টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের উত্তম-মধ্যম-অধম

২০০৭ সালে শুরু হবার পর বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তার পারদ কেবলই ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে টি- টোয়েন্টি বিশ্বকাপের। এক সপ্তাহ পরই অস্ট্রেলিয়াতে শুরু হচ্ছে অষ্টম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আসর। বিশ্বকাপের এই আসরকে ঘিরে ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী ক্রিকেটপ্রেমীদের উত্তেজনা সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছেছে।

২০০৭ সালে শুরু হবার পর বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তার পারদ কেবলই ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের। এক সপ্তাহ পরই অস্ট্রেলিয়াতে শুরু হচ্ছে অষ্টম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আসর। বিশ্বকাপের এই আসরকে ঘিরে ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী ক্রিকেটপ্রেমীদের উত্তেজনা সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছেছে।

আগের সাতটি বিশ্বকাপেও ক্রিকেটপ্রেমীরা সাক্ষী হয়েছেন অসাধারন সব মুহুর্তের। আসুন এক নজরে ঘুরে আসা যাক আগের বিশ্বকাপের আসরগুলো থেকে।

  • ২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, দক্ষিণ আফ্রিকা

প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সাফল্য বদলে দিয়েছিল পরবর্তী দশকে ভারতীয় ক্রিকেটের গতিপথ। ইতিহাস রচিত হয়েছিল, জন্ম হয়েছিল নতুন এক কিংবদন্তির। অথচ মাসছয়েক আগের ওডিয়াই বিশ্বকাপের ব্যর্থতায় উল্টেপাল্টে গিয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেট।

রাহুল দ্রাবিড়, শচীন টেন্ডুলকার, সৌরভ গাঙ্গুলির মতো তারকারা নাম সরিয়ে নিয়েছিলেন দল থেকে। এক পর্যায়ে তো ক্রিকেট বোর্ড দল না পাঠানোর সিদ্ধান্তই নিয়ে ফেলেছিল। শেষে মহেন্দ্র সিং ধোনির নেতৃত্বে একদল তরুণকে পাঠানো হয় দক্ষিণ আফ্রিকায়। 

বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই ক্রিস গেইল বিধ্বংসী এক সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে টুর্নামেন্টের সুরটা যেন বেঁধে দিয়েছিলেন। যদিও ম্যাচে হেরে যায় ক্যারিবীয়রা। গ্রুপ পর্বে ভারত-পাকিস্তানের ম্যাচ চড়িয়েছিল উত্তেজনার পারদ, টাই হওয়া ম্যাচে সুপার উইকেটে জিতে বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে অপরাজেয় থাকার রেকর্ডটা দীর্ঘায়িত করেছিল।

নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে হারলেও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচে যুবরাজ সিংয়ের ছয় ছক্কায় ম্যাচ জিতে সেমিতে পা রাখে ভারত। ফাইনালে ওঠার লড়াইতেও নায়ক সেই যুবরাজ, তাঁর ৩০ বলে ৭০ রানের ইনিংসের কোনো জবাব ছিল না অস্ট্রেলিয়ার কাছে।

ফলে ফাইনালে আর একবার মুখোমুখি হয় ভারত-পাকিস্তান। এমনিতেই দুই দেশের যেকোনো ম্যাচই তুমুল উত্তেজনা ছড়ায়, তাঁর উপর বিশ্বকাপ ফাইনালে এই দুই দলের ম্যাচ যেন সবকিছু ছাড়িয়ে গিয়েছিল। টস জিতে ব্যাট করতে নামা ভারত গৌতম গম্ভীরের হাফ সেঞ্চুরিতে দাঁড় করায় ১৫৩ রানের লড়াকু সংগ্রহ। ব্যাট করতে নেমে আরপি সিং আর ইরফান পাঠানের তোপে পড়ে দ্রুত উইকেট হারাতে থাকে পাকিস্তান। কিন্তু একপ্রান্ত আগলে রেখেছিলেন মিসবাহ উল হক।

হরভজন সিংয়ের এক ওভারে তিন ছক্কা হাঁকিয়ে শেষ ওভারে এক উইকেট হাতে নিয়ে জয়ের লক্ষ্যমাত্রা নামিয়ে আনেন ১৩ রানে। যোগিন্দর সিংয়ের দ্বিতীয় বলেই ছক্কা হাঁকিয়ে জয়টাকে হাত ছোঁয়া দূরত্বে নামিয়ে আনেন। কিন্তু তারপরই সেই পাগলাটে স্কুপ, ক্যাচটা ধরেই শ্রীশান্তের সেই পাগলাটে দৌড়। চোখের পলকেই নায়ক থেকে ট্র্যাজিক হিরো মিসবাহ। ভারত জিতে নেয় বিশ্বকাপের প্রথম আসর, দুই বছর বাদেই জন্ম হয় ক্রিকেট বদলে দেয়া আসর আইপিএলের।

