দ্য সাইলেন্স অফ দ্য ল্যাম্বস

লাঞ্চ করে আরও দুটো স্পট দেখতে যাওয়ার কথা। কিন্তু একটু উইক লাগছে বলে বাকিদের বললাম আমি দুপুরটা একটু রেস্ট নি, তোমরা ঘুরে এস। মা এবং স্ত্রী তেমন আপত্তি করল না। শুধু ছেলে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাঁকাল। ওর দিকে চোখ নাচিয়ে বললাম, ইন্ডিয়া – পাকিস্তানের ম্যাচ হচ্ছে। ইন্ডিয়ার ব্যাটিং শুরু হতে চলল।

কয়েকদিন আগে অমরকন্টক থেকে ঘুরে এলাম। সুন্দর জায়গা। দর্শনীয় জলপ্রপাতের সঙ্গে তীর্থস্থানের আকর্ষিণীয় পার্টনারশিপ। তবে আমার কাছে জলপ্রপাত দর্শন তেমন সুখের হল না। দেখে ফেরার সময় মাথা ঘুরতে লাগল। বেশ কিছুক্ষন চোখ বন্ধ করে বসে, বাড়ির লোকজনদের টেনশান বাড়িয়ে শেষ অব্দি ধুঁকতে ধুঁকতে হোটেলের রুমে ফিরলাম।

লাঞ্চ করে আরও দুটো স্পট দেখতে যাওয়ার কথা। কিন্তু একটু উইক লাগছে বলে বাকিদের বললাম আমি দুপুরটা একটু রেস্ট নি, তোমরা ঘুরে এস। মা এবং স্ত্রী তেমন আপত্তি করল না। শুধু ছেলে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাঁকাল। ওর দিকে চোখ নাচিয়ে বললাম, ইন্ডিয়া – পাকিস্তানের ম্যাচ হচ্ছে। ইন্ডিয়ার ব্যাটিং শুরু হতে চলল।

‘আমিও যাব না, বাবার কাছে থেকেই যাই।’

থেকে তো গেলাম কিন্তু কিছুক্ষন ম্যাচ দেখে মনে হচ্ছে এবার ঘুমিয়ে পড়লেই ভাল হয়। শুধু একটা সান্ত্বনা – বিরাট এখনও ক্রিজে। সঙ্গে হার্দিক। এই ছেলেটা মাঝে মধ্যে ধমাকেদার পারফর্মেন্স দেয় বটে কিন্তু সেই মাঝে মধ্যেটা বেশ রেয়ার।

ওদিকে বিরাট ধীরে সুস্থে শেকড় ছড়াচ্ছে। তারপর খোলস ছেড়ে বেরিয়ে বোলারের মাথার ওপর দিয়ে একটা সোজা ছয় মারল। তারপর একটা স্কয়ার ড্রাইভ – খেলার পর এ বি’র স্টাইলে মাথার ওপর ব্যাট ঘুরিয়ে আস্ফালন। লঙ লেগের পাশ দিয়ে নটরাজ শট। এটার কপিরাইট অবশ্য আমার প্রিয় ক্রিকেটারের। তারপর ওই এলাকা দিয়েই আরও একটা বাউন্ডারি।

‘এটা কানায় লেগেছে।’ ছেলে মন্তব্য করল।

‘উঁহু, আমার তো মনে হচ্ছে বেশ কন্ট্রোলের সঙ্গেই ফ্লিক করল। একটু দাঁড়া, রিপ্লে দেখে বোঝা যাবে।’

ঠিকই। ফুল লেন্থের বলকে এগিয়ে এসে ফুলটস করে ব্যাটের মাঝখান দিয়েই শটটা খেলেছে বিরাট। আমার চোখের অবস্থা বিশেষ ভাল নয়, তবু বিরাট যে শটটা ঠিকঠাক খেলেছে সেটা বুঝলাম শট খেলার পর বলকে অনুসরণ করে ওর দৃষ্টি দেখে। এটা তখনই ঘটে যখন যেদিকে শট খেলতে চাইছে, সেদিকেই বল যায়।

এবার কাভারের ওপর দিয়ে একটা এক হাতে খেলা অসাধারণ শট – তিনটে ফিল্ডারকে খামখা ছুটিয়ে বল সীমানা পেরল। বেটা পন্থ, আমিও পারি!

