শুরুতেই একটা সোজা কথা বলে নিই। যদি ধরে নিই যে ১৯৮০ থেকে আমি ঠিকমতো টেস্ট ক্রিকেট দেখছি, তাহলে আমি সুনীল গাভাসকারকে দেখিইনি। না আমি ২২১ দেখিনি, ৫৮ দেখিনি, পোর্ট অব স্পেনের ১০২ দেখিনি। আমার দেখা শুরু হবার পর বিশ্বের সেরা থেকে সুনীল গাভাস্কার হয়ে গিয়েছিলেন মাঝারিমানের একজন ওপেনার, যিনি অফ স্টাম্পের বাইরে বেশ নড়বড়ে, দেশের বাইরে ভীষণ রকমের সফল না হলেও মাঝেমধ্যে বেশ দায়িত্বশীল ইনিংস খেলবেন এবং অধিনায়ক হিসাবে টেস্ট ড্র করবেন।
ভীষণ রকমভাবে মনে পড়ে, ইডেনের বি ব্লক, মাঠের বাইরে দিকটায় দাঁড়িয়ে আছি, দর্শক চেতন শর্মার লেট বার্স্টের জন্য জয়ধ্বনি দিচ্ছে কিন্তু সুনীল গাভাস্কার ক্লাবহাউস থেকে বেরিয়ে যখন বাসের দিকে যাচ্ছেন তখন হায়হায় ধ্বনি। এই সেই ম্যাচ যেখানে ওঁর স্ত্রীকে কমলালেবু ছুঁড়ে মারা হয়। যার প্রতিবাদে সুনীল আর ইডেনে খেলেননি। পাকিস্তান ম্যাচে শ্রীকান্তের সঙ্গে ওপেন করেন বাংলার অরুণ লাল। একটা সত্তর আর একটা পঞ্চাশ করেনও বটে।
তবু সুনীল গাভাসকার আমাদের প্রথম বিশ্বমানের ব্যাট। পাঁচ ফুট সাড়ে তিন ইঞ্চির একটা আধা কাঁচাপাকা কোঁকড়ানো চুলের মানুষ যিনি মাঠে নামলে বাকি সবাই সরে গিয়ে জায়গা করে দেয়, আর সুনীল মনোহর গাভাসকার, ছোটছোট পদক্ষেপে গুটগুট করে মাথাটা সামান্য দুলিয়ে হেঁটে চলে যান মাঠের মাঝখানে, মাথায় একটা পানামা টুপি, নিচে হয়তো হেডব্যান্ড অথবা শেষদিকে স্কালক্যাপ, যেটা নাকি ইমরানের পরামর্শে পরতেন।
তারপর বিশেষ দুই বকলস ওলা প্যাড পরে দাঁড়াবেন, ঝুঁকে, পপিং ক্রিজের দু পাশে দুটো পা, বাঁপাটা সামান্য কভারের দিকে ঘোরানো, হাঁটু প্রায় সোজা, বোলার আসার আগে পায়ের আঙুলের নিচের অংশটি আকাশে, ব্যাট ঠেকিয়ে রাখা ডান পায়ের কড়ে আঙুলের পাশে, মাথা সোজা, দুটো চোখ দিয়ে বোলারকে দেখা বাম কনুই সামান্য ভাঙা।
বোলার ডেলিভারি স্ট্রাইডে তো ওই উঠে থাকা পায়ের আঙুলগুলো মাটি ছুঁয়ে বাঁ পাটা সামান্য এগিয়ে সাফল, আর তার পরে পরেই বলের গন্ধ শুঁকে ফরোয়ার্ড ডিফেন্স, বা একটু উপরে থাকলে অফ মিডে বলটাকে প্যাডের পাশে নিয়ে মিড উইকেট দিয়ে ছোট্ট কব্জির মোচড়। একটা স্ট্রেট ড্রাইভ, একটা এক্সট্রা কভার ড্রাইভ, একটা পয়েন্ট দিয়ে স্টিয়ার। এটুকুই। গুণ্ডাপ্পা বিশ্বনাথ বরং এর থেকে অনেক বেশি চনমনে। ব্যাট গালি থেকে আসবে আর তারপর স্কোয়ারকাট হোক বা ফ্লিক ব্যাট মাথার উপর উঠে যাবে এক মসৃণ আকর্ষণে।
কিন্তু তবু সুনীল গাভাসকার আমাদের গর্ব, আমাদের প্রথম বিশ্বমানের ব্যাট, আমাদের দৈনন্দিন রুজিরুটির মধ্যে একমাত্র আশার আলো। বিশ্বনাথ খেললে ভারত হারবে না। কিন্তু সুনীল খেলবেন যাতে ভারত না হারে। তখন জয় নয়, না হারাটাই কৌশল ছিল। একমাত্র করণীয়।