  • ২০০৯ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, ইংল্যান্ড

টি- টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দ্বিতীয় আসর অনুষ্ঠিত হয়েছিল বিশ্ব ক্রিকেটের তীর্থভূমি ইংল্যান্ডে। গ্রুপ পর্বে বাংলাদেশ এবং আয়ারল্যান্ডকে হারালেও সুপার এইটে টানা তিন হা সেমির আগেইও বিদায় নেয় ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ভারত। পাকিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, শ্রীলংকা, দক্ষিণ আফ্রিকা উঠেছিল শেষ চারে আর লর্ডসে অলএশীয় ফাইনালে মুখোমুখি হয় শ্রীলংকা-পাকিস্তান।  

টস জিতে ব্যাটিং নিলেও আব্দুর রাজ্জাকের বোলিংয়ের সামনে থিতু হতে পারেননি কোনো লংকান ব্যাটার। অধিনায়ক কুমার সাঙ্গাকারার ৬৪ রানের সুবাদে ১৩৮ রানের সম্মানজনক সংগ্রহ পায় পাকিস্তান। জবাব দিতে নেমে শহিদ আফ্রিদির ঝড়ো ফিফটিতে সহজেই ম্যাচ জিতে নেয় পাকিস্তান। দ্বিতীয় আসরের শিরোপা জিতে কিছুটা হলেও প্রথম আসরের ক্ষতে প্রলেপ দিতে পেরেছিল পাকিস্তান। 

  • টি -টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০১০, ওয়েস্ট ইন্ডিজ

ক্যারিবিয়ানের সাগরপাড়ে সেবার বসেছিল তৃতীয় টি -টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আসর। ক্রিকেটের শুরুটা ইংল্যান্ডের মাটিতে হলেও তখনো পর্যন্ত ওডিয়াই বিশ্বকাপ কিংবা টি- টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পাওয়া হয়নি ইংল্যান্ডের। ১৯৭৯, ১৯৮৭, ১৯৯২ বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠলেও সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে রানার্স আপ হয়েই।  

অবশেষে পল কলিংউডের হাত ধরেই বদলায় সেই ধারা। আফগানিস্তান এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে জিতলেও অস্ট্রেলিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, শ্রীলংকার বিপক্ষে হারে টানা দ্বিতীয়বারের মতো সেমির আগে বিদায়ঘন্টা বাজে ভারতের। আগেরবারের দুই ফাইনালিস্ট পাকিস্তান-শ্রীলংকাও সেমিতে অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের কাছে হেরে বিদায় নেয় ফাইনালের আগেই। 

ক্রিকেটের কুলীন দুই সদস্যের লড়াইতে শেষ হাসিটা ইংলিশদেরই। ক্রেইগ কিসওয়েটারের অপরাজিত ৬৩ আর কেভিন পিটারসেনের ৪৭ রানে ভর করে অস্ট্রেলিয়ার দেয়া ১৪৭ রানের লক্ষ্য ১৭ ওভারের মাঝেই পেরিয়ে যায় পল কলিংউডের দল।

  • টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ – ২০১২, শ্রীলঙ্কা

ওডিয়াই বিশ্বকাপের প্রথম দুই আসরের শিরোপা জিতলেও যত সময় গড়িয়েছে ততই অস্তমিত হয়েছে ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের স্বর্ণযুগ। অবশেষে ২০১২ টি -টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জেতার মধ্য দিয়ে প্রায় ৩৩ বছরের শিরোপাখরা কাটায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। 

নেট রান রেটে কাটা পড়ে মাত্র এক ম্যাচ হেরেও সেমির দৌড় থেকে বাদ পড়ে ভারত। সেমিতে স্বাগতিক শ্রীলঙ্কা হারায় পাকিস্তানকে, অন্যদিকে অজিদের হারিয়ে ফাইনালে ওঠে ড্যারেন স্যামির ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সাম্প্রতিক ফর্ম, চেনা পরিবেশ, দর্শক সমর্থন সবকিছু বিবেচনায় ফাইনালে স্বাগতিকরাই ছিল নিরংকুশ ফেবারিট। 

কিন্তু ফাইনাল এমনই এক মঞ্চ, যেখানে কাজে লাগে না পূর্বের কোনো পরিসংখ্যান। কলম্বোতে শুরুতে ব্যাট করতে নেমে রীতিমতো ব্যাটিং ধবসে পড়ে ক্যারিবীয়রা, অজন্তা মেন্ডিসের তোপে পরে রানের খাতা খোলার আগেই সাজঘরে ফেরত যান ক্রিস গেইল।

তবে একপ্রান্ত আগলে ছিলেন মারলন স্যামুয়েলস, তাঁর ৭৮ রানে ভর করে ১৩৮ রানের সংগ্রহ পায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। জবাব দিতে নেমে সুনীল নারাইনের নয় রানে তিন উইকেটের সুবাদে ১১০ রানেই গুটিয়ে যায় শ্রীলংকা। ফলে কলম্বোর স্টেডিয়াম ভর্তি দর্শকদের কাঁদিয়ে সেদিন বেজেছিল ক্যারিবিয়ান ক্যালিপ্সোর সুর। 

