একটা বার বছরের কিশোর, তখনও বোধ হয় স্বপ্নও দেখা শুরু করেনি। এইতো কেবল ব্যাটটা সজোরে চালানো শিখিয়ে। তবে তা সীমাবদ্ধ টেনিস বলেই। সে ছেলেকে এলাকার এক মাঠ থেকে আবিষ্কার করেন স্থানীয় এক কোচ। সে বার বছর বয়সে যখনও স্বপ্ন কি করে দেখতে হয় এবং পূরণ করতে হয় তা জানা ছিল না ঠিক তখন তিলক ভার্মা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখেছিলেন সুরেশ রায়নার ব্যাটিং।
অথচ আজ সেই তিলক ভার্মাই দ্যুতি ছড়াচ্ছেন আইপিএলের মহামঞ্চে। মাত্র বিশ বছর বয়সী এক তরুণ অভিজ্ঞ রবিচন্দ্রন অশ্বিনের বলে রিভার্স সুইপে ছক্কা হাঁকানোর দিব্যি সাহস দেখাচ্ছেন এবং হাঁকাচ্ছেনও। কিন্তু গল্পটা খানিক ভিন্ন হতে পারত। হয়ত আইপিএলের মত মহাযজ্ঞে কখনোই আসা হতনা তিলক ভার্মার। সাধারণ এক ইলেক্ট্রেশিয়ানের ছেলে পাড়া-মহল্লায় টেনিস বলে ক্রিকেট খেলে বেড়াত। পেশাদার ক্রিকেটটা হয়ত খেলা হতো না।
তবে নিয়তি হয়ত ঠিক ততটা রুক্ষ হতে চায়নি ‘ন্যাচারাল ট্যালেন্ট’ তিলক ভার্মার প্রতি। তাইতো হায়দ্রাবাদের প্রখ্যাত ক্রিকেট কোচ সালাম বায়াশের নজরে পড়ে যান তিলক। তিলককে খুঁজে পওয়ার স্মৃতিচারণ করে সালাম বলেন, ‘আমি তাঁকে (তিলক ভার্মা) দেখি টেনিস বলে স্থানীয় এক মাঠে খেলতে। আমার দেখেই মনে হয় সে যথেষ্ট প্রতিভাবান। এরপর আমি তাঁর বাবা-মায়ের সাথে কথা বলে তাদেরকে রাজি করাই তিলককে আমার অ্যাকাডেমিতে ক্রিকেট অনুশীলন করতে পাঠানোর জন্যে।’
প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দূরত্ব পারি দিয়ে তিলক তাঁর ক্রিকেট অনুশীলন চালিয়ে গিয়েছিলেন। তবে তাঁর ক্রিকেট ক্যারিয়ারে মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার পেছনে নিরব অবদান রয়েছে ভারতের সাবেক অলরাউন্ডার সুরেশ রায়নার। তিলকের যখন বার বছর বয়স তখন তাঁর কোচ সালাম বায়শ তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন চেন্নাই সুপার কিংসের নেট অনুশীলন দেখাতে। ঘটনাটা ২০১৪ সালের।
সে নেট সেশনে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে সুরেশ রায়নার ব্যাটিং দেখেছিলেন তিলক। সেদিনের ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে সালাম বলেন, ‘আমার স্পষ্ট মনে আছে বড় বড় চোখ করে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে তিলক সুরেশ রায়নার ব্যাটিং দেখছিল। সে সটান দাঁড়িয়ে থেকে প্রত্যেকটি শট খুব মনোযোগ সহকারে দেখছিল। এরপর আমরা রায়নার সাথে ছবি তুলি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস সেদিনের পর থেকেই তিলক নিজেকে একজন ক্রিকেটার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়।’
হয়ত এমনটাই হয়েছিল। তিলক রীতিমত গোগ্রাসে গিলছিলেন রায়নার ব্যাটিং। আর আজ তিনি অন্যতম সেরা একজন ব্যাটারের ব্যাটিং থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেই ব্যাট চালাচ্ছেন আপন গতিতে। মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের হয়ে এবারের আসরে খেলছেন তরুণ ক্রিকেটার তিলক ভার্মা। রাজরস্থান রয়্যালসের বিপক্ষে নিজের প্রথম ম্যাচেই দূর্দান্ত ব্যাটিং করে ঠিক ছোট্ট তিলকের মত করে নজর কেড়েছেন বর্তমানের পরিণত তিলক।
তবে এরজন্যে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি তাঁকে। দীর্ঘ একটা পথ পারি দিয়ে অনুশীলনে যেতে হয়েছে। কড়া রোদ আর তাপ উপেক্ষা করে অনুশীলন চালিয়ে যেতে হয়েছে। এমনও দিন গিয়েছে তাঁকে অ্যাকাডেমি মাঠে বসেও সেড়ে নিতে হয়েছে দুপুরের খাবার। সালাম বলেন, ‘মাঝে মাঝেই তাঁকে দুপুরের খাবারটা মাঠে বসেই খেতে হত।’
তবে শুধু যে একা তিলক কষ্ট করে গেছেন তা নয়। তাঁর পরিবারও নিদারুণ কষ্টের মাঝেও ছেলেকে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে গেছে। কোচ সালাম তিলকের পরিবারের সম্পর্কে বলেন, ‘তিলকের বর্তমান অবস্থানের জন্যে আমি তাঁর পরিবারকেও কৃতিত্ব দিতে চাই। তাঁরা কঠিন সব পরিস্থিতি মোকাবেলা করেও ছেলে সমর্থন জুগিয়ে গেছেন।’
রাজস্থান রয়্যালসের বিপক্ষে ৬১ রানের এক অসাধারণ ইনিংসের পর তিলক তাঁর বাবা-মা ও কোচকে কৃতিত্ব দিতে বিন্দুমাত্র ভুল করেননি। তিনি বলেন, ‘আমার বাবা-মা এবং কোচ না থাকলে আমি এতদূর অবধি আসতে পারতাম না। আমি আমার আজকের ইনিংসটা তাদেরকে উৎসর্গ করলাম।’
বয়সভিত্তিক দল থেকে শুরু করে অনূর্ধ্ব ১৯ জাতীয় দল থেকে এখন আইপিএলের মঞ্চ। স্বপ্ন যাত্রায় আরেকটু হেঁটে যেতে হবে তিলক ভার্মাকে। নিশ্চয়ই তিনি আরেকটু হেঁটে যাবেন কিংবা এবারের আইপিএলে ধারাবাহিক দ্যুতি ছড়িয়ে উসাইন বোল্ট হয় ছুঁয়ে দেখবে সেই নীল জার্সি। প্রশংসার সাগরের ভেসে পথভ্রষ্ট হবেন না তরুণ তিলক সেটাই হয়ত প্রত্যাশা সকলের।