তিনি গ্রেট ছিলেন না বটে, কিন্তু…

রক্তে তামিল বংশ, চাপা গায়ের রঙ আর ছিপছাপ গড়নের ‘রাস্টি’। বন্ধু রোশন মহানামা আর প্রমোদ্যা বিক্রমাসিংহের দেয়া ‘রাস্টি’ ডাকনামটার পরিচিতি খুব বেশি নয়। সেটাই তো হওয়া স্বাভাবিক। আমাদের সাকিব আল হাসানকে কি আর বিশ্ব ক্রিকেট ‘ময়না’ নামে চেনে? নিশ্চয়ই নয়। তাই রাসেল আর্নল্ডকেও ‘রাস্টি’ নামে চেনা মানুষের সংখ্যা কম।

রক্তে তামিল বংশ, চাপা গায়ের রঙ আর ছিপছাপ গড়নের ‘রাস্টি’। বন্ধু রোশন মহানামা আর প্রমোদ্যা বিক্রমাসিংহের দেয়া ‘রাস্টি’ ডাকনামটার পরিচিতি খুব বেশি নয়। সেটাই তো হওয়া স্বাভাবিক। আমাদের সাকিব আল হাসানকে কি আর বিশ্ব ক্রিকেট ‘ময়না’ নামে চেনে? নিশ্চয়ই নয়। তাই রাসেল আর্নল্ডকেও ‘রাস্টি’ নামে চেনা মানুষের সংখ্যা কম।

রাসেল আর্নল্ড, লঙ্কান এই সাবেক ক্রিকেটারের বর্তমান পরিচিতি ক্রিকেট ধারাভাষ্যকর হিসেবে। শ্রীলঙ্কার ম্যাচ মানেই ধারাবিবরণী কক্ষে পরিচিত এক মুখের নাম রাসেল আর্নল্ড। মুখের সামনে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে শ্রীলঙ্কাকে প্রতিনিধিত্ব করা রাসেল আর্নল্ড রীতিমত হয়ে উঠেছেন এ কালের ভয়েস অব শ্রীলঙ্কা। তবে ধারাভাষ্যকার রাসেল আর্নল্ড এক সময় মাঠের ক্রিকেটেও শ্রীলঙ্কাকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। বাইশ গজের পিচে সামলেছেন বহু বোলার। কোনো কোনো সময় নিজেই হাতে তুলে নিতেন বল। ডান হাতে অফ ব্রেকটা তিনি খারাপ করতেন না। তবে ক্রিকেটার হিসেবে রাসেল আর্নল্ডের যাত্রাটা ছিল প্রচুর পরিশ্রম আর নিবেদনে পূর্ণ।

১৯৯২ সাল থেকে একাধারে ঘরোয়া ক্রিকেটে পারফর্ম করে যাচ্ছিলেন। তবুও সুযোগ পাচ্ছিলেন না। অবশেষে ১৯৯৭ সালে জাতীয় দলে জায়গা পান। অবশ্য ঘরের মাঠে পাকিস্তানের বিপক্ষে সে সিরিজে সুযোগ পেয়েছিলেন রিজার্ভ খেলোয়াড় হিসেবে। সে সিরিজ শুরুর আগে হঠাৎই অনুশীলনের সময় লঙ্কান ওপেনার রোশান মহানামা বুড়ো আঙুলে আঘাত পান।

ইনজুরির কারণে সে সিরিজ থেকে ছিটকে পড়েন তিনি। তাঁর রিপ্লেসমেন্টের জন্য টিম ম্যানেজমেন্টের কাছে অপশন ছিল দুটি। একজন চান্দিকা হাথুরুসিংহে আরেকজন রাসেল আর্নল্ড। সে সময় সবার প্রথম পছন্দ হাতুরুসিংহে হলেও টিম কম্বিনেশনের কারণে সুযোগ পেয়ে যান রাসেল আর্নল্ড। কারণ রোশান মহানামার জায়গায় একজন ওপেনার দরকার ছিল। আর রাসেল আর্নল্ড নিজেও ছিলেন ওপেনার।

কলম্বো টেস্ট শুরুর আগে ওয়ার্ম আপ ম্যাচ। ইনিংসের কয়েক ওভার না গড়াতেই পাকিস্তানের পেসার মোহাম্মদ জাহিদের বলে প্রথম স্লিপে দিলেন ক্যাচ রাসেল আর্নল্ড। পরে দেখা গেল, বলটি ছিল নো বল। তাই এ যাত্রায় বেঁচে যান তিনি। তবে সময় গড়াতেই নিজের খোলস থেকে বের হতে শুরু করেন রাসেল আর্নল্ড। শেষ পর্যন্ত থামেন ১৪০ রানে।

