জায়গাটায় দাঁড়িয়ে গর্ব করে উঠে তাঁর ভিত্তি করে দেয়ার অন্যতম কারিগর ছিলেন এই কোচ।

বাংলাদেশ তখন ক্রিকেটবিশ্বে নিতান্তই পুচকে এক দল। তবুও এই দলটাকে জয়ের জন্য লড়তে শিখিয়েছিলেন ডেভ। তিন কোচ হয়ে আসার পর প্রায় পাঁচ বছর পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে জয়ের দেখা পায় বাংলাদেশ। এরপর ২০০৭ ওয়ানডে বিশ্বকাপেও বাংলাদেশ তাঁদের সেরা ক্রিকেটটাই খেলেছিল। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ যে ক্রিকেট বিশ্ব দাপিয়ে বেড়াতে পারে সেই বিশ্বাসটা প্রথম ছড়িয়ে দিয়েছিলেন এই কোচই।

এরপর পাকিস্তান ক্রিকেট দলকেও কোচিং করিয়েছেন তিনি। তাঁর সময়ে ২০১২ এশিয়া কাপ জিতেছিল পাকিস্তান। এছাড়া ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের ফ্র্যাঞ্চাইজি গুলোর জন্যও বেশ পছন্দের কোচ তিনি। মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স, কলকাতা নাইট রাইডার্সের মত দলগুলোকে কোচিং করিয়েছেন তিনি। বলা ভালো, দেশগুলোতে ক্রিকেটীয় সংস্কৃতি গড়ে তুলতে ভূমিকা রেখেছেন তিনি।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...