গ্রেট ব্রিটেনের আইরিশ রাজা

মাত্র ১৩ বছর বয়স থেকেই স্বপ্ন দেখেছিলেন ইংল্যান্ডের হয়ে খেলার। মা ব্রিটিশ নাগরিক হওয়ায় জন্মসূত্রে ইংল্যান্ডের নাগরিকত্ব পেয়ে যান মরগ্যান। ক্যারিয়ারে একটাই লক্ষ্য ছিল - ইংল্যান্ডের জার্সি গায়ে জড়ানো।২০০৭ সালে প্রথমবার ইংল্যান্ডের টেস্ট স্কোয়াডে ঠাঁই মেলে মরগ্যানের। তবে ইংল্যান্ডের জার্সি গায়ে বাইশ গজ মাতানোর সেই অধরা স্বপ্ন তখনো পূরণ হয়নি।

নান্দনিক সব শট, স্টাইলিশ ব্যাটিং আর সাথে বিচক্ষণ নেতৃত্ব – ব্যাট হাতে আগ্রাসী মেজাজের; স্বভাবে অবশ্য বেশ ঠাণ্ডা প্রকৃতির একজন। এক টুকরো হাসিমাখা মুখের নিপাট এক ভদ্রলোক। রঙিন পোশাকে ইংল্যান্ডের বদলে যাওয়ার পেছনে এই মানুষটার অবদান কম নয়। রঙিন পোশাকে ইংল্যান্ড ক্রিকেটে তিনি যোগ করেছেন এক ভিন্ন মাত্রা। ইংল্যান্ডের কেবিনেটে জায়গা করে নেওয়া একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ শিরোপাও যে তাঁর হাত ধরেই আসা।

আইরিশ ক্রিকেটে প্রতিনিধিত্ব করতেন একটা সময়, সেখান থেকে সুযোগ পান ইংল্যান্ডের জার্সিতে নিজেকে প্রমাণের। সামর্থ্যের সেরাটা দিয়ে অল্প সময়ের ব্যবধানে বনে যান নিয়মিত এক মুখ। প্রতিভা আর পরিপাটি ব্যাটিং শৈলিতে নির্বাচকদেরও মুগ্ধ করেন। কাঁধে উঠে অধিনায়কের গুরুদায়িত্ব। এরপর পেরিয়ে গিয়েছে দীর্ঘ সময়। ক্যালেন্ডারের পাতা বদলেছে, পেরিয়েছে একের পর এক বসন্ত। আর সময়ের ব্যবধানে সাদা বলে ইংল্যান্ড ক্রিকেটকে তিনি উঠিয়ে এনেছেন সফলতার শীর্ষে।

রঙিন পোশাকে বাইশ গজ শাসন করছে ইংলিশরা। আর ঠিক উল্টো রথে হাঁটছিলেন ইংল্যান্ড ক্রিকেটকে দু’হাত ভরে দেওয়া অধিনায়ক ইয়ন মরগ্যান। দলের বাকিরা যেখানে ব্যাটে-বলে আছেন উড়ন্ত ফর্মে, মরগ্যানের ব্যাট সেখানে নিষ্প্রভ। আগ্রাসী মেজাজের সেই মরগ্যানের দেখা নেই, ব্যর্থতার খাতায় যোগ হচ্ছিলো একের পর এক ইনিংস। ক্যারিয়ারে তিনি লম্বা পথ পাড়ি দিয়েছেন। ছুঁটতে ছুঁটতে হুট করেই দমে গেলেন। শরীরী ভাষায় হতাশা আর ব্যর্থতার ছাপটাও স্পষ্ট।

ডাবলিনে জন্ম, সেখানেই বেড়ে ওঠা। আয়ারল্যান্ড অনূর্ধ্ব-১৩ যাত্রা শুরু বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে। ২০০৪ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে ছিলেন আয়ারল্যান্ডের হয়ে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। এর দু’বছর বাদে ২০০৬ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে আইরিশদের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। ওই আসরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন তিনি।

মাত্র ১৩ বছর বয়স থেকেই স্বপ্ন দেখেছিলেন ইংল্যান্ডের হয়ে খেলার। মা ব্রিটিশ নাগরিক হওয়ায় জন্মসূত্রে ইংল্যান্ডের নাগরিকত্ব পেয়ে যান মরগ্যান। ক্যারিয়ারে একটাই লক্ষ্য ছিল – ইংল্যান্ডের জার্সি গায়ে জড়ানো। ২০০৭ সালে প্রথমবার ইংল্যান্ডের টেস্ট স্কোয়াডে ঠাঁই মেলে মরগ্যানের। তবে ইংল্যান্ডের জার্সি গায়ে বাইশ গজ মাতানোর সেই অধরা স্বপ্ন তখনো পূরণ হয়নি।

ইংল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেটে রান করছিলেন, ‘এ’ দলের হয়েও বেশ কিছু সফরে ছিলেন। ২০০৯ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রাথমিক স্কোয়াডে থাকায় আইরিশদের হয়ে বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পাননি তিনি। শেষ অবধি ইংল্যান্ডের জার্সি গায়েও খেলতে পারেননি এই তারকা। খানিকটা হতাশ ছিলেন। সেই হতাশা কেটে গেল অল্প সময়ের ব্যবধানে।

নিজের স্বপ্নকে বুকে নিয়ে ছুঁটেছেন, প্রহর গুনেছেন অপেক্ষার; স্রেফ একটা সুযোগের আশায় দিন পার করছিলেন। সেই সুযোগ এসেছিল, হয়েছে স্বপ্ন পূরণ। দু’বছর বাদে ২০০৯ সালে অধরা স্বপ্ন পূরণ হয় মরগ্যানের।