প্রথম খাপ খুলতে দেখলাম অবশ্য কোটলায়। এমনিতেই তখন কানাঘুষো চলছে যে গাভাসকার শেষ। অধিনায়কত্ব ছেড়েছেন বিশ্বকাপের ঠিক আগেই, পাকিস্তানে রিভার্স স্যুইং-এ ধরাশায়ী হয়ে। বিশ্বকাপে ব্যাটে রান নেই। প্রহতম টেস্ট কানপুরে, চকিতে ছোবল মারা বলে হাত থেকে ব্যাট ফেলে দিয়েছেন ম্যালকম মার্শাল। সুনীল শেষ। নাকি শেষ নয়! আত্মাভিমানে ঘা।
তূণীরে যে তির বারো বছর লুকিয়ে রেখেছিলেন ঝুঁকি ছেঁটে ফেলে কারণ ভারতকে বাঁচাতে হবে বলে, তা বেরলো সেই কোটলায়। মার্শালের গুডলেন্থের সামান্য পিছন থেকে তোলা বাউন্সার। বল আশ্রয় নিল লঙ্গলেগ বাউন্ডারিতে। সুনীল গাভাসকার হুক করছেন। আরও জোরে ঠোকা বাউন্সার আরও জোরে হুক করে ফাইনলেগের উপর দিয়ে। ১২১এ থামলেও সেদিন বুঝলাম কেন তিনি বিশ্বমানের।
অথবা ফয়সলাবাদের ১২৭? কিচ্ছু বুঝতে পারছি না, অন্ধকার অন্ধকার কভারেজে সাদায় কালোয় ব ৪০ ওভার পুরনো হয়ে গেলেও ইমরান, সরফরাজ বলকে কথা বলাচ্ছেন, আউট স্যুইং ইনস্যুইং ইন ডিপার। বিশ্বনাথের কেরিয়ার শেষ হচ্ছে। একা মহিন্দার দাঁড়িয়ে বুক চিতিয়ে,আর সুনীল খেলছেন। দ্বিতীয় ইনিংস। প্রথম ইনিংসে জাভেদ মিঁয়াদাদ তাঁর সেই বিখ্যাত বাঁ পা মাঝখানে পুঁতে খেলে গেছেন।
লোকগাথা, পাকিস্তানে মিয়াঁদাদ লেগ বিফোর উইকেট আউট হন না। জাহির আব্বাস, মুদাসসর নজর, মহসিন খান, আর দ্বিতীয় ইনিংসে সুনীল খেলছেন। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত স্যুইং সামলে সাধারণ স্যুইং, লেট স্যুইং, রিভার্স স্যুইং সামলে সুনীল অপরাজিত রইলেন ১২৭এ।ভারত হারল ১০ উইকেটে কিন্তু সুনীল হারলেন না। রিভার্স স্যুইং-এর গুঢ় ষড়যন্ত্র নির্বিষ করে সুনীল টিকে রইলেন। কিতু ওইই, ফুলকিই।
তার আগে ১৯৮১তে মেলবোর্ন। সারা সিরিজে রান না পাওয়ার জ্বালা ভুলছেন যখন তখনই ব্যাটে লেগে প্যাডে লাগতেও আম্পায়ার রেক্স হোয়াইটহেড আঙুল তুলে দিলেন। ব্যাট দেখালেন গাভাসকার কিন্তু লিলি! তিনি তো নাটক ছাড়া ছাড়বেন না। কটুকথায় মাথার ঠিক না রাখতে পেরে গাভাস্কার চেতন চৌহানকে নিয়ে হাঁটা দিলেন প্যাভিলিয়নের উদ্দেশ্যে। শাহিদ দুরানি বা বাপু নাদকার্নি না থাকলে হয়তো সামলাতে পারতেন না।
সুনীল গাভাস্কার। ১৯৭১ সালে যখন পোর্ট অব স্পেনে সেঞ্চুরি করছেন ২১ বছরের এক ধূমকেতু, তখন ভারতের বহুদিনের লালিত স্বপ্ন পূর্ণতা পাবার শুরু। আসলে ৬০এর দশকের যুদ্ধগুলো পেরিয়ে আবার একটা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছে ভারত, অর্থনৈতিক অস্থিরতা। আর এ সবকিছুর মধ্যে বাইশগজে নিশ্চিন্ত করতে উপস্থিত সুনীল মনোহর গাভাস্কার। কাদেরকে সামলাচ্ছেন তিনি!
