সেরা বাঙালি একাদশ

একটা সময় দুই বাংলার ক্রিকেটের খুব আদানপ্রদাণ ছিল।

পশ্চিম বাংলা দল প্রায়শ বাংলাদেশ সফরে আসতো। বাংলাদেশও যেতো পশ্চিম বাংলা সফরে। সেগুলো ছিলো উৎসবের মত। আমাদের বয়সভিত্তিক দলগুলোর দেশের বাইরে হাতেখড়িই হতো এই পশ্চিম বাংলা সফর দিয়ে। নানা কারণে সেই সফর বিনিময় অনেক কমে গেছে। কিন্তু দুই বাংলা নিয়ে রোমান্টিসিজম তো কমেনি।

আজ পহেলা বৈশাখ। দুই বাংলার মানুষের এক উৎসবে মাতার দিন। এমন দিনে দুই বাংলার ক্রিকেটকেও এক করে কিছু ভাবলে কেমন হয়? তাই করলাম আমরা। দুই বাংলার সেরা ক্রিকেটারদের নিয়ে তৈরী করলাম একটা একাদশ। একাদশটা তৈরি হওয়ার পর মনে হলো, এই দলটাকে চাইলে বিশ্বকাপ খেলিয়ে দেওয়া যেতে পারে, কিংবা টেস্ট ম্যাচ তো অবশ্যই!

এই একাদশে কিছু না তো নিশ্চিত। সাকিব, তামিম, সৌরভের মতো খেলোয়াড়রা আছেন। আবার সুব্রত, মুস্তাফিজের মত অনেককে একটু ঝুকি নিয়ে দলে রাখা হয়েছে। দলে দারুণ একটা লিডারশিপ গ্রুপ আছে। সব মিলিয়ে দলটা লড়াই করতে পারবে।

  • পঙ্কজ রায়

অবশ্যই দুই বাংলার কোনো যৌথ দল হলে সেই দলের সবচেয়ে নিশ্চিত দু তিন খেলোয়াড়ের একজন হবেন পঙ্কজ রায়। পংকজকে বলা যায়, এই দলটার প্রতীক। বাংলাদেশের জমিদার নন্দন; কিন্তু ভারতের হয়ে বিশ্ব কাঁপিয়েছেন।

পঙ্কজ রায়ক বিক্রমপুরের জমিদারদের সন্তান। বড় তরফের সন্তান ছিলেন তিনি। ফলে জমিদারি প্রথা থাকলে তিনিই জমিদার হতেন। তাই তাঁকে ঢাকার ছেলে বলে এই বাংলা দলে বাড়তি একটা গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে। তবে পঙ্কজের জন্ম কলকাতায়।

পশ্চিম বাংলার ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই ব্যাটসম্যান ভারতের হয়ে ১৯৫১ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে ৪৩টি টেস্ট খেলে ২৪৪২ রান করেছেন। ৩২.৫৬ গড়ে রান করার সময় ৫টি সেঞ্চুরিও ছিলো তার। স্টাইলিশ পংকজ রায় দারুন একটা সূচনা এনে দিতে পারবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

  • তামিম ইকবাল

পংকজ রায়ের সঙ্গী হিসেবে তামিম ইকবাল ছাড়া কাউকে মানায় না। দুই বাংলা মিলিয়ে সৌরভের পর সবচেয়ে বড় রান স্কোরার তামিম। বাংলাদেশের সেরা ব্যাটসম্যান তো বটেই। ফলে এই দলের ইনিংস শুরুর দায়টা পংকজ ও তামিমের।

তিন ফরম্যাটেই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রান ও সর্বোচ্চ ইনিংস তার। প্রায় ১৫-১৬ হাজার আর্ন্তজাতিক রান আছে তার নামের পাশে।

চট্টগ্রামের ছেলে তামিম ও ঢাকার বংশোদ্ভুত পংকজের জুটিটা হতে পারে দুনিয়া কাপানো একটা জুটি। আমরা এই জুটির ওপর ভরসা রাখছি।

  • সৌরভ গাঙ্গুলি (অধিনায়ক)

নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না যে, এই দলে সাকিব আল হাসান ও সৌরভ গাঙ্গুলি অটো-চয়েজ!

