ঘটনাটা ২০০১ সালের।
মুম্বাইয়ে সুরেশ রায়না তখন খেলছিলেন টাইম শিল্ড ট্রফিতে। সে সময় অতুল রণদে (সাবেক ভারতীয় ক্রিকেটার) তখন রায়নাকে জানলেন, সেখানে শচীন টেন্ডুলকার অনুশীলন করতে আসবেন। সুরেশ রায়না বড় হয়েছেন এমন একটা সময়ে যখন ভারতীয় ক্রিকেটের সাথে শচীনের নাম জড়িয়ে গেছে সমর্থক শব্দের মত।
শারজাহর সেই ইনিংস যখন তিনি দিনরাত দেখে থাকেন। শচীনের স্ট্রেইট ড্রাইভে রায়না এতটাই মুগ্ধ ছিলেন যে ১৯৯৯ সালে অস্ট্রেলিয়া সফরের খেলা দেখার জন্য রায়না অনেক সকালে উঠে বসে থাকতেন, একটা বলও যেন মিস না যায়।
মূল গল্পে ফিরে আসি। রণদে এসে খবরটা দেওয়ার পর সুরেশ রায়না রণদের কাছে আবদার করে বসেন শচীনের সাথে দেখা করিয়ে দেবার জন্য। উঠতি এই ক্রিকেটারের আবদার অতুল রণদে ফেলেননি। তিনি রায়নাকে দেখা করিয়ে দিয়েছিলেন।
সুরেশ রায়না দেখলেন, ‘সাহারা’ জার্সি পরে এক ক্রিকেটার এসেছেন অনুশীলন করতে, হাতে এমআরএফ এর লোগো লাগানো ব্যাট। তিনি শচীনের সাথে দেখা করলেন, একজন ক্রিকেটার হিসেবে না বরং একজন ভক্ত হিসেবে।
‘টিভি পর্দায় দেখা দেবতাতুল্য শচীন’ রায়নার চোখে ধরা দিলেন জীবন্ত হিসেবে, রক্তমাংসের সেই ক্রিকেটের দেবতা রায়নার মধ্যে আরও পরিশ্রমী, দেশের প্রতিনিধিত্ব করার আরো তাড়না ঢুকিয়ে দিল।
শচীনের সাথে রায়নার এরপর আরও অনেক অনেক স্মৃতি জমেছে। ২০০৮ সালে তাঁরা একসাথে অস্ট্রেলিয়া গিয়ে সিরিজ জিতেছেন, ২০০৮ সালে নিউজিল্যান্ডে গিয়ে সিরিজ জিতেছেন, একসাথে টেস্টের এল নম্বর দল হয়েছেন, গোটা একটা বিশ্বকাপও জিতেছেন একসাথে। তবুও রায়নার কাছে শচীনের সাথে কাটানো সেরা মুহুর্তটা ওটাই- যেটা কিনা একজন ফ্যান হিসেবে, শচীনের সতীর্থ নয়।
শচীন যখন শতকের শতক করেন ,অন্যপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিলেন সুরেশ রায়না নিজেই। সাকিব আল হাসানের বলে সিঙ্গেল নেওয়ার পর মাইলফলক ছুঁয়ে ফেলেন শচীন। এরপর সবার আগে তাকে অভিনন্দন জানানোর সুযোগ হয়েছিল রায়নার। তিনি ছুটে গেছিলেন, শচীনকে বলেছিলেন, ‘অভিনন্দন পাজি, এটা অনেক দিনের বকেয়া ছিল।’ সুরেশ রায়না পরে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছিল। আমি তখন বুঝলাম, এই মানুষটা কিভাবে সবকিছু সামলায়।’
সুরেশ রায়নার টেস্ট অভিষেক হয় শ্রীলঙ্কায়, ২০১০ সালে।
সে ম্যাচটাতে রায়না সেঞ্চুরি করেছিল, শচীন করেছিল ডাবল সেঞ্চুরি। সেই দিনের পরদিন শচীন , যুবরাজ আর হভজন রায়নাকে সাথে নিয়ে একটা জাপানি রেস্টুরেন্টে খেতে গেছিল। বাকিটা শোনা যাক রায়নার নিজের ভাষায়, ‘আমি ছিলাম ডল-রুটির মানুষ। তাই জাপানি রেস্টুরেন্টে যাওয়া ছিল আমার জন্য বিরাট কিছু। এরপর যখন শচীন একটা ওয়াসাবি অর্ডার করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, এটা খাও। আমি দুটো রুটির বানের মধ্যে ওয়াসাবি নিয়ে বার্গারের মত করে খেতে শুরু করলাম। আমার চোখ ফেটে জল আসছিল।’
শচীন টেন্ডুলকার এক সময় অবসর নিয়েছেন। কিন্তু রায়নার সাথে শচীনের সেই মধুর সম্পর্কটা অটুট আছে এরপরও। ২০১৪ সালেই ইংল্যান্ড সফরের আগে রায়না তাঁর ব্যাটিং নিয়ে কিছু কাজ করতে চাইছিলেন। তিনি তখন শচীনকে কল দেন আর শচীনের কাছে ব্যাটিংটা ঝালাই করে নেওয়ার জন্য সময় চান। শচীন তাঁকে দুই সপ্তাহ সময় দিয়েছিল।
সেই দুই সপ্তাহেরই একটা গল্প বলি তাহলে।
তাঁরা নিয়মিত ঘন্টার ওপরে অনুশীলন করত একসাথে। এরকমই একটা অনুশীলন দিনে, শচীন রায়না হঠাৎ কাছে ডাকেন। কাঁধে হাত রেখে বলেন, ‘তোমার নিজের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে। তোমাকে বিশ্বাস করতে হবে, তুমি মিরাকল করতে পার।’
ঐ একটা কথাই রায়নাকে এত উজ্জ্বীবিত করেছিল যে রায়না নিজের হাতে ‘বিলিভ’ লেখা একটা ট্যাটুও করিয়ে নিয়েছিলেন।
আর সেই দু সপ্তাহের ফলাফল? ইংল্যান্ড সফরে অন্যরকম এক ব্যাটিং এর রায়নাকে দেখেছিল ক্রিকেট বিশ্ব।সফরের প্রথম ওয়ানডেটা ভেসে গেছিল বৃষ্টিতে। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে সুরেশ রায়না ৭৫ বলে করেছিলেন ১০০ রান। সে ম্যাচে ম্যান অফ দা ম্যাচও হয়েছিলেন রায়না।
ম্যাচের পর শচীন রায়নাকে অভিনন্দনও জানিয়েছিলেন। রায়নার মুখ থেকেই শোনা যাক, ‘ম্যাচের পর আমি ফোন খুলে দেখি, পাজি আমাকে মেসেজ পাঠিয়েছেন – সব সময় নিজের ওপর বিশ্বাস রাখবে।’
শচীন টেন্ডুলকার এমনিতে ক্রিকেটের অবিসংবাদিত নায়ক। সুরেশ রায়নাকে নিয়ে ক্রিকেটে আছে অনেক আক্ষেপ।তবে সেই আক্ষেপের মাঝে তিনি দারুণ কিছু করেছেন নানা সময়ে। এই যেমন ইংল্যান্ড সফরে সেই সিরিজটাতে ভারত জিতেছিল ৩-১ ব্যাবধানে, তাতে ম্যান অফ দা সিরিজ হয়েছিলেন রায়না। আর তাতে শচীনের সেই দুটো সপ্তাহ, সেই একটা বাক্যের অবদান ভোলা যাবে না কোনভাবেই – যা বদলে দিয়েছিল রায়না।