ক্রিকেটই যার নিয়তি

ক্রিকেটার না হলে কী করতেন?

বছর কয়েক আগের কথা। টানা চার কিলোমিটার দৌড়ে এসে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তিনি। সেখান থেকে ডেকে এনে এই প্রশ্ন করেছিলাম!

জবাবে একটু হেসেছিলেন সাদমান ইসলাম। তারপর কাঁধ দুটো ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘ক্রিকেটারই হতাম আমি। ছোটবেলা থেকে ক্রিকেটার হবো বলেই নিজেকে তৈরি করেছি।’

বলা ভালো, ক্রিকেটার হওয়াই তার নিয়তি। সেই নিয়তির পথ ধরেই বয়সভিত্তিক দল, ঘরোয়া ক্রিকেট পাড়ি দিয়ে এখন বাংলাদেশ জাতীয় দলের টেস্ট ওপেনার সাদমান ইসলাম। আরও ভালো করে বললে বলা যায়, ক্রিকেটার হওয়া ছাড়া কোনো উপায় যেনো ছিলো না তার সামনে। ক্রিকেট যার জীবন যাপনের অংশ, সেই সাদমান ইসলাম অনিক।

সাদমানের বাবা বাংলাদেশের ক্রিকেট অঙ্গনের পরিচিত একজন মুখ-বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) গেম ডেভেলপমেন্ট ইউনিটের সহকারী ম্যানেজার শহীদুল ইসলাম; সবার শহীদুল ভাই। পেশাগত কারণেই শহীদুল ইসলামের কাজ হলো তরুন ক্রিকেটার খুজে বের করা। কিন্তু শহীদুল ভাই সম্ভবত কল্পনা করেননি, বাংলাদেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যত এক তারকা বেড়ে উঠছে তাঁর ঘরেই!

সাদমান বলছিলেন, তার ক্রিকেটের শুরুটা চাচাতো ভাইকে দেখে। বাবার হাত ধরে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে গেছেন, তারকা ক্রিকেটারদের দেখেছেন। কিন্তু ক্রিকেট খেলার নেশাটা তৈরী হয়েছে চাচাতো ভাইয়ের খেলা দেখেই। তাকে দেখেই বিকেএসপিতে ভর্তির নেশাটাও তৈরী হয়েছিলো।

সাদমানকে যে কারণে বাংলাদেশের ক্রিকেটে আর দশ জনের চেয়ে একটু আলাদা চোখে দেখা হয়, সেটা তার ব্যাটিং স্টাইল। আজকের দুনিয়া হলো মারকাটারি ক্রিকেটের দুনিয়া। এখানে চোখ ধাঁধানো শট, বোলারকে পিটিয়ে ছাতু বানানো; এগুলোকেই প্রতিভার লক্ষন মনে করা হয়। কিন্তু সাদমান এই চেনা দুনিয়ার সহজ পথে হাটেননি। তিনি ক্রিকেটের ক্লাসিক ঘরানার ব্যাটসম্যান।

ঘন্টার পর ঘন্টা উইকেটে কাটিয়ে দেওয়া, বলের পর বল ছেড়ে যাওয়া এবং বোলারকে ক্লান্ত করে খারাপ বলটায় শট করা; এই হলো সাদমানের বৈশিষ্ট্য। ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট খেলেছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। সেখানে ৭৬ রানের ইনিংস খেলতে ব্যয় করেছিলেন ১৯৯ বল। ক্লান্ত করে ছেড়েছিলেন প্রতিপক্ষ বোলারদের।

কিন্তু আজকের এই রকমারি শটে মাতানোর দিনে সাদমান কী করে এই খাটি টেস্ট ঘরানার ভক্ত হলেন? উত্তরটা যেনো তৈরীই ছিলো এই তরুনের মুখে, ‘ছোটবেলা থেকে বাবার কারণে টিভিতে টেস্ট ক্রিকেটই দেখেছি। এখানে সেশনে সেশনে বোলারদের সাথে ব্যাটসম্যানদের যে ধৈর্য্যরে খেলা হয়, ওটাই আমাকে সবচেয়ে বেশি টেনেছে। আমি একটা জিনিস বুঝেছি, টেকনিক্যালি খুব ভালো হলে খেলার এই অংশটা উপভোগ করা যায়। সেটাই করি আমি।’