ওয়ার্ম আপ ম্যাচে এমন দারুণ ইনিংসের পর কলম্বো টেস্টে সরাসরি একাদশে ঢুকে যাওয়াটা রাসেলের জন্য সময়ের ব্যাপার ছিল মাত্র। হয়েছিলও তাই। সনাথ জয়সুরিয়ার সাথে ওপেন করতে নেমে রান করেছিলেন ২৪ টি। যদিও হঠাৎ সুযোগ পাওয়া টেস্টে ৮২ বলে করা ঐ ছোট্ট ইনিংসটাই ছিল বেশ স্পেশাল।

শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটে তখন স্বর্ণযুগ। বিশ্বকাপ জেতার পরে রোশান মহানামা, জয়সুরিয়া, আতাপাত্তুদের নিয়ে গড়া দলটা এক কথায় দুর্দমনীয়। তাই ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত রাসেল আর্নল্ডকে ব্যাক আপ ওপেনার হিসেবেই ব্যবহার করা হত। এজন্য শ্রীলঙ্কার হয়ে একাদশে খেলার সুযোগ পেতেন কম।

টেস্টের মত ওয়ানডেতেও ওপেনার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন রাসেল আর্নল্ড। কিন্তু সেখানেও সমস্যা। সে সময়ের কোচ ডেভ হেয়াটমোর তাই একটা উপায় বের করলেন। তিনি মনে করলেন, রাসেল আর্নল্ডকে নিচে খেলানো উচিত এবং সেখানেই সে ভাল করবে। কোচের কথামত রাসেল আর্নল্ডের ব্যাটিং পজিশন চলে গেল ৬ এ। ১৯৯৯ সালে কোকাকোলা চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ফাইনালে উঠল শ্রীলঙ্কা। সে ম্যাচটা শ্রীলঙ্কা হেরে গেলেও ছয়ে নেমে অপরাজিত ২৭ রানের এক ইনিংস খেলেন রাসেল আর্নল্ড। আর এর পর থেকেই লঙ্কান দলের মিডল অর্ডারে অন্যতম ব্যাটিং স্তম্ভ হয়ে ওঠেন তিনি।

১৯৯৯ সালের জিম্বাবুয়ে সফর। এ সফরের ওয়ানডে সিরিজটা একদম স্বপ্নের মতে কেটেছিল রাসেলের। প্রথম ম্যাচ বৃষ্টিতে পরিত্যাক্ত হয়ে গেলেও খেলেছিলেন ৫৩ বলে ৫৬ রানের ইনিংস। পরের ম্যাচ, বুলায়ওয়ের কঠিন উইকেটে। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ৬৬ রানে নেই ৫ উইকেট। রাসেল আর্নল্ড যেন সেদিন সেখান থেকেই শুরু করলেন। ১২১ বলে করলেন ১০৩ রান। তার ঐ ইনিংসেই ৬৬/৫ থেকে ২১৩ রানের পুঁজি পায় লঙ্কানরা। শ্রীলঙ্কা সে ম্যাচটি জিতেছিল ১৩ রানে। মূলত ঐ সিরিজের মাধ্যমেই মিডল অর্ডারে রাসেল আর্নল্ডের লম্বা ইনিংস খেলার সক্ষমতা প্রমাণিত হয়। এর পর থেকে রাসেল আর্নল্ড হয়ে যান পুরোদস্তুর মিডল অর্ডার ব্যাটার।

পুরো ক্যারিয়ারে ওয়ানডে ফরম্যাটেই বেশি সফল ছিলেন রাসেল আর্নল্ড। ১৮০ ওয়ানডেতে ৩৫.২৬ গড়ে করেছেন ৩৯৫০ রান। এর বিপরীতে টেস্টে ছিলেন অনিয়মিত। শ্রীলঙ্কার হয়ে খেলেছেন ৪৪ টা ম্যাচ। তিন সেঞ্চুরি সহ রান করেছেন ১৮২১। তিন সেঞ্চুরির প্রথমটা এসেছিল লাহোরে। আর দ্বিতীয়টা হারারেরে তে। তবে রাসেল তার ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংসটা খেলেছিলেন ২০০২ সালে, ম্যানচেস্টারে। মার্ক বুচার আর এলেক স্টুয়ার্টের সেঞ্চুরিতে প্রথম ইনিংসেই ইংল্যান্ডের ৫১২ রানের পাহাড়সহ সংগ্রহ।

জবাবে ইনিংসের শুরুতেই দুই ওপেনারের উইকেট হারিয়ে ফেলে শ্রীলঙ্কা। আর্নল্ড এক প্রান্ত থেকে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু তার ৬২ রানের ইনিংসও শ্রীলঙ্কাকে ফলো অন থেকে আটকাতে পারেনি। শ্রীলঙ্কা আবারও ব্যাট করতে নামে। কিন্তু আগের ইনিংসের পুনরাবৃত্তি হয় দ্বিতীয় ইনিংসেও। তবে রাসেল আর্নল্ড ২৩৬ বলে ১০৯ রানের এক ইনিংস খেলে শ্রীলঙ্কাকে ইনিংস হারের লজ্জা থেকে রক্ষা করেন। শ্রীলঙ্কা সেই ম্যাচ হেরেছিল ঠিকই। কিন্তু ইংলিশ দুর্গে দুই ইনিংসেই আর্নল্ডের সাহসী ইনিংস রাসেল আর্নল্ডকে নতুন করে চিনিয়েছিল।

