এক বিদ্রোহী রবিনহুড

১০ নভেম্বর, ১৯৯১। ইডেন গার্ডেন্সে দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে ওপেন করতে নামছেন জিমি কুক ও অ্যান্ড্রু হাডসন। ঠিক পাশেই তখন দাঁড়িয়ে আছেন ৫০ ছুঁই ছুঁই বছর বয়সের এক স্যুটেড বুডেট ভদ্রলোক। মুখে চিলতে হাসি। যেন আবারও আকাশে উড়তে পারার আনন্দে উদ্বেলিত। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটের গডফাদার। ক্রিকেটে তিনি একই সাথে আলোচিত ও সমালোচিত। তিনি আলী বাখের। একাধারে ডাক্তার, ক্রিকেটার, অধিনায়ক, ক্রিকেট প্রশাসক, বিপ্লবী, জন-দরদী। সর্বোপরি তিনি ক্রিকেটে এক বিদ্রোহী রবিনহুড।

১০ নভেম্বর, ১৯৯১। ইডেন গার্ডেন্সে দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে ওপেন করতে নামছেন জিমি কুক ও অ্যান্ড্রু হাডসন। ঠিক পাশেই তখন দাঁড়িয়ে আছেন ৫০ ছুঁই ছুঁই বছর বয়সের এক স্যুটেড বুডেট ভদ্রলোক। মুখে চিলতে হাসি। যেন আবারও আকাশে উড়তে পারার আনন্দে উদ্বেলিত। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটের গডফাদার। ক্রিকেটে তিনি একই সাথে আলোচিত ও সমালোচিত। তিনি আলী বাখের। একাধারে ডাক্তার, ক্রিকেটার, অধিনায়ক, ক্রিকেট প্রশাসক, বিপ্লবী, জনদরদী। সর্বোপরি তিনি ক্রিকেটে এক বিদ্রোহী রবিনহুড।

ব্যাকফুটে এসে লেগ সাইডে দুর্দান্ত ব্যাট করতেন। ফিল্ডার হিসেবেও ছিলেন তার সময়ের অন্যতম সেরা। ষাটের দশকের শেষ ভাগে দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেটে আশা জাগিয়ে এসেছিলেন। তবে লম্বা ক্যারিয়ার গড়তে পারেননি। সম্ভাবনা থাকলেও সুযোগটা আর হয়ে উঠেনি আলী বাখেরের। সরকারের বর্ণবাদী নীতির কারণে আইসিসির কাছ থেকে নিষেধাজ্ঞা পায় দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট।

ব্যাস, আলী বাখেরের ক্যারিয়ারের সম্ভাবনার আলোটাও নিভে গেল সেখানেই। ২২ বছর নির্বাসন কাটিয়ে ঠিক ফিরেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা, তবে বাখেরের ক্যারিয়ার ততদিনে শেষ। মাঝে আইসিসির নিয়মের বাইরে গিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় নিষেধাজ্ঞার মধ্যে ক্রিকেট ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় ‘ভিলেন’ বনে যান তিনি।

ক্রিকেটের প্রতি ভালবাসা ছিল, প্রেম ছিল। ক্রিকেটকে উপভোগ করতে চেয়েছেন; দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেটের উন্নতিও করতে চেয়েছিলেন। তবে নিয়ম ভঙ্গ করে বহু ক্রিকেটারের ক্যারিয়ার থমকে দিয়েছিলেন সাবেক এই প্রোটিয়া ব্যাটার।

লিথুনিয়া বংশোদ্ভূত পরিবারে জন্ম নেন বাখের। বাখের জন্মের বেশ আগেই লিথুনিয়া থেকে জোহানেসবার্গে পাড়ি জমায় তাঁর পরিবার। জোহানেসবার্গের কিং এডওয়ার্ড স্কুলের হয়ে ক্রিকেট ক্যারিয়ার শুরু। ১৭ বছর বয়সে ট্রান্সভালের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক। ডান হাতি ব্যাটার, পার্ট-টাইম লেগ স্পিনার।

১৯৬৬-৬৭ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম শ্রেণির ম্যাচে ট্রান্সভালের হয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে খেলেছিলেন ২৩৫ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটার হিসেবে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড গড়েছিলেন তিনি। বাখের ব্যাটে সেবার দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে প্রথমবার পরাজিত হয় অজিরা।

১৯৭০ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ২১ বছর ক্রিকেট থেকে নির্বাসনে ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা দল। বোর্ডে দেশটির সরকারের হস্তক্ষেপে আইসিসি থেকে এই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। ২২ বছরে দেশটির অনেক তারকা ক্রিকেটারই নিজেদের প্রমাণের সুযোগ পাননি। মূলত সরকারের বর্ণবাদ নীতির কারণে নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েছিল প্রোটিয়ারা।