এর মানে অবশ্য এই না যে, সাদমান সীমিত ওভারে সফল নন। বরং সেখানেও তার ঈর্ষনীয় সাফল্য আছে। ২০১৪ অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে তিনি ছিলেন টুর্নামেন্টের সেরা ব্যাটসম্যান। সীমিত ওভারের সেই খেলাতে প্রমাণ করেছিলেন নিজেকে। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগেও তার পারফরম্যান্স বলার মতো। সাদমান বলছিলেন, টেকনিক ভালো থাকলে সব ফরম্যাটেই ভালো করা সম্ভব।

অবশ্য আমার সাথে যখন কথা হচ্ছিলো, সেই সময়ে তিনি জাতীয় দলের হয়ে ওয়ানডে বা টি-টোয়েন্টির কথা ভাবছিলেন না। বলছিলেন, ‘টেস্টে সুযোগ পাচ্ছি। এখানে আগে নিজেকে শক্ত করি। পাশাপাশি ঘরোয়া ক্রিকেটে পারফরম করতে থাকলে এক সময় লিমিটেড ওভারেও নিশ্চয়ই সুযোগ পাবো। এখন শুধু টেস্ট নিয়েই ভাবছি।’

এতো কিছু বলা হলো, আসল কথাটা হয়নি।

টিভি দর্শকের কাছে সাদমানের আরেকটা পরিচয় আছে-তামিমের কপি। হেলমেট পরে ফেললে কে সাদমান, কে তামিম; আলাদা করা যায় না। সাদমান নিজেও এটা শুনেছেন। প্রশ্নটা উঠতেই হেসে বললেন, ‘আমার আর তামিম ভাইয়ের তেমন মিল তো দেখি না। আমাদের ব্যাটিং স্টাইলও আলাদা। কিন্তু টিভিতে নাকি একরকম লাগে। তামিম ভাই অনেক বড় ব্যাটসম্যান। দোয়া করবেন, ওনার মতো লম্বা সময় ধরে যেনো জাতীয় দলে খেলতে পারি।’

জাতীয় দলের টেস্ট ফরম্যাটে জায়গাটা অনেকটা পাঁকাই হয়ে গিয়েছিলো। মনে হচ্ছিলো, তামিমের সঙ্গীকে খুজে পাওয়া গেছে। কিন্তু প্রথমে সমস্যা হলো ইনজুরি। দলের বাইরে যেতে হলো সাদমানকে। এরপর ফিরলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজে। সেখানে ফিরেই নিজেকে প্রমাণ করলেন। ২৩৫ মিনিট ব্যাট করে ৫৯ রানের ইনিংস খেললেন সাদমান।

হতাশার সিরিজে অল্প কিছু ইতিবাচক দিকের মধ্যে একটা ছিলো সাদমানের ব্যাটিং। কিন্তু পরের টেস্টে আবার ইনজুরির কারণে খেলা হলো না। এরপর আবার করোনা আক্রান্ত হলেন।

সুস্থ হয়ে উঠেও অবশ্য নিজের জায়গাটা ফিরে পেলেন না সাদমান।

কিন্তু কী এক বিচিত্র অজুহাত আবিষ্কার করলো টিম ম্যানেজমেন্ট। দু জন ওপেনার বাহাতি হলে নাকি সমস্যা। তাই টিম কম্বিনেশনের দোহাই দিয়ে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দুটো টেস্টে তার জায়গা হলো না। কোচ অবশ্য বললেন, করোনার পর ম্যাচ ফিট হয়ে ওঠেননি তখনও সাদমান।

সে যাই হোক, আপাতত সাদমানের একটু উত্থান পতন যাচ্ছে। তবে এটা ঠিক যে, বাংলাদেশের জন্য লংগার ভার্শন ক্রিকেটে উপযুক্ত এক সেনানী হয়ে উঠছেন তিনি। কে জানে, হয়তো সব ফরম্যাটেই ভবিষ্যতের এক তারকা হয়ে উঠছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link