২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে ইংল্যান্ডের জার্সি গায়ে অভিষেক মরগ্যানের। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। নিজের প্রতিভা আর সামর্থ্য দেখিয়ে দ্রুতই বনে যান দলের নিয়মিত এক মুখ। দু’বছরের ব্যবধানে অ্যালাস্টেয়ার কুকের কাছ থেকে পেয়ে যান রঙিন পোশাকে অধিনায়কের গুরুদায়িত্ব। এরপর প্রায় এগারো বছরের পথচলা। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠা, ওয়ানডে বিশ্বকাপ জয় – রঙিন পোশাকে এক পাল্টে  যাওয়া ইংল্যান্ডের দেখা।

ওয়ানডেতে ইংল্যান্ডের হয়ে সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলেছেন। এই ফরম্যাটে ইংল্যান্ডের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রানের মালিকও তিনি। ওয়ানডে ইতিহাসে দ্রুততম ফিফটি রেকর্ডেও যৌথভাবে নাম তুলেছেন মরগ্যান। ইংল্যান্ডের হয়ে সর্বোচ্চ টি-টোয়েন্টি ম্যাচ ও সর্বোচ্চ রানের মালিকও তিনি। রঙিন পোশাকে ইংলিশদের হয়ে সর্বোচ্চ ছক্কার রেকর্ডও করেছেন নিজের নামে। বাইশ গজে অধিনায়ক হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সময়ের সেরা হিসেবে।

ডাবলিন থেকে শুরু ডাচদের ডেরায় এসে শেষ। ঘড়ির কাঁটায় পাড় করেছেন ক্যারিয়ারের প্রায় ১৬ বছর। বয়সটাও পয়ত্রিশ পেরিয়ে ছুঁটছে ছত্রিশের দিকে। বয়স বেড়েছে, শরীরটাও আর সায় দিচ্ছে না। ফর্ম হারিয়ে ব্যর্থতার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন মরগ্যান। এর মধ্যেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের শেষটা দেখে ফেলেছেন তিনি। ফর্মহীনতা আর ব্যর্থতার কাছে হার মেনেই বিদায় নিলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে।

মরগ্যানের ক্যারিয়ারে যেন ভারী হয়ে উঠছিল মেঘের কালো ছায়া। আড়ালের সূর্যটা শেষ অবধি এই কালো ছায়া ভেদ করে আর হাসতে পারেনি। হাস্যজ্বল মুখে হতাশা আর শেষের ব্যর্থতা নিয়েই বিদায় নিতে হলো।

ব্যাট হাতে লম্বা সময় বাইশ গজে দাঁপিয়ে বেড়িয়েছেন তিনি। রঙিন পোশাকে ইংল্যান্ডের অন্যতম সেরাদের একজন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। এরপর-ই শুরু ব্যর্থতার পর্ব। সেই পর্বটার শুরু তিনি দেখেছেন, কিন্তু শেষটা আর দেখা হয়নি। তার আগেই ফর্মের কাছে হার মেনে বিষাদ ব্যথা নিয়েই ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছেন এই তারকা।

সকাল ফেলে ক্যারিয়ারের আলোর ঝলকানি মিলিয়ে গেল গোঁধুলি লগ্নে। ফেলে যাওয়া শত স্মৃতি চোখের সামনে হয়তো ভেসে উঠেছে। ১৪ বছর আগেও কি কখনো ভেবেছিলেন – তিনি সফলতার চাদরে তিনি দীর্ঘ পথ পাড়ি দিবেন? সহযোগী সদস্য দেশ থেকে উঠে এসে বনে যাবেন ইংল্যান্ডের অধিনায়ক? শিরোপা জয়ের অধরা স্বপ্ন পূরণ হবে তাঁর হাত ধরে – এর কোনো কিছুই হয়তো ভাবেননি। স্রেফ একটা স্বপ্ন দেখেছিলেন, ইংল্যান্ডের হয়ে খেলবেন।

সেই স্বপ্নকে লালন করেছেন, বাস্তবে রূপ দিয়েছেন। এরপর বাইশ করে পাড়ি দিয়েছেন দীর্ঘ পথ। সফলতা মাথায় নিয়ে দাঁপিয়ে বেড়িয়েছেন লম্বা সময়। অবিশ্রান্ত গতিতে ছুঁটতে থাকা মেইল ট্রেনকেও একটা সময় থামতে হয়; থেমেছেন মরগ্যানও। দলের বোঝা হতে চাননি। সরে দাঁড়িয়েছেন নিজেই। দলের কল্যানে নিজের জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন। ব্যর্থতার রাস্তাটা আর লম্বা করতে চাননি। বিদায় বলতে পারাটাও তো সাহসিকতা।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘সময় যদি ফুরিয়ে থাকে, হেসে বিদায় করো তাকে।’ মরগ্যানের সময় ফুরিয়ে গিয়েছে, ক্যারিয়ারের উজ্জ্বল আলোটাও এখন নিভে গিয়েছে। তবে, শেষটা সুমধুর হয়নি অধিনায়কের। হেসে বিদায় জানাতে পারেননি। বাইশ গজে সতীর্থদের কাঁধে চড়ে দর্শকদের অভ্যর্থনা আর করতালি পাননি। সব গল্পের শেষটা সুন্দর হয় না, হয়নি মরগ্যানেরও। তবে, রঙিন পোশাকে ইংল্যান্ড ক্রিকেটের এক উজ্জ্বল মহাতারকা হয়ে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন দীর্ঘদিন। বিদায় অধিনায়ক মরগ্যান।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...