টপ ফর্মের জন স্নো, ক্রিস ওল্ড, ডেনিশ লিলি, ইমরান খান, সরফরাজ নওয়াজ, লেন প্যাসকো, জেফ থমসন, ম্যাক্স ওয়াকার, ইয়ান বথাম, বব উইলিশ, রিচার্ড হেডলি আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ! পেস ব্যাটারি! অ্যান্ডি রবার্টস, ওয়েন ড্যানিয়েল, মাইকেল হোল্ডিং, কলিস কিং, সিল্ভেস্টার ক্লার্ক, ওয়েন ড্যানিয়েল। আর মার্শাল, ম্যালকম মার্শাল। ৭৯তে যখন ভারতে এলেন তখন নবীন যুবা।
আর সেই যুবাই যখন পরিপক্ক হলেন তখন গাভাস্কারের সবথেকে বড় শত্রু হয়ে দাঁড়ালেন। তবু সুনীল দাঁড়িয়ে থাকেন, পানামা মাথায়, হাতে একটা রিস্ট ব্যান্ড পরে যা আর্ম গার্ড হয়ে দাঁড়ায় আর অবিচল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন সানিটনি ব্যাট হাতে। এসজি ব্যাট সুনীল গাভাসকারের নামের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়।
না সেই ওভালের ২২১ বা ম্যানচেস্টারের ৫৮, যা ওঁর নিজের মতে সেরা ইনিংস, দেখা হয়নি আমার। দেখা হয়নি, ইংল্যন্ডের গ্রীষ্মের স্যাঁতস্যাঁতে প্রথমার্ধে যখন উইলিস ওল্ডরা বলকে কথা বলাচ্ছেন কীভাবে আধভিজে উইকেটে মনঃসংযোগ এবং অধ্যাবসায় নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। সঙ্গে ভিশি। সেই ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে থাকা দুই খর্বকায় বিরল প্রজাতির ব্যাট। একজন শিল্পী, একজন যোদ্ধা।
আসলে গাভাস্কারকে সারা কেরিয়ার জুড়ে একা একা লড়াই করতে হয়েছে। চেতন চৌহান, অংশুমান গায়কোয়াড় বা কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্তরা ছিলেন বটে, কিন্তু নিশ্চয়তা ছিল না। কিছুটা দিলীপ আর কিছুটা গুণ্ডাপ্পা। আর শেষ দিকে মোহাম্মদ আজহারউদ্দীন। এছাড়া সত্যিই কি বিশ্বমানের কিছু ছিল তাঁর হাতে। তবু এক অনিশ্চিত দেশের একাধিক অনিশ্চিত প্রজন্মকে এক দৃঢ় সংকল্পের সন্ধান দিয়েছিলেন তিনি।
স্পিন চতুষ্কোণ একে একে ভেঙে পড়ছে, এক নতুন হারিকেনের উদ্ভব হচ্ছে। দিলীপ দোশি পেরিয়ে রবি শাস্ত্রী, মনিন্দর, লক্ষ্মণ শিবরামকৃষ্ণণ, শিবলাল যাদব, মদন লাল পেরিয়ে রজার বিনি, কারসন ঘাউড়ি, চেতন শর্মা। ক্রিকেট বদলাচ্ছে ভারত বদলাচ্ছে। আর ছোট্ট শরীর নিয়ে মহীরুহের মতো দাঁড়িয়ে আছেন সুনীল গাভাসকার। পাওয়ার ক্রিকেট আসছে, গদার মতো ব্যাট আসছে আর তিনি তখনও তাঁর ক্ষীণকায় চেহারা আর পালকের মত ব্যাট নিয়ে ছয়ের বিরুদ্ধে এক দুই নিয়ে লড়ে যাচ্ছেন। টাইমিং, টাইমিং ইস দ্য কি মাই ডিয়ার ওয়াটসন। বাকি তো ঘাস বুঝে নেবে।
