কেপটাউনের ম্যাজেস্টিক মাস্টার

শচীন তাঁর সেই অনবদ্য ইনিংসে ব্যাট করেছিলেন সর্বমোট ৩২৯ মিনিট। এ সময়কালে তিনি বল খেলেছিলেন ২৫৪টি বল। তাও ওমন বাঘাবাঘা বোলারদের সামনে ঠায় দাঁড়িয়েছিলেন শচীন। আউট হয়েছিলেন দলের শেষ ব্যাটার হিসেবেই। তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্য এতো দীর্ঘ সময় ধরে ব্যাট করার পরও শচীনের ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা ইনিংসে ছিলো না একটিও ছক্কা। তবে ২৬টি চার মেরেছিলেন ‘দ্য লিটল মাস্টার’। এক কথায় কোন ধরণের বাড়তি ঝুঁকি তো দূরে থাক ক্রিকেটীয় পুস্তকে থাকা যতসব অসাধারণ শটের বাইরে একটি শটও সেদিন খেলেননি শচীন।

‘তারপর আমরা দেখলাম স্ট্রেইট ড্রাইভ, কভার ড্রাইভ, পুল, কাট সকল ক্রিকেটীয় টেক্সটবুক শট। শচীন সেদিন কার্যত অ্যালান ডোনাল্ডের বোলিংকে নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছিল।’

ঠিক এমন করেই ১৯৯৭ সালের শুরুর দিকে দক্ষিণ আফ্রিকার কেইপ টাউনে খেলা শচীন টেন্ডুলকারের এক অনবদ্য ইনিংসেরই প্রসংশা করেন তৎকালীন প্রোটিয়া অধিনায়ক আলী বাখের। সেদিন একাই যেন হোক প্রতিরোধ মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে প্রোটিয়া বোলারদের একহাত দেখে নিয়েছিলেন ভারতীয় কিংবদন্তি ব্যাটার শচীন টেন্ডুলকার।

১৯৯৭ এর শুরুর দিকে। দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে তখন ভারত ক্রিকেট দল। প্রথম টেস্ট খুব বাজে ভাবে হেরে গিয়েছে ভারত। দক্ষিণ আফ্রিকান খেলোয়াড়েরা ৩২৮ রানে ডারবান টেস্ট জিতে নিয়েছিলো। খানিক বেগতিক অবস্থায়ই ছিলো ভারত। তাই দ্বিতীয় টেস্ট একপ্রকার সিরিজ বাঁচানোর লড়াই ভারতের সামনে। কিন্তু কিসের কি! ভারতীয় বোলারদের তুলোধুনো করে ৫২৯ রানে সাত উইকেট হারিয়ে ইনিংস ঘোষণা করে প্রোটিয়ারা।

পাহাড়সম রান পেড়োনোর একটা মানসিক চাপে ভারতের টপ অর্ডার ব্যাটাররা ঠিকঠাক আর নিজেদেরকে সামলে নিতে পারলেন না। টপাটপ চলে গেলেন সাঁজঘরে। ৩৩ রানেই নেই চার উইকেট। সৌরভ গাঙ্গুলী যখন ফিরে যাচ্ছেন ঠিক সেই মুহূর্তে পাঁচ নম্বরে ব্যাট করতে নামলেন শচীন টেন্ডুলকার।

কি পরিমাণ চাপের মুখে নেমেছিলেন তা আর ভেঙে বলবার কিছু  নেই। কিন্তু সেদিনটায় শচীন টেন্ডুলকার ছিলেন একেবারেই নির্ভার। সব ধরণের চাপ থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিলেন প্রথম বলেই। অসাধারণ এক স্ট্রেইট ড্রাইভ খেলে নিয়ে নিলেন দুই রান।

শচীনকে তখন বল করছিলেন শন পলক। দারুণ এক স্পেল করছিলেন পলক তখন। গুড লেন্থের বল খানিক সামনে এসে ক্ল্যাসিক এক স্ট্রেইট ড্রাইভে পলকের ছন্দের খানিক পতন ঘটান শচীন। প্রথম বলের পরের বলটাও একই লেন্থে করলেন কিন্তু বলের গতিপথ আগের বল থেকে খানিক অফ স্ট্যাম্প থেকে দূরের দিকে। সেই বলেও কপিবুক কভার ড্রাইভ করেন শচীন। আবারো নিয়ে নিলেন দুইটি রান। সেই শুরু।