২০০৩ বিশ্বকাপে নিজের জাত চেনাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন রাসেল আর্নল্ড। বোলিংয়ে কিছুটা পারফর্ম করলেন তাঁর মূল প্লেয়িং রোল ব্যাটিংয়ে পারফর্ম করতে মোটাদাগে ব্যর্থ হন।   একাদশ থেকেও বাদ পড়ে যান তিনি। বয়স ত্রিশ পেরিয়েছে তখন। এমন সময়ে দল থেকে বাদ পড়ে গেলে ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা কম। তার উপর সে সময়ের নির্বাচকরা ভবিষ্যত ক্রিকেটার তৈরির জন্য সুযোগ দিচ্ছিল তরুণ ক্রিকেটারদের। তাই আর্নল্ডের জন্য চ্যালেঞ্জটা বেশ কঠিন হয়ে যায়।

তবে, দল থেকে বাদ পড়ার হতাশায় নুয়ে না পড়ে রাসেল আর্নল্ড আবার নতুন করে মনযোগ দিলেন ক্রিকেটে। আবারও পারফর্ম করে দলে ফিরে এলেন তিনি। দলে ফিরেই ইন্ডিয়ান ওয়েল কাপের ফাইনাল ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে খেললেন ৬৪ রানের ইনিংস। শ্রীলঙ্কা সে ফাইনাল ম্যাচটি জিতেছিল ১৮ রানে।  এর পরে ভারতের বিপক্ষে ৭ ম্যাচ সিরিজে তার ৪৭ বলে ৪৯ রানের ইনিংসের কল্যাণেই প্রথম ম্যাচটি জিতেছিল শ্রীলঙ্কা।

ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি রাসেল আর্নল্ড ডান হাতে অফ ব্রেকটা ভালই করতেন। ওয়ানডেতে ৪.৮৩ ইকোনমিতে ৪০ টা উইকেট সেটাই প্রমাণ করে। টেস্টে যদিও খুব একটা বোলিং করেন নি। ২৮ ইনিংস বল হাতে নিয়ে পেয়েছিলেন ১১ টা উইকেট।

রাসেল আর্নল্ডকে শেষ বার লঙ্কান জার্সিতে দেখা যায় ২০০৭ বিশ্বকাপের ফাইনালে।  ১৯৯৬ বিশ্বকাপের পরে সেবার শ্রীলঙ্কার সামনে সুযোগ ছিল আবারও শিরোপা উঁচিয়ে ধরার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা হয়নি। পুরো বিশ্বকাপে দুর্দান্ত ক্রিকেট খেলা শ্রীলঙ্কা শেষ পর্যন্ত ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে যায়। ফাইনাল ম্যাচে শ্রীলঙ্কার ইনিংসে ৭ নম্বরে ব্যাট করতে আসেন রাসেল আর্নল্ড।

গ্লেন ম্যাকগ্রার লেগ সাইডের একটি বল ফ্লিক করতে গিয়েই গিলক্রিস্টের কাছে ক্যাচ দিয়ে ফেলেন আর্নল্ড। ক্যারিয়ারের শেষ ইনিংসটা তাই রাঙাতে পারেননি রাসেল আর্নল্ড। সেদিন প্যাভিলিয়নে ফিরেছিলেন ব্যক্তিগত ১ রানে। কিন্তু তার আক্ষেপটা নিশ্চয় অন্য জায়গায়। বিদায় বেলায় বিশ্বকাপ জেতার সুবর্ণ সুযোগ যে হাত ছাড়া হয়েছিল সে দিন। এ আক্ষেপ বোধহয় তাকে এখনও পোড়ায়।

পরিসংখ্যান বিবেচনায় রাসেল আর্নল্ড সাদামাটা এক ক্রিকেটারের নাম। শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটে অর্জুনা রানাতুঙ্গা, মারভান আতাপাত্তু, মাহেলা জয়াবর্ধনে, কুমার সাঙ্গাকারা, মুত্তিয়া মুরালিধরন, চামিন্দা ভাসদের মত গ্রেটদের তালিকায় হয়তো তিনি আসবেন না। কিন্তু তার প্রচণ্ড পরিশ্রমী মানসিকতা আর ক্রিকেটীয় একাগ্রতা যে এ সময়ের উঠতি ক্রিকেটারদের জন্য অনুপ্রেরণার রসদ হতে পারে- সেটা নি:স্বন্দেহে বলা যায়।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...