আর বিশ্বাস। পোর্ট অব স্পেনের সেই ৪০৬ তো সুনীলের বিশ্বাসের উপরই বাঁধা হয়েছিল। অংশুমান, ভিশি, মহিন্দাররা খেলে দিলেন বটে কিন্তু সুনীলের সেঞ্চুরি না থাকলে তো সে আসত না। অথবা কেরিয়ারের শেষ লগ্নে এসে মাদ্রাজের টাই টেস্ট? ভারত তো জেতার জায়গাতেই পৌঁছয় না যদি না শেষদিনে সুনীলের লড়াকু ৯০ না থাকে।
আর শেষ টেস্ট ইনিংস? না লর্ডস বাইসেন্টিনারিতে শেষ লগ্নে তারকখচিত এমসিসির বিরুদ্ধে ১৮৭ নয়। ব্যাঙ্গালোরের খোঁয়াড়ে ৯৬। ২২০ করলে জয়। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে ইকবাল কাশিম আর তৌশিফ আমেদ তির ছুঁড়ছেন। পুরো পিচটাই রাফ তৈরি হয়েছে। আর দুই স্পিনার খালি গেদেগেদে বল রেখে যাচ্ছেন গুডলেন্থে। কোনোটা গড়াচ্ছে, কোনোটা সমকোণে বাঁক নিচ্ছে, কোনোটা কানের পাশ দিয়ে যাচ্ছে।
আর সুনীল খেলে যাচ্ছেন। পরের সর্বাধিক রান আজহারের ২৬। বাকি কেউ ২০ নেই। শুধু সুনীল সুনীল আর সুনীল। ধূসর পিচ সুনীলময়। সুনীল গাভাস্কার খেলছেন, বা বলা যায় লড়ছেন। ঢাল বলতে ওই পালকের মতো ব্যাট আর অবিচল মন:সংযোগ ও ধৈর্য। নাকের নিচে বল নিয়ে খেলে যাচ্ছেন তিনি, এক দুই করে আড়াইশরও বেশি বল। শেষে জয় থেকে চল্লিশ রান দূরে ইকবাল কাশিমের কাঁধের কাছে লাফিয়ে ওঠা একটা ছোবলে ব্যাট চলে গেলে রিজওয়ান ঊজ্জামান ধরে ফেললেন। স্কুলে ছিলাম তখন। দেখিনি খেলা। এসে শুনে হাইলাইটস দেখে কি মন ভরে! কিন্তু লড়াইটা মনে গেঁথে গেছিল যে। আর সেই লড়াইটাই জীবনে ফিরে এসেছে বারবার।
তবে সুনীল মনোহর গাভাস্কার মানে কি শুধুই ব্যাটিং, শুধুই অধ্যাবসায় শুধুই মন:সংযোগ? স্লিপ ক্যাচিং? প্রথম স্লিপে গাভাস্কার দ্বিতীয় স্লিপে ভিশি। কত কত মনে রাখার মতো পারফরম্যান্স। তবে সবথেকে উল্লেখযোগ্য বোধহয়, ১৯৮৫র শারজায় রথম্যান্স কাপ। ব্যাটে মাত্র ১, রিফ্লেক্স কমেছে বলে মিডল অর্ডারে নামছেন। কিন্তু স্লিপে জায়গা যায়নি। আর ৮৭ রানে পাকিস্তানকে শুইয়ে দেওয়ার মধ্যে চার চারখানা ক্যাচ গাভাস্কারের পকেটে। বিশেষত শাস্ত্রীর বলে মিয়াঁদাদ এবং সেলিম মালিক তো আক্ষরিক অর্থেই পকেটে স্থান পান।
অধিনায়কত্ব! আসলে ওয়াদেকরের হাতে আছে ইংল্যন্ড ওয়েস্ট ইন্ডিজে সিরিজ জয়, পতৌদির হাতে আছে উপমহাদেশের বাইরে প্রথম টেস্ট জয়, কপিলের একটা বিশ্বকাপ আছে, সৌরভের আছে একরাশ তরুণ, ধোনির আছে দুটো বিশ্বকাপ। কিন্তু সুনীল গাভাস্কার?