  • টি- টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০১৪, বাংলাদেশ 

২০০৭ সালের পর সেবারই প্রথম বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেছিল ভারত। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কার তিন কিংবদন্তি মাহেলা জয়াবর্ধনে, কুমার সাঙ্গাকারা, তিলকরত্নে দিলশানের ছিল সেটাই শেষ টি- টোয়েন্টি বিশ্বকাপ।  

বিরাট কোহলির অবিশ্বাস্য ফর্ম আর ধোনির বুদ্ধিদীপ্ত অধিনায়কত্বে ভর করে কোনো ম্যাচ না হেরেই ফাইনালে পৌঁছায় ভারত। কিন্তু ফাইনালে লাসিথ মালিঙ্গা আর নুয়ান কুলাসেকারার ওয়াইড ইয়র্কারের কোনো জবাব ছিল না ভারতীয় ব্যাটারদের কাছে।

কোহলি ৭৭ রান করলেও ভারত স্কোরবোর্ডে রান তুলতে পারে মোটে ১৩০। দুই অভিজ্ঞ জয়াবর্ধনে আর সাঙ্গাকারার ব্যাটে লংকানরা ম্যাচ জিতে নিয়েছিল সহজেই। ফলে প্রথমবারের মতো টি -টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা গিয়েছিল লংকাদ্বীপে। 

  • টি- টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২১০৬, ভারত  

প্রথমবারের মতো টি -টোয়েন্টি বিশ্বকাপের স্বাগতিক হবার সুযোগ পায় ভারত। ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ জেতার দৌড়ে তারাই ছিল নিরঙ্কুশ ফেবারিট। উদ্বোধনী ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে হারলেও পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ জিতে সেমিতে ওঠে স্বাগতিকরা। 

কিন্তু সেমিতে ভুতুড়ে নো বল, নখদন্তহীন বোলিং আর ফিল্ডিং ব্যর্থতার পাশাপাশি লেন্ডল সিমন্সের ৮২ আর আন্দ্রে রাসেলের বিধ্বংসী ৪৩ রানের সুবাদে ১৯৩ রানের টার্গেট দিয়েও হারতে হয় ম্যাচ। বিফলে যায় কোহলির ৮৯ রানের অনবদ্য এক ইনিংস। 

ইডেন গার্ডেন্সের ইংল্যান্ড-ওয়েস্ট ইন্ডিজ ফাইনালটা ক্রিকেট ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা ফাইনাল। ইংলিশদের দেয়া ১৫৬ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারালেও একপ্রান্ত আগলে রেখে টিকে ছিলেন আগের বিশ্বকাপ ফাইনালের নায়ক মারলন স্যামুয়েলস।

তবে তাঁর ৮৫ রানের অনবদ্য ইনিংসটাওে বৃথা যেতে বসেছিল যদি না কার্লোস ব্র্যাথয়েট অতিমানব হয়ে দাঁড়াতেন। শেষ ওভারের ১৯ রানের দরকার পড়লে বেন স্টোকসকে টানা চার ছক্কা হাঁকিয়ে দলকে জিতিয়ে দেন এই তরুণ। রাতারাতি বনে যান জাতীয় নায়ক, বিশ্বকাপ ফাইনালের মঞ্চে আরও একবার বেজে ওঠে ক্যারিবিয়ান ক্যালিপ্সোর সুর।

  • ২০২১ টি -টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, সংযুক্ত আরব আমিরাত 

২০২০ সালের টি- টোয়েন্টি বিশ্বকাপ অস্ট্রেলিয়াতে হওয়ার কথা থাকলেও করোনা মহামারির কারণে ২০২১ বিশ্বকাপ আয়োজন করা হয় আরব আমিরাতে। আর ২০২২ টি- টোয়েন্টি বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব পায় অস্ট্রেলিয়া।  

এই বিশ্বকাপেই প্রথমবারের মতো আইসিসি বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে ভারতকে হারানোর স্বাদ পায় পাকিস্তান। শাহীন আফ্রিদির বোলিংয়ের পাশাপাশি মোহাম্মদ রিজওয়ান এবং বাবর আজমের ব্যাটে ভর করে দশ উইকেটের রাজসিক জয় পায় তাঁরা। সেই ধাক্কা আর কাটিয়ে উঠতে পারেনি বিরাট কোহলির দল, নিউজিল্যান্ডের কাছে হেরে বিদায় নেয় গ্রুপ পর্ব থেকেই।

ফাইনালে সেবার মুখোমুখি হয়েছিল তাসমান পাড়ের দুই প্রতিবেশি অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড। ফাইনালে মিচেল মার্শ এবং ডেভিড ওয়ার্নারের ব্যাটে ভর করে নিউজিল্যান্ডকে আট উইকেটে হারিয়ে প্রথমবারের মতো টি- টোয়েন্টি বিশ্বকাপের স্বাদ পায় ক্রিকেটের সবচেয়ে সফলতম দলটি।   

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...