১.
বিশ্বের সব খেলোয়াড়েরাই অধুনাকালে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ খেলেন। ভারতীয় খেলোয়াড়েরা শুধুমাত্র আইপিএল খেলেন,বাকীরা আইপিএল সহ পিএসএল, সিপিএল, বিগ ব্যাশ ইত্যাদি ইত্যাদি খেলেন। এবারের বিশ্বকাপ যে দেশে খেলা হলো সেই দেশে প্রায় দেড়মাস ধরে আইপিএল খেলাটা বরং অন্যতম প্র্যাকটিস টুর্নামেন্ট হওয়া উচিত।
তাছাড়া কিছুজন বাদ দিলে আইপিএল দেখে টিম সিলেকশনও হয়নি, সেটা হলে রুতুরাজ, হার্শালেরা দলে থাকতেন, নিদেনপক্ষে ভেঙ্কটেশ আইয়ারের মতো সাপ্রাইজ ট্যালেন্টও দলে থাকতেন। আইপিএলকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর কোনো মানে হয়না। আইপিএলকে নিতান্তই স্কেপ গোট হিসাবে দেখানো হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।
২.
স্যার ফ্র্যাঙ্ক ওরেল সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে একবার সি এল আর জেমস লিখেছিলেন, ‘The captain must not only choose in general. He must decide on a particular bowler for a particular situation or a particular batsman. Furthermore his is the responsibility of devising ways and means to help bowlers who are unable to dismiss a batsman.’
লেখাটা ১৯৭৮-৭৯ সালের। সুতরাং পরিসংখ্যানগত ভাবে শ্রেষ্ঠ এগারোদের নিয়েই যে দল গঠন করতে হবে এমন কোনো মানে নেই,বিপক্ষদের উইকনেস অনুযায়ী অনেক সময়েই কিছু ইনক্লুসন করা হয়। সেই সময়ে ক্যাপ্টেনই সবকিছু করতো।এখন এগুলো করার জন্য স্ট্র্যাটেজিস্ট,ডেটা অ্যানালাইজার, কোচেরা আছেন। এই বিশ্বকাপে দল গঠন নিয়ে প্রথমেই যে সংশয় দেখা দিলো যে এবারের দলগঠনে ঠিক কোন জিনিসটাকে গুরুত্ব দেওয়া হলো — ইয়ুথ নাকি এক্সপেরিয়েন্স?
ইয়ুথকে যদি গুরুত্ব দেওয়াই হলো তাহলে আরেকটু সাহসী কি হওয়া যেত না? আর এক্সপেরিয়েন্সকে গুরুত্ব দিলে গত নয় বছরে বিভিন্ন আইসিসি টুর্নামেন্টে অন্যতম সফল ওপেনিং জুটি কেন ভাঙা হলো? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন দলগঠনে ক্যাপ্টেনের মতামতকে ঠিক কতোটা প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল? সত্যি বলতে কি এগুলো কোনোদিনই আমরা জানতে পারব না, তাই আইপিএল, পানোতি, টসভাগ্য, ক্যাপ্টেন—এগুলো সবকিছুই আমাদের আত্মপ্রমোদনের উপায়মাত্র।
৩.
