আনুমানিক তিন-চার বছর বয়সী একটি শিশু। মিরপুর একাডেমি মাঠে মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে। খানিক বাদেই উঠে মাঠের মাঝে গুটি গুটি পায়ে দৌড়াচ্ছে। বলা হয়ে থাকে বাচ্চারা স্বভাবগতই অনুকরণপ্রিয়। এখানেও আসল ঘটনা তা। ছোট্ট বাচ্চাটি থেকে একটু এগিয়ে চোখ যেতেই দেখা গেল বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের বাঁহাতি স্পিনার তাইজুল ইসলামকে।
তাইজুল মাঠের এপ্রান্ত হতে ওপ্রান্তে ক্রমাগত দৌড়াচ্ছেন। আর এতোক্ষণ যে বাচ্চাটির কথা বলছিলাম, সেটি তাইজুলেরই পুত্র। নাম তাইফ জাওয়াদ বিন ইসলাম। বাবাকে দেখে দেখে ছোট্ট তাইফও মাঠে দৌড়াচ্ছে। খানিক বাদে এসে আবার অনুশীলনরত বাবার হাত ধরার চেষ্টা করছে। পিতা- পুত্রের মেলবন্ধনের এমন অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য দেখলে যে কারোরই চোখ জুড়িয়ে যাওয়ার কথা।
কিছুক্ষণ পর মাঠে দেখা গেল বাংলাদেশ দলের নিয়মিত উইকেটরক্ষক নুরুল হাসান সোহানকে। আঙ্গুলের চোটের কারণে ছিটকে গিয়েছেন এশিয়া কাপ থেকে। সেই সোহানকে দেখা গেল সতীর্থ তাইজুলের পুত্র তাইফকে আদর করতে এগিয়ে যেতে। হাত বাড়িয়ে তাকে ধরার চেষ্টা করলেন সোহান। ওমনি ছোট্ট তাইফ দৌড়ে গিয়ে বাবা তাইজুলের পেছনে লুকিয়ে পড়লো। পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল যে বাবা, তা এই ছোট্ট বয়সেই বুঝে গিয়েছে অবুঝ শিশুটি।
তা হোক বাবার সতীর্থকে দেখে লাজুক খুনশুটি কিংবা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বাঁধা – বাবার ছায়া থাকলে যে সবই সহজ হয়ে যায়। এমনিতে স্পিনার তাইজুল ইসলাম আচরণ ও চলাফেরায় খুব শান্ত, কথাবার্তায় মিতভাষী। এক্কেবারে খাঁটি ‘ফ্যামিলি ম্যান’ যাকে বলে তাইজুল ওরকম। তাইজুলের পৃথিবীর একপ্রান্তে যদি থাকে ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা, অন্য প্রান্তে রবে তাঁর পরিবার।
এদিকে ১৭ আগস্ট প্রকাশিত আইসিসির ওয়ানডে বোলারদের র্যাঙ্কিংয়ে ১৮ ধাপ এগিয়ে ৫৩তম স্থানে উঠে এসেছেন তাইজুল ইসলাম। তাঁর রেটিং ৪৬৯ পয়েন্ট। এটি তাইজুলের ক্যারিয়ার সেরা র্যাঙ্কিং। ২০১৪ সালের পহেলা ডিসেম্বরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে অভিষেক ঘটে তাইজুল ইসলামের। অভিষেকেই বাংলাদেশ ক্রিকেটে বিধ্বংসী এক ঝড়ের আগমণী বার্তা দিয়েছিলেন।
একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথম বোলার হিসেবে অভিষেকেই হ্যাটট্রিক করার কীর্তিগাঁথা রচনা করেন এই বাঁহাতি স্পিনার। আবার টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তার অভিষেক টেস্টেই তিনি ফাইফার নেয়ার গৌরভ অর্জন করেছিলেন। ক্যারিয়ারে এখন অব্দি ৩৮ টেস্টে তিনি ১৫৮ টি উইকেট নিয়েছেন। আর ১২ টি ওয়ানডেতে তাঁর ঝুলিতে রয়েছে ২০ উইকেট। আর দুই টি- টোয়েন্টি তে নিয়েছেন একটি উইকেট। অবশ্য টুকটাক ব্যাটিংটাও মাঝেমধ্যে করে নেন তিনি।
এক্কেবারে ছোট্ট বয়স থেকেই রক্তে ছিল ক্রিকেটের নেশা। সামর্থ্য কম থাকলেও একমাত্র ছেলেকে নিয়ে বাবা- মায়ের সাধের কমতি ছিলনা। ছেলেকে ক্রিকেটার বানানোর জন্য সবটুকু ঢেলে দিয়েছিলেন তাঁরা। ওদিকে তাইজুলও পেরেছিলেন বাবা- মায়ের মুখ উজ্জ্বল করতে। নিজের স্বপ্নটাকে বাস্তবে রূপ দিতে। ছোট্ট বয়সে একবার এলাকার ক্রিকেট দলে খেলে দলকে জিতিয়ে সম্মানী পেয়েছিলেন মাত্র দশ টাকা। দিন বদলেছে। পাড়ার ক্রিকেট ছেড়ে বেশ লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে তাইজুল এখন জাতীয় দলের ওয়ানডে ও টেস্টের বড় ভরসার নাম। সম্মানীর টাকার অঙ্কটা গুণে থাকেন ছয় অংকের ঘরে।
মাঠে বাবা তাইজুলের অনুশীলন অনুকরণে দৌড়ানো ছোট্ট তাইফ বড় হয়ে বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ক্রিকেটার হবে কিনা, তা এখনই বলা যাবেনা। কিন্তু যদি ক্রিকেটার হতেই চায় সে, অন্তত বাবার মতো কঠিন সংগ্রামের পথ পাড়ি দিতে হবেনা তাকে। বাবা তাইজুল যে বড্ড বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়েছিলেন। আগুনে পুড়ে পুড়ে স্বর্ণ যেমন খাঁটি হয়, তাইজুলও তেমনি জীবনযুদ্ধে সংগ্রাম করতে করতে অসাধারণ বোলারে পরিণত করেছেন নিজেকে।