ইমরান বা বথামের কথা শুনলে মনে হয় এমন চতুর অধিনায়ক সত্যিই পাওয়া কঠিন ছিল। নেহাত গুলিগোলা হাতে ছিল না বলে হার বাঁচিয়ে এগোন। ফলে ইডেনের গালাগালিও জোটে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে সঠিকভাবে স্পিনকে ব্যবহার করা, বা ইডেনের বিকেলে গঙ্গা থেকে উড়ে আসা হাওয়ায় রজার বিনির হাতে বল তুলে দেওয়া অথবা সর্বোপরি কপিল দেব রামলাল নিখাঞ্জ নামের এক দুরন্ত বিপ্লবকে নিয়ন্ত্রণ করে সঠিক পথে চালনা। সানি ছিলেন বোলার্স ক্যাপ্টেন।
দিলীপ দোশিকে সঠিকভাবে ব্যবহার বা তরুণ রবি শাস্ত্রীকে সাহস ভরে প্রথমে দলে নেওয়া এবং পরে ওপেন করানো। অধিনায়কের দায় বা দায়িত্ব তো থাকেই। তবে একটা ঘটনা না বললেই নয়। সেই ১৯৮১ মেলবোর্ন। চতুর্থ দিনে ১৪৩ করলে জয় এমন অবস্থায় ব্যাট করতে নেমে অস্ট্রেলিয়া ১১ রানে প্রথম উইকেট হারালো। গ্রেগ চ্যাপেলও তখন পড়তির দিকে কিন্তু তবুও বুড়ো কেশরের সিংহের কেশর সঞ্চালনেই ম্যাচ বেরিয়ে যাবে।
আর কেউ না করুক সানি লক্ষ্য করেছিলেন যে নতুন বলে অফস্টাম্পের বাইরের বলের দুর্বলতা ঢাকতে গ্রেগ শাফল করছেন ভিতরের দিকে। সানি ঘাউড়িকে কী যেন বলে এলেন কানে কানে। যেমন বলা তেমন কাজ, প্রথম বলটা কার্সন ঘাউরির ন্যাচরাল স্যুইং, বল লেগস্টাম্পের বাইরে পরে পিছন দিয়ে গ্রেগের প্রানভোমরা নিয়ে চলে গেল। আর সেই সঙ্গে ফিরে এল ভারতের ম্যাচে ফেরার সুযোগও। আর পরেরদিন কর্টিজেন ইনজেকশন নিয়ে মাঠে নেমে কপিল কী করেছিলেন সে তো লোকগাথার অন্তর্গত।
সে যাক, তবে গাভাস্কারকে তো আর শুধুমাত্র নম্বর বা জাগতিক বিষয় দিয়ে ধরা যায় না। হ্যাঁ ৩৪টা সেঞ্চুরি, ১২৫টা টেস্ট, ২১৬টা ইনিংস, ১০১২২ রান এগুলো তো চোখ বুজে বলে দেওয়া যায়। সংখ্যাতত্ত্ববিদরা চুলচেরা বিচার করে দেখাতেও পারবেন যে ১৯৮০ থেকে মাত্র একবার ১৯৮৬-৮৭তে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ছাড়া বিদেশের মাটিতে পঞ্চাশের উপর গড় নেই, সেভাবে ক্যারাবিয়ান পেস ব্যাটারি সামলে প্রচুর রান করেননি।
তবু সুনীল গাভাস্কার মানে একটা বিশ্বাস। বিশ্বকাপ জয়ের পরে যে বিশ্বাস ধীরে ধীরে চারাগাছের জন্ম দেয়, ভারতকে ক্রিকেটে সুপারপাওয়ারে পরিণত করে। সুনীল গাভাসকার এই বিশ্বাস দিয়েছিলেন যে আমরা আমাদের নিজের নিজের মধমেধার উর্ধে উঠে উচ্চস্তরে চলাফেরা করতে সাহস পাই।