সে তো হল, কিন্তু আস্কিং রেট তো বেড়েই চলেছে। শেষ তিন ওভারে ১৬ গড় দরকার। একসময় হয়ত বিরাট পারত, কিন্তু এই বিরাট কি পারবে? এখন যদি হার্দিক দুই একটা বড়সড় শট খেলে।

কিন্তু কাজের বেলায় দেখা গেল দুরন্ত গতির বিরুদ্ধে হার্দিকও স্বচ্ছন্দ নয় একেবারেই। যেখানে আমরা চার – ছয়ের জন্য হা পিত্যেশ করছি, সেখানে ও ডট বল খেলছে। এর মধ্যে কখন যেন মন্দির দর্শন করে মনীষা ও মা ফিরে এসেছে। এবং ফেরা মাত্র মনীষা ভারতের প্লেয়ারদের মুণ্ডপাত আরম্ভ করে দিল। এঁরা মাঠে নামে কি করতে? টিভিতে অ্যাড করুক গণ্ডায় গণ্ডায়।

৮ বলে ২৮ রান। এর মধ্যে রাউফের দুটো বল – দুরন্ত গতিতে বল করে এখনও পর্যন্ত যে ওভার প্রতি চার রানের সামান্য বেশি দিয়েছে।

টিভিতে দেখাচ্ছে এখনও পর্যন্ত ১৭ বার টি-টোয়েনটি ম্যাচে রান তাড়া করে নট আউট থেকেছে বিরাট। ১৭ বারই ভারত জিতেছে। কিন্তু এই ধরনের রেকর্ড তৈরিই হয় একদিন ভাঙবে বলে।

‘হয়ত নিজের রেকর্ড ঠিক রাখতে এবার ও আউট হয়ে যাবে।’ ছেলের মুখ থেকে এক্সপার্ট মন্ত্যব্য বেরিয়ে এল।

রউফের ওভারের পঞ্চম বল – অফ স্ট্যাম্পের ওপর শর্ট অফ লেন্থ। এই বলে দুটো অ্যাট্যাকিং শট খেলা যেতে পারে। এক, পুল। তবে এক্ষেত্রে টাইমিং এবং প্লেসিং দুটোই দুর্দান্ত না হলে বড়জোর দুই কি তিন রান। দুই, স্কয়ার কাট। কিন্তু বিরাটের যা উচ্চতা তাতে এই শটে ও তেমন জোর পাবে না।

বিরাট অবশ্য তৃতীয় একটা শট আবিষ্কার করলো – সোজা ব্যাটে ও বলটা তুলে দিল বোলারের মাথার ওপর দিয়ে। কিন্তু এই শট কতদুরেই বা যাবে?

‘বিরাট গোজ আউট অফ দ্য গ্রাউন্ড!’ মূল ধারাভাষ্যকারের উচ্ছ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে আরও একটা মৃদু স্বর টিভির ভেতর থেকে কানে এল – ‘ওয়াও’।

বিরাট সামান্য জিভ বের করে তখন ক্যামেরার জন্য পোজ দিচ্ছেন, দৃষ্টি উড়ন্ত বলের দিকে নিবদ্ধ। ও যেন নিজের কীর্তিতে নিজেই চমৎকৃত।

৭ বলে ২২। আরও একটা যদি এরকম শট!

বিরাট সম্ভবত আশা করেছিল রাউফ পরের বলটা ফুল লেন্থের দেবে। সেইমত একটা স্ট্রাইড নিয়ে ও তৈরি ছিল। কিন্তু রাউফ আবার শর্ট বল দিল – তবে আগেরটার চেয়ে দ্রুতগতিতে। এবার বিরাটের শক্তিশালী কব্জির কামাল দেখা গেল। বলের গতিপথ অনুসরণ করে শেষতম খণ্ডিত মুহূর্তে বলটাকে লঙ লেগের ওপর ও তুলে দিল। আবার বিশাল ছক্কা।

‘শালাহ!’ আমার আর ছেলের মুখ থেকে একসঙ্গে বেরিয়ে এল। ও নাহয় যাদবপুর, কিন্তু আমি? অবশ্য আমিও এক সময় এয়ার ফোর্সে ছিলাম।

লাস্ট ওভারে ১৬ রান দরকার। আর তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কথাটা হল পাকিস্তানের ফাস্ট বোলারদের কোটা শেষ, এবার স্পিনার বল করবে। এবার যদি হার্দিক হাত খোলে। কিন্তু মন এটাও বলছে যে হার্দিক শুধু এক রান নিয়ে বিরাটকে স্ট্রাইক দিক। বাকি কাজ ও তিনটে বলের মধ্যে সেরে ফেলবে।

কিন্তু হার্দিক পাশ্বচরিত্রে অভিনয় করে সন্তুষ্ট নয়। ও একটা ছয় মারবে। কাজের বেলায় অবশ্য দেখা গেল মিস্টাইম হয়ে লোপ্পা ক্যাচ তুলে ফিরে আসছে হার্দিক।