এরপর শচীন নিজের ব্যাটে সকল চাপের মুক্তি ঘটিয়ে খেলে ফেলেন নিজের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে অসাধারণ দূর্দান্ত এক ইনিংস। দল যখন খাদের কিনারায় তখন শচীন ঠাণ্ডা মাথায় নিজের ব্যাটিং সামর্থ্যের প্রদর্শন করে যাচ্ছিলেন। এরই ফাঁকে সাঁজঘরের পথে চলে গিয়েছিলেন ভিভিএস লক্ষ্মণ তাঁর পরিবর্তে ষষ্ঠ নম্বরে ব্যাট করতে নামেন মোহাম্মদ আজাহারউদ্দীন। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে শচীন চালিয়ে যান তাঁর কর্তব্য। অবশ্য তাঁর সেই ইনিংসের আগে থেকেই ফর্মে ছিলেন শচীন। ইংল্যান্ডে দেখা পেয়েছিলেন দুইটি বিশাল শতকের। একটি ইনিংসে করেছিলেন ১২২ আরেকটিতে ১৭৭।

ঘরের মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকার সিরিজেও মোটামুটি রানেই ছিলেন শচীন। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার কেইপ টাউনের সেই ইনিংসের প্রসংশা না করে উপায় নেই। অ্যালান ডোলান্ড, শন পলক, পল অ্যাডামস, ব্রায়ান ম্যাকমিলানদের মতো বোলারদের বিপক্ষে টিকে থেকে অসাধারণ সব শট খেলেছিলেন সেই ইনিংসে শচীন। ১৬৯টি রান করেছিলেন শচীন। যা তাঁর দলকে ফলো-অন এড়াতেও সাহায্য করেছিল এরই সাথে বাঁচিয়ে ছিলো প্রথম ইনিংসে স্বল্প রানেই অল আউট হয়ে যাওয়ার লজ্জা থেকে।

শচীন তাঁর সেই অনবদ্য ইনিংসে ব্যাট করেছিলেন সর্বমোট ৩২৯ মিনিট। এ সময়কালে তিনি বল খেলেছিলেন ২৫৪টি বল। তাও ওমন বাঘাবাঘা বোলারদের সামনে ঠায় দাঁড়িয়েছিলেন শচীন। আউট হয়েছিলেন দলের শেষ ব্যাটার হিসেবেই। তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্য এতো দীর্ঘ সময় ধরে ব্যাট করার পরও শচীনের ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা ইনিংসে ছিলো না একটিও ছক্কা। তবে ২৬টি চার মেরেছিলেন ‘দ্য লিটল মাস্টার’। এক কথায় কোন ধরণের বাড়তি ঝুঁকি তো দূরে থাক ক্রিকেটীয় পুস্তকে থাকা যতসব অসাধারণ শটের বাইরে একটি শটও সেদিন খেলেননি শচীন।

শচীনের ১৬৯ রানের অনবদ্য ইনিংসটি ছাড়াও সেই ১৯৯৭ সালের দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্টের ভারতের প্রথম ইনিংসটি বেশ আলোচনায় ছিলো ষষ্ঠ জুঁটিতে আজাহারউদ্দীন ও শচীনের বিশাল রানের পার্টনারশীপের জন্যেও। ষষ্ঠ উইকেট জুঁটিতে এই দুই ব্যাটার যোগ করেছিলেন ২২২ রান। শচীন যেমন ধীরস্থির ব্যাটিং করছিলেন ঠিক তাঁর উল্টো পথে হাঁটছিলেন আজহারউদ্দীন। তিনি ১১০ বলে ১১৫ রানের টেস্টে প্রেক্ষিতে ঝোড়ো ইনিংস খেলেন। আজহারউদ্দীন মেরেছিলেন ১৯টি চার ও একটিমাত্র ছক্কা।

এই দুই ব্যাটারের শতকও ভারত সেই ম্যাচ ইতিবাচক কোন ফলাফলের দেখা পায়নি। ৩৫৯ রানেই অল আউট হয়ে যায়। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিং ব্যর্থতায় ২৮২ রানের পরাজয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে। তবে চির অমলিন হয়ে রয়ে যায় শচীন টেন্ডুলকারের সেই ইনিংস। প্রতিকূল সব পরিবেশে নিজের সক্ষমতা, দক্ষতার প্রমাণ রেখেই শচীন টেন্ডুলকার খেতাব পেয়েছেন ‘ক্রিকেটের ঈশ্বর’।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...