যদি একদিনের সীমিত ওভারের ক্রিকেটের কথাই চিন্তা করি, বিশ্বকাপে সবথেকে ধীরগতির ইনিংস খেলার জন্য সারাজীবন টিটকিরি শুনতে হয় তাঁকে। অথচ তাঁর অকপট স্বীকারোক্তি, ১৯৭৫এ সীমিত ওভার ক্রিকেট কীভাবে খেলতে হয় কেউ বলে দেয়নি। ফলে জানতেনও না কী করতে হবে। না বুঝতে পেরে শেষ পর্যন্ত অপরাজিত থেকে যান। পরবর্তীকালে অস্বীকারও করেননি যে মেলবোর্নে বেরিয়ে আসাটা ভুল হয়েছিল।
কিন্তু, এই সব থেকেই শিক্ষা নিয়েই দাঁড়িয়েছিল তাঁর ক্রিকেটবোধ। শুধুমাত্র প্রচুর প্রতিভা নিয়ে খেলতে আসা না, নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে তাকে ঘষেমেজে আরও তীক্ষ্ণ করাটাও তাঁর অবদান। নাহলে ১৯৭৫এর ৩৬ই বারোবছর পর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১০৩এ রূপান্তরিত হয়? তাও ৩৭ বছর বয়সে, ১০১ডিগ্রি জ্বর নিয়ে। আজহারউদ্দীনের বিশ্বরেকর্ড ৬৭বলে ১০৭এর আগে পর্যন্ত যে ইনিংস ছিল ভারতের হয়ে দ্রুততম সেঞ্চুরি।
আর এতকিছুর মধ্যে ধারাভাষ্য ভুলে যাব কী করে? না, পতৌদির চোস্ত ইংরাজি তাঁর ছিল না। কিন্তু ক্রিকেট প্রজ্ঞা, পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা এবং কুইক উইট নিয়ে সেই ৮৮ থেকে আজ প্রায় তেত্রিশ বছর তিনি ভারতীয় ক্রিকেট ধারাবিবরণীর মুখ হয়ে রয়েছেন। এই বাহাত্তরেও। বিজ্ঞাপনের টার্ফে,স এ দিনেশই হোক বার ভিমল। স্বচ্ছন্দ বিচরণ করেছেন, কিং রিচার্ডস বা শাহেনশা ইমরানের সঙ্গে স্ক্রিন শেয়ার করেও।
আরেকটা কথা উল্লেখ না করলে হয়তো অন্যায় হবে। ছেলেবেলা থেকে সানি ডেজ, দ্য আইডলস বা রানস অ্যান্ড রুইন্স আমাদের ক্রিকেট সাহিত্যচর্চায় উদ্বুদ্ধ করেছে। ক্রিকেটটাকে অন্যভাবে দেখতে উদ্বুদ্ধ করেছে।
এইসব নিয়েই গাভাস্কার। ভারতের হয়ে টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম সুপারস্টার এবং তর্কসাপেক্ষে সেরা টেস্ট ব্যাট। গাভাস্কারকে নিয়ে ক্যারিবিয়ানরা গান লিখেছিল- ‘ইট ওয়াজ গাভাস্কার/ দ্য রিয়েল মাস্টার/ জাস্ট লাইক আ ওয়াল/ উই কুডনট আউট গাভাস্কার অ্যাট অল, অ্যাট অল…’
একবারই সামনে থেকে অটোগ্রাফ নিতে পেরেছিলাম, ১৯৯০এ রঞ্জিজয়ী বাংলা দলকে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়েছিল নেতাজী ইন্ডোরে। বেরোবার সময় ছুটে গিয়ে গাড়ির ভিতরে হাত গলিয়ে নিয়েছিলাম স্বাক্ষর। ভারতীয় ক্রিকেটের প্রথম সুপারস্টারের স্বাক্ষর। এখনও রাখা আছে সেটা। আসলে কিছু কিছু ইতিহাসকে যত্নে রেখে দিতে হয়, প্রথম পোঁতা ইটটাকেও।
– ময়দানী স্ক্র্যাপবুক