দলটি শুধুমাত্র শ্বেতাঙ্গ রাষ্ট্র হিসেবে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধেই খেলবে – দক্ষিণ আফ্রিকান সরকারের এ ঘোষণার বিরুদ্ধে আইসিসি এ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়। কেউ কেউ অন্য দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে সেখানে খেলেছেন। কেউ বা আবার পাড়ি জমিয়েছিলেন ইংল্যান্ডে কাউন্টি ক্রিকেট খেলতে।

তবে, নির্বাসনে থাকায় দক্ষিণ আফ্রিকার অনেক সম্ভাবনাময়ী তারকা ক্রিকেটারই ক্যারিয়ারের সেরা অবস্থানে যেতে পারেনি। এর মাঝে একজন ছিলেন আলী বাখের। ক্যারিয়ারে ডানা মেলে উড়বার আগেই থমকে যায় সব। বাখেরের বয়স তখন ২৮ বছর।

১৯৭২ সালে প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে কুরি কাপে ৫ হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন বাখের। একই বছর দক্ষিণ আফ্রিকার অ্যাথলেটদের সর্বোচ্চ সম্মাননা স্পোর্টস মেরিট অ্যাওয়ার্ড পান এই ক্রিকেটার।

বাখের বিশ্বাস করতেন যে, তার জীবদ্দশায় দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেটের বর্ণবাদের অবসান ঘটবে না। দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেটকে সঠিক পথে রাখার উদ্দেশ্যে আশির দশকের শুরুতে বাখের একটি সিরিজ আয়োজন করে। যেহেতু নিষেধাজ্ঞায় ছিল তাই কোনো দেশেরই দক্ষিণ আফ্রিকায় সিরিজ খেলা নিষেধ ছিল।

অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলঙ্কা, ইংল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে একটি করে দল সেসময় দক্ষিণ আফ্রিকা সফর করে। অবশ্য লঙ্কান ও ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটাররাই সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়ে। শ্রীলঙ্কা থেকে যারা ওই সফরে গিয়েছিল ২৫ বছরের জন্য বোর্ড থেকে নিষেধাজ্ঞা পায়! অপরদিকে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটাররা আজীবন নিষিদ্ধ হন।

আশির দশকে বাখেরে ওই কাণ্ডের জন্য ক্রিকেটের শত্রু বনে যান তিনি। পরবর্তীতে নিজের ভুল বুঝতে পেরে অবশ্য ক্ষমাও চান তিনি। তখন তিনি ব্যাকফুটে। যদিও, দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট ফেরার পর আবারও সুদিন ফিরে পান বাখের। আসলে, বিষয়টা ‍উল্টো – বাখেরের হাত ধরেই ক্রিকেটে আবার ফেরে দক্ষিণ আফ্রিকা।

নব্বই দশকের শুরু থেকেই তিনি দক্ষিণ আফ্রিকাকে ক্রিকেটে ফেরাতে তৎপর ছিলেন। তিনি ইউনাইটেড ক্রিকেট বোর্ড (ইউসিবি) গঠন করেন, যার সুবাদে আইসিসি থেকে ক্রিকেটে ফেরার জন্য ছাড়পত্র পায় দক্ষিণ আফ্রিকা। ১৯৯১ সালে যে দলটা ভারতে সফর করে ২২ বছর পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলে, সেই দলের ম্যানেজারও ছিলেন তিনি।

১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল অবধি তিনি ইউসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। তিনিই ১৯৯২ সালে ক্রিকেটে প্রথম ভিডিও রিভিউ সিস্টেমের প্রচলন করেন। ২০০৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিশ্বকাপ আয়োজনের মূল দেখ ভালটা করেন তিনি। এরপর তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার রাগবি ইউনিয়নেও কাজ করেন।

খেলেছেন মাত্র ১২ টেস্ট। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিন ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে নয় ম্যাচ। ১২ টেস্টে ৬ ফিফটিতে ৩২ গড়ে ৬৭৯ রান করেন তিনি। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তিনি প্রায় ৮ হাজার রানের মালিক; ১৮ সেঞ্চুরি ও ৪৫ ফিফটি করেন। ক্যারিয়ারের শেষ চার ম্যাচে অবশ্য অধিনায়কত্ব করেন তিনি। তাঁর অধীনে চার টেস্টেই জয় পায় প্রোটিয়ারা।

তিনি কিংবদন্তীতুল্য সব ক্রিকেটারদের অধিনায়ক ছিলেন। তিন নম্বর ব্যাটার হিসেবে খেলা আলী বাখেরের দলে গ্রায়েম পোলক, ব্যারি রিচার্ডসরা খেলেছেন। বলা হয়, এটা বিশ্বের সেরা টেস্ট দল হওয়ার সক্ষমতা রাখতো। কিন্তু, নিষেধাজ্ঞার কবলে তাঁদের টেস্টই খেলা হল কেবল হাতে গোনা কয়েকটা। যদিও, খেলোয়াড়ী জীবনের আক্ষেপটা প্রশাসক হিসেবে হয়তো কিছুটা হলেও ভুলতে পেরেছেন বাখের।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...