দুই বাংলা মিলিয়ে সবচেয়ে বড় ক্রিকেট তারকা সৌরভ গাঙ্গুলি। নিশ্চয়ই ভারতের ইতিহাসেরও অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান সৌরভ। দুই বাংলার লোকেরাই তাকে সমানভাবে ভালোবাসে। অনেক সময়ই দুই বাংলার ক্রিকেটের প্রতীক হয়ে ওঠেন তিনি।

ভারতের হয়ে ১১৩টি টেস্ট ও ৩১১টি ওয়ানডে খেলেছেন। ১১ হাজারের ওপরে ওয়ানডে রান এবং ৭ হাজারের ওপরে টেস্ট রান সৌরভের হয়ে কথা বলবে। নিজের সময়ে বিশ্বের সেরা বাহাতিদের একজন ছিলেন।

সৌরভের আরেকটা বড় ব্যাপার, অধিনায়কত্ব। এটা ঠিক যে, আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি বাদে বড় কোনো ট্রফি জিততে পারেননি। তবে ভারতের আধুনিক অধিনায়কত্বের স্থপতি মনে করা হয় ২০০৩ সালের ফাইনালিস্ট এই সৌরভকে। আমাদের এই দলটার অধিনায়কও তাই সৌরভ গাঙ্গুলি।

  • হাবিবুল বাশার

হাবিবুল বাশারকে এই দলে ‘সেরা চার নম্বর’ বলে আমরা হাজির করতে পারি। যদিও এখানে মুশফিকুর রহিমকেও বিবেচনা করা যেতো। কিন্তু মুশফিক তার ক্যারিয়ারের বড় একটা সময় ৫ নম্বরে খেলায় আমরা তাকে চার নম্বরে আনিনি।

হাবিবুল বাশারের ব্যাটসম্যানশিপ নিয়ে তুলনামূলক কম কথা বলা হয়। তবে নিশ্চয়ই তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন। বাংলাদেশের প্রথম ধারাবাহিক রান সংগ্রাহক বলা যায় তাকে। ৫০টি টেস্ট ও ১১১টি ওয়ানডে খেলেছেন। দুই ফরম্যাটেই নিজের সময়ে দেশের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন।

হাবিবুলকেও অধিনায়ক হিসেবে বিবেচনা করা যেতো। কিন্তু দলে সৌরভ ও মাশরাফি থাকায় তার সম্ভাবনাটা নেই হয়ে গেছে। এটা ঠিক যে এই দলটায় ভালো একটা লিডারশিপ গ্রুপ তৈরী হয়েছে।

  • মুশফিকুর রহিম

ব্যাটসম্যান হিসেবে তাঁর অর্ন্তভূক্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। তিনি নি:সন্দেহে দুই বাংলা মিলিয়ে সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন।

তিন ফরম্যাটেই নিজেকে অপরিহার্য বলে প্রমাণ করেছেন। দারুন সব শট করতে পারা এই ব্যাটসম্যানের সে অর্থে মিডল অর্ডারে তেমন প্রতিদ্বন্ধী নেই।

মুশফিকুর রহিত একজন উইকেটরক্ষক। তারপরও তাকে আমরা এই দায়িত্বটা দিচ্ছি না। কারণ, আমরা দলে রেখেছি, দুই বাংলা মিলিয়ে সেরা উইকেটরক্ষক ঋদ্ধিমান সাহাকে।

  • সাকিব আল হাসান

দুই বাংলার দলে সবচেয়ে নিশ্চিত নাম সাকিব আল হাসান।

সম্ভবত দুই বাংলা মিলিয়ে সবচেয়ে বড় স্পোর্টস ব্র্যান্ড তিনি। তাকে ছাড়া বাংলাদেশের সেরা একাদশই করা সম্ভব না। সম্ভবত এখন বিশ্ব একাদশ করলেও সাকিবকে বাদ দিয়ে করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। ফলে এই দলে তার নাম নিয়ে তো আলোচনারই সুযোগ নেই।

রান, নাকি উইকেট; কিভাবে তাকে মনে রাখবেন, এটা আপনার ব্যাপার। তবে একটা কথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, পৃথিবীর ইতিহাসে তার মত জেনুইন অলরাউন্ডার খুব বেশি আসেনি।

সাকিব এই দলের জন্য আরেকটা বড় ব্যাপার, সেই লিডারশিপ গ্রুপ। তিনিও এই দলের অধিনায়ক হওয়ার যোগ্যতা রাখেন।

  • ঋদ্ধিমান সাহা (উইকেটরক্ষক)

সাহাকে পরিসংখ্যান দিয়ে যোগ্য বলে প্রমাণ করাটা একটু কঠিন। কারণ, তিনি খুব বেশি ম্যাচ খেলেননি। খেললেও সেরকম পারফরম করতে পারেননি। কিন্তু সাহা এই যুগে বিশ্ব ক্রিকেটের বিরল হতে বসা একজন জেনুইন উইকেটরক্ষক।