‘যাক, বিরাট অন্তত স্ট্রাইক পেল।’

বোঝা গেল, ছেলে ক্রিকেটের রিসেন্ট পরিবর্তনের ব্যাপারে জানে না। ওকে বোঝালাম এখন আর ক্যাচ আউট হলে ব্যাটসম্যানদের স্ট্রাইক চেঞ্জ হয় না (আমিও যে খুব আপ টু ডেট সে রকম দাবী করছি না কিন্তু ব্যাটসম্যানকে ব্যাটার বলার চল হয়েছে এটা জানি। শব্দটা পছন্দ নয় বলে ব্যবহার করি না।)

এবার বুক চিতিয়ে মাঠে নামলেন দীনেশ কার্ত্তিক। আই পি এলে বেশ কয়েকটা ধমাকেদার ইনিংস খেলে ইনি বেশ নাম করেছেন। দীনেশ একটা রান নিয়ে বিরাটকে স্ট্রাইক দিলেন। তা বেশ করলেন কিন্তু ৪ বলে ১৫ রান – ইকয়েশান খুব একটা ভরসা যোগাচ্ছে না। পরের বলে দুই রান এল। আস্কিং রেট তাতে বাড়ল বই কমল না। তিনটে বলের মধ্যে অন্তত দুটো বাউন্ডারি চাই। সম্ভব কিন্তু প্রত্যাশিত কি?

পরের বল কোমর সমান উঁচু ফুলটস। সপাটে ব্যাট চালালেন বিরাট। প্রত্যাশা মতই ফিল্ডারের নাগাল এড়িয়ে বল সীমানার বাইরে। ছক্কা!

বিছানায় বসে লাফালাফির মধ্যে দেখতে পেলাম বিরাট কী নিয়ে যেন অভিযোগ করছেন আম্পায়ারের কাছে। তবে কি চার রান দিয়েছে?

একটু পরেই ক্লিয়ার হল। একশন রিপ্লেতে দেখলাম শটটা মারা মাত্রই, বলের সীমানা পেরোতে তখনও বহু দেরি, বিরাট দুই হাত তুলে আম্পায়ারের কাছে ‘নো’ বলের আবেদন করছেন। বিরাটের আবেদনে সাড়া দিয়ে আম্পায়ার বলটাকে ‘নো’ ডেকেওছেন। বেচারির তেমন দোষও নেই, বিরাটের এবং দর্শকদের হাবভাব দেখে ওর মনে হওয়া স্বাভাবিক যে মাঠটা বিরাটের বপৌতি সম্পত্তি। এই অবস্থায় ওর আবেদন আদেশের সমান। অবশ্য রিপ্লেতে দেখা গেল ডিসিজন তেমন ভুলও নয়।

‘এর মাথাটা আলাদা লেভেলেই চলে। আমরা তো ছক্কা মেরেই আনন্দে আত্মহারা হতাম। এ আবার তার ওপর ‘নো’ বল আদায় করে নিল।‘ ছেলে হাসতে হাসতে বলল।

ঠিকই। কিন্তু যে বলে ছয় মারা যায় সেই বল ‘নো’ হয় কি করে? থাক, এসব চিন্তা করার জন্য অনেক বড় বড় মাথা আছে। বরং ফ্রি হিটটা মন দিয়ে দেখি। এতে যদি একটা বাউন্ডারি আসে তাহলে খেলা প্রায় শেষ।
পরের বল ওয়াইড করে বসলেন নাওয়াজ। একটা অতিরিক্ত রানই শুধু এল না, ফ্রি হিটও বজায় রইল।

কিন্তু এবার বোল্ড হয়ে গেলেন বিরাট। যাহ্‌, এত ভাল একটা সুযোগ। ওদিকে বিরাট কিন্তু ছুটছেন। এক …দুই… তিন……। কিন্তু বোল্ড হওয়ার পর বল ডেড হয়ে যাবে না? আর বেচারি বোলারের কথা চিন্তা করুন। একে তো নো বলে ছক্কা, তারপরে ফ্রি হিটের বলে ব্যাটসম্যানকে বোল্ড করেও তিন রান গচ্চা দিতে হল।

সেই সঙ্গে আবার প্রমাণিত হল বিরাটের স্ট্রিট স্মার্টনেস। অন্যরা হয়ত বলটায় বোল্ড হয়ে হা-হুতাশ করে সময় নষ্ট করত। ছেলেটাকে আজকে কিছু একটা ভর করেছে। ২ বলে ২ রান দরকার। এবার ম্যাচ আমাদের পকেটে। তবে স্ট্রাইকে এখন আর বিরাট নন, দীনেশ কার্ত্তিক। জাস্ট একটা সিঙ্গল নিয়ে আবার বিরাটকে স্ট্রাইক দে বাপ!

