সানি-ভিশি ও রঙিন ক্যারিবিয়ান বধ

এক বছর পরেও ভারতের দ্বিতীয় ইনিংস চলাকালীন প্রতি মুহূর্তে কিশোর ভিমানীর ব্যারিটোনিক আত্মবিশ্বাসটা যেন আজও কানের সামনে শুনতে পাই, স্মৃতির রেডিওতে। এখন আর সেই ক্রিকেট দিনগুলিও নেই আর সেই কিশোর ভিমানীও নেই।থেকে গেছে যা, তা হল সেদিনের পেলব স্মৃতিমেদুরতা।

কতগুলো বছর কেটে গেল দেখতে দেখতে। পোর্ট অব স্পেন টেস্টের (৭-১২ এপ্রিল ১৯৭৬) শেষদিন, মানে ১৯৭৬ সাালের ১২ এপ্রিলের সেই অলৌকিক রাতটা (মাঝরাত, ভারতে) আজও ভুলতে পারিনা। তখন বহরমপুরে মামাবাড়িতে থেকে কৃষ্ণনাথ কলেজে কেমিস্ট্রিতে গ্রাজুয়েশন করতাম।

রাত আড়াইটার সময়ে একা জেগে রেডিওতে কান পেতে ছিলাম। ম্যাচ তখন ৫০:৫০। ব্যাট হাতে সানি-ভিশি-জিমির অলৌকিক প্রতিরোধে ক্রমশ পিছু হটছিল ভয়ঙ্কর হোল্ডিং-জুলিয়েন-প্যাডমোর-জুমাদিন আক্রমণ। অপ্রত্যাশিতভাবে জয়ের গন্ধ পাচ্ছিল ভারত।

ঠিক সেই সময়, কমেন্ট্রিবক্স থেকে কিশোর ভিমানীর জলদগম্ভীর ব্যারিটোন বলে উঠেছিল ‘Nothing is impossible’। বিশ্বাস করেছিলাম সেদিন তাঁর কথা। শেষ অবধি টেস্টটা জিতে গিয়েছিল ভারত। আর তিনি বলেছিলেন ‘Impossible is possible now. We have made it.’ তখন তিনি বছর ৩৬-এর এক জমাট কর্তৃত্ববান তরুণ ভাষ্যকার।

আর আমি ছিলাম ১৮-র তাঁর এক অতিসাধারণ মোহমুগ্ধ শ্রোতা। আজ, ৪৭ বছর পরেও নেহাতই বৃদ্ধ আমি চোখ বন্ধ করেও শুনতে পাচ্ছি সেই জলদগম্ভীর ব্যারিটোনে “Nothing is impossible”। এখনো গায়ে কাঁটা দেয় সেদিনের ওই গভীর রাতটা মনে পড়লে।

রিচার্ডসের অপরাজিত ১৫১-তে ভর দিয়ে প্রতম দিনের শেষে প্রথমে ব্যাটিং করা ওয়েস্ট ইন্ডিজ করেছিল ৫/৩২০। পরদিন বিষাণ সিং বেদির ৪/৭৩ আর চন্দ্রর ৬/১২০-এর বিরুদ্ধে ৩৫৯-এ শেষ হয়ে যাওয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ভিভের ১৭৭ ছাড়া বড় রান ছিল অধিনায়ক লয়েডের ৬৮।

দ্বিতীয় দিনের শেষে ভারত করেছিল ৫/১৬৯, পরদিন ২২৮-তে ইনিংস শেষ করার আগে। বড় রান বলতে ছিল মদনলালের ৪২ আর ভিশির ৪১। সংহারমূর্তি ধারণ করা হোল্ডিংয়ের বোলিং হিসেব ছিল ৬/৬৫। ৩য় দিনের শেষে দ্বিতীয় ইনিংসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ করেছিল ৩/১৩২। চতুর্থ দিন কালিচরণের অসামান্য ১০৩-এ ভর দিয়ে ৬/২৭১-তে দ্বিতীয় ইনিংস ডিক্লেয়ার করেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তাঁদের বোলিং শক্তির মাপকাঠিতে, তাদের হিসেবে এটা ‘সেফ’ টোটাল ছিল। ভেঙ্কট ৩ উইকেট নেন ৬৫ রান দিয়ে, চন্দ্রর ২/৮৮-এর পাশাপাশি।

দেড়দিনে ৪০৩- টার্গেট ছিল ভারতের সামনে। ৪র্থ দিনের শেষে যুদ্ধ জারী রাখার ইঙ্গিত দিয়ে ভারত অংশুমানের উইকেট (২৮) হারিয়ে ১৩৪ রান করে, অপরাজিত থাকেন সানি (৮৬) ও জিমি (১৪)। শেষদিন সানি ১০২ করে আউট হবার সময়ে স্কোর ছিল ১৭৭। সানি-জিমি জুটি তুলেছিলেন ১০৮ রান। তারপর তৃতীয় উইকেটে উঠেছিল ১৫৯ রান, জিমি-ভিশির সংগ্রামী জুটিতে।

দলের ৩৩৬ রানের মাথায় আউট হয়েছিলেন ভিশি (১১২)। অত:পর জিমি-ব্রিজেশ জুটি করেছিলেন ৫৬ রান, জিমি আউট হয়েছিলেন শতরানের চেয়েও দামী ৮৫ রান করে, ভারতের স্কোর যখন ৪/৩৯২ হয়ে গিয়েছিল। তখন আর ১১ রান বাকি ছিল ম্যাচ জিতে নিতে। ব্রিজেশ (অপরাজিত ৪৯)-মদনলাল (অপরাজিত ১) জুটি অনায়াসে তা তুলে নেন। ৪/৪০৬ স্কোর তুলে ম্যাচ জেতে ভারত। জুমাদিনের বোলিং হিসেব ছিল ২/৭০। ভারতের জেতা অন্যতম সেরা ও হিসেব কষা ক্রিকেটীয় অর্জন ছিল এই পোর্ট অব স্পেনের ১৯৭৬ সিরেজের তৃতীয় টেস্ট জয়।

এক বছর পরেও ভারতের দ্বিতীয় ইনিংস চলাকালীন প্রতি মুহূর্তে কিশোর ভিমানীর ব্যারিটোনিক আত্মবিশ্বাসটা যেন আজও কানের সামনে শুনতে পাই, স্মৃতির রেডিওতে। এখন আর সেই ক্রিকেট দিনগুলিও নেই আর সেই কিশোর ভিমানীও নেই।থেকে গেছে যা, তা হল সেদিনের পেলব স্মৃতিমেদুরতা।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...