সাহার প্রতিদ্বন্ধী হতে পারতেন খালেদ মাসুদ পাইলট বা সাবা করিম। কিন্তু উইকেটের পেছনে তৎপরতা ঋদ্ধিমান সাহাকে এগিয়ে রেখেছে। এটা ঠিক যে, আমরা তার ব্যাট থেকে আরেকটু রান আশা করবো।

  • মোহাম্মদ রফিক

দুই বাংলা মিলিয়ে অবশ্যই সেরা বাহাতি স্পিনার। রফিক বাংলাদেশের সেরা স্পিনার তো বটেই। তবে তাকেও আপনি পরিসংখ্যান দিয়ে চিনতে পারবেন না। সেই সময়ের কার্যকরিতা আপনাকে মনে করতে হবে।

রফিক ৩৩টি টেস্ট, ১২৫টি ওয়ানডে ও ১টি টি-টোয়েন্টি খেলেছেন। ১০০ টেস্ট ও ১২৫ ওয়ানডে উইকেটের মালিক তিনি। তার সময়ে সর্বোচ্চ উইকেটের মালিক ছিলেন বাংলাদেশে।

বাহাতি এই জাদুকর নি:সন্দেহে তার এই পজিশনের জন্য সেরা পছন্দ। যদিও আমাদের দলের দু জন স্পিনারই বাহাতি স্পিনার। তারপরও সেরাদের বেছে নিতে এ ছাড়া কিছু করার ছিলো না।

  • মাশরাফি বিন মুর্তজা (সহ অধিনায়ক)

আমরা তিন পেসার দলে রেখেছি। সেখানে প্রথম পেসার হিসেবে অবশ্যই মাশরাফির নাম আসবে। তাকে নিয়ে ইনজুরির আফসোস না করাই ভালো। কারণ, যা খেলেছেন, তাতেও তিনি গ্রেটদের কাতারে পড়েন।

৩৬ টেস্টে ৭৮ উইকেট। এবং ২২০ ওয়ানডেতে ২৭০ উইকেট ও ৫৪ টি-টোয়েন্টিতে ৪২ উইকেট। এই পরিসংখ্যান হয়তো মাশরাফিকে ঠিক চেনাতে পারবে না। বলতে পারবে না যে, কিভাবে তিনি একটা দলের পেস বোলিংয়ের ঘানি একাই টেনেছেন বছরের পর বছর।

মাশরাফি এই দলের অধিনায়ক হতে পারতেন। অধিনায়ক হিসেবে তার লড়াইটা ছিলো সৌরভের সাথে। তাই সব ধরণের যোগ্যতা থাকার পরও তিনি লড়াইটা জিততে পারেননি। আমরা তাই মাশরাফিকে সৌরভের ডেপুটি হিসেবে রেখেছি।

  • সুব্রত ব্যানার্জি

এই নামটা অনেককে অবাক করতে পারে। মাত্র ১টি টেস্ট ও ৬টি ওয়ানডে খেলা সুব্রত কী করে এই একাদশে এলেন!

আমরা আসলে সুব্রতর সম্ভাবনা ও অপচয়টাকে বিবেচনায় নিয়েছি। নব্বইয়ের দশকে ভারতের সেরা ফাস্ট বোলারদের একজন ছিলেন সুব্রত। তার সাথে ভারতীয় দলে লড়াইটা ছিলো মূলত জাভাগাল শ্রীনাথের। নানা সময়ে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করলেও কোনো এক বিচিত্র কারণে জাতীয় দলে স্থায়ী হতে পারেননি। তবে যা কিছু সুযোগ পেয়েছেন, তাতে নিজেকে প্রমাণ করেছেন।

মাশরাফির সাথে সুব্রতর দারুণ একটা জুটি হবে মলেই মনে করা যায়।

  • মুস্তাফিজুর রহমান

এই দলের সবচেয়ে তরুণ সদস্য। আর এই দলটা সীমিত ওভারের ক্রিকেট খেলতে নামলে সবচেয়ে কার্যকর খেলোয়াড় তারই হওয়ার কথা।

পরিসংখ্যান সীমিত ওভারে তাঁর সামর্থের প্রমান দেয়। টেস্টেও খু্ব খারাপ করেছেন, তা নয়। ১৪ টেস্টে ৩০ উইকেট আছে তার।

মুস্তাফিজ মূলত পুরোনো বলের দারুন বোলার। সুব্রত ও মাশরাফি নতুন বলে শুরু করলে ভেতরের ওভারগুলো মূলত সাকিব ও রফিক করবেন। আর শেষ দিকে মুস্তাফিজ আগুন ঝরাবেন!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link