কিন্তু ইনিও হিরো হতে চান। লেগ স্ট্যাম্পের অনেক বাইরের বলে চালাতে গিয়ে কীভাবে যেন রান না স্ট্যাম্প আউট হয়ে প্যাভিলিয়ন মুখো হলেন কার্ত্তিক। আবার হয়ত এয়ার ফোর্স আর যাদবপুর জেগে উঠত কিন্তু রুমের ভেতর দুই মহিলার উপস্থিতি আমাদের সংযত করল। শুধু শটটা দেখে স্কুল জীবনের নিজের ব্যাটিংয়ের কথা মনে পড়ে গেল।

এবার উইকেটে এলেন রবিচন্দ্রন আশ্বিন। কপিলোত্তর ভারতের সেরা অলরাউন্ডার। কিন্তু সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ব্যাট হাতে ওনার অবদানও সীমিত। যদিও টেস্টে কয়েকটা সেঞ্চুরি আছে। সুতরাং ব্যাটিং পারেন এই বিষয়ে কোন সংশয় নেই।

এক বলে দুই রান দরকার। শেষ পর্যন্ত বিরাটের ইনিংস তার যোগ্য মর্যাদা পাবে কিনা সেটা নির্ভর করবে এমন এক ক্রিকেটারের ওপর যার সঙ্গে তার সম্পর্ক কিছুদিন আগেও আদায় কাঁচকলায় ছিল? অন্তত মিডিয়া আমাদের তাই বুঝিয়েছে।

পরের বল লেগ স্ট্যাম্পের সামান্য বাইরে পিচ করে আরও বাইরের দিকে যাচ্ছে। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া মস্তিষ্ক যে ক্রিকেট মাঠেও কাজে লাগে তার প্রমান হাতেনাতে পেলাম। ঠাণ্ডা মাথায় বলটাকে ছেড়ে দিলেন আশ্বিন। ওয়াইড। দুই দলের স্কোর সমান। ভারত অন্তত এই ম্যাচ হারছে না।

ওই পরিস্থিতিতে কতটা মাথা ঠাণ্ডা থাকলে বলটা ওভাবে ছেড়ে দেওয়া যায়? আর যদি আম্পায়ার ওয়াইড না দিতেন আশ্বিন খেলার চেষ্টা করেন নি বলে?

‘তাহলে দেখা যেত বিরাট আশ্বিনকে মাটিতে ফেলে তার বুকে চেপে বসেছে। ওর ঠোঁট নড়ত আর আমরা শুধু ‘বিপ’ ‘বিপ’ ‘বিপ’ শব্দ শুনতে পেতাম স্ট্যাম্পের মাইক্রোফোন মারফত।’

ছেলের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষন হাসাহাসি হল এই কথাটা নিয়ে।

না, কাহিনীতে আর শেষ বলে কোন টুইস্ট হয় নি। মিড অফের ওপর দিয়ে বলটাকে প্লেস করে অনায়াসেই ভারতকে জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় রান এনে দিলেন আশ্বিন।

মাঠের মধ্যে উন্মাদনা। আমাদের রুমেও। সবচেয়ে বেশি লাফাচ্ছে মনীষা। মা সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েছিল। এদিক ওদিক চেয়ে বোঝার চেষ্টায় আছে ঠিক কী ঘটেছে।

টিভি স্ক্রিনে তখন বিরাট চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে একটা আঙুল তুলে দাঁড়িয়ে। বিশ্বরূপ সম্পূর্ণ – সুদর্শন চক্রেরই যা অভাব। বা হয়ত দিব্য দৃষ্টি যাদের আছে তারা সেটাও দেখতে পেয়েছেন। যেমন গ্রেগ চ্যাপেল। এর আগে পরমাণু বোমার বিস্ফোরণ দেখে গীতায় বর্ণিত শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপের কথা মনে পড়েছিল ওপেনহাইমারের। এবার বিরাটের বিরাট রূপ দেখে সেটা মনে পড়বে অস্ট্রেলীয় গ্রেট গ্রেগ চ্যাপেলের। ১৮ আউট অফ ১৮। গীতার অষ্টাদশ অধ্যায় সমাপ্ত হল।

বহুদিন মিয়াঁদাদের ছক্কা আমাকে জ্বালিয়েছিল কিশোর বয়সে। এবার তোরা কয়েক বছর বিরাটের জোড়া ছক্কার স্মৃতি বয়ে বেড়া। দ্য ল্যাম্বস হ্যাভ ফাইন্যালি বিন সাইলেন্সড!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...