অধুনা ক্রিকেটের টি-টোয়েন্টি মাইন্ডসেট হয়তো ভারত আর অস্ট্রেলিয়া অনেকটাই রপ্ত করতে পারেনি। ২০১৪ সালের টি-টোয়েন্টি অ্যাপ্রোচ আর ২০২১ সালের অ্যাপ্রোচের অনেক পার্থক্য আছে। শিশির, পিচ, বিগ গ্রাউন্ড এসব কিছু মাথায় রেখেই বলছি শুধুমাত্র দৌড়ে দৌড়ে এখন টি-টোয়েন্টি খেলা যায় না, এখন বাউন্ডারি চাই, আর তার জন্য গ্যাপ খুঁজতে হবে, পিঞ্চ হিটার খুঁজতে হবে।
কভার ড্রাইভ, স্কোয়ার কাটের জায়গাগুলো ফিল্ডার দিয়ে ভরাট করা থাকে, তাই প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে স্কুপ, স্যুইপে মাস্টার্স করতে হবে। ২০১৬ সালের উইন্ডিজদের সাথে খেলাটা মনে আছে? একটা তথ্য দিয়ে রাখি, ওই ম্যাচে ভারত ২৭ টা ডটবল খেলেছিলো ইনিংসে, যেখানে উইন্ডিজরা খেলেছিলো ৫০ টা ডট বল, কিন্তু উইন্ডিজরা যেখানে ১১ টা ছয় মেরেছিলো ভারতীয়রা ইনিংসে ছয় মেরেছিলো মাত্র চারটা।
২০১৬ সালে ভারতীয়রা প্রতি ২৭ বলে মাত্র একটা ছক্কা মারতে পেরেছে (প্রতি ২৬.৮ বল প্রতি একটা ছক্কা)। আরও একটা তথ্য, ২০১৬ সালে ভারতীয় মোট রানের মাত্র ১৬.১% এসেছে বাউন্ডারি থেকে। সুতরাং, টি টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাউন্ডারি খোঁজায় ভারতীয়রা ঠিক কতোটা পিছিয়ে সেটা বোঝাই যাচ্ছে।
আর এর জন্য দায়ী কিছু মান্ধাতা মাইন্ডসেট সে যতোই অস্ট্রেলিয়াতে দু’বার টি-টোয়েন্টি সিরিজ জেতা হোক না। এই মাইন্ডসেট থেকে বের হতে না পারলে মাল্টি ন্যাশনাল টি টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে টিকে থাকা শক্ত। শুধুমাত্র ক্যাপ্টেন, রবি শাস্ত্রী, আইপিএল এর জন্য দায়ী নয়, টি-টোয়েন্টিতে আধুনিকতার অভাব অনেকটাই দায়ী।
৪.
ডেটা অ্যানালাইসিস ব্যবহারের সময় এসে গেছে। সব সময় যে ডেটা অ্যানালিসিস ঠিক এটা বলছি না, কিন্তু স্ট্র্যাটেজি তৈরিতে কিছুটা যদি সাহায্য করে তবে ক্ষতি কি? বাকি অনফিল্ড ডিসিশন তো ক্যাপ্টেনের জন্য তোলা রইলো।
সবশেষে এটুকুই বলার, একা কাউকে দায়ী করবার কোনো মানেই হয় না। সবসময় সব সিদ্ধান্ত ক্লিক করে না, আগের ম্যাচে ভুবির ইনক্লুসন ক্লিক করেনি, এ ম্যাচে ঈশান কিষাণের। অনেকগুলো ফ্যাক্টর ভারতের ক্লিক করেনি — টস, ডিউ ফ্যাক্টর ইত্যাদি ইত্যাদি। ক্যাপ্টেন ধোনি অনেকবার টস হেরেছেন, রিভিউ হেরেছেন, তাই কোহলিকে এর জন্য দায়ী করা যায় না।
বরং যেগুলো হাতে আছে সেগুলো বদলানো দরকার — মাইন্ডসেট, পিঞ্চ হিটিং ইত্যাদি ইত্যাদি। শ্রীলঙ্কা যদি ৯৬’-এ পিঞ্চ হিটিং দেখাতে পারে ভারত কেনো একুশ সালে পারবে না? ভারত এর চেয়েও খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে গেছে, মাঠে আগুন জ্বলেছে, খেলোয়াড়ের বাড়ি ভেঙেছে আবার এই ভারতই বাউন্স ব্যাক করেছে। শুধু কিছু পরিবর্তন দরকার। ব্যাস, পরের বছর আবার আশায় বুক বাঁধবো আমরা।