কী অপার সুন্দর তুমি, টেস্ট ক্রিকেট!

চা বিরতিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সংগ্রহ ছিলো ৭ উইকেটে ১১৪ রান। কিংস্টন টেস্টের চতুর্থ দিনের শেষ সেশনে ক্যারিবিয়ানদের জিততে প্রয়োজন ৫৪ রান! আর পাকিস্তানের প্রয়োজন মাত্র ৩ উইকেট। ক্রিজে জসুয়া ডি সিলভার সাথে নতুন ব্যাটসম্যান হিসেবে নামলেন কেমার রোচ।

ম্যাচের অনেকাংশই তখন পাকিস্তানের আধিপত্যে। সেখান থেকেই জুটি বাঁধেন রোচ-জসুয়া। মোহাম্মদ আব্বাস, হাসান আলি ও শাহিন আফ্রিদিদের তোপের সামনে দাঁড়াতেই হিমসিম খাচ্ছিলেন দু’জনে। তবুও উইকেট মেলেনি পাকিস্তানিদের! ধীরে ধীরে এক পা এক পা করে এগোতে থাকেন রোচ-জসুয়া।

৮ম উইকেটে দু’জনে মিলে জুড়ে দিলেন ২৮ রানের অনবদ্য এক জুটি! দলের প্রয়োজনের অর্ধেক রানই তখন করে ফেলেছেন দু’জনে মিলে। ম্যাচ তখন অনেকটাই ক্যারিবিয়ানদের নিয়ন্ত্রণে। দলের প্রয়োজন আর মাত্র ২৬ রান! সেখানেই বাঁধে বিপত্তি। দলীয় ১৪২ রানে শাহিন শাহ আফ্রিদির বলে উইকেটের পেছনে রিজওয়ানকে ক্যাচ দিয়ে ব্যক্তিগত ১৩ রানে বিদায় নেন জসুয়া। ম্যাচে তখন টান টান উত্তেজনা। পাকিস্তানের দরকার ছিলো মাত্র ২ উইকেট! স্বীকৃত ব্যাটসম্যান বলতে উইকেটে কেউই নেই। তবে তখনো ক্যারিবিয়ানদের শেষ ভরসা কেমার রোচ ছিলেন ১৫ রানে অপরাজিত।

নতুন ব্যাটসম্যান জোমেল ওয়ারিকানকে নিয়ে আবারো ভীত গড়েন রোচ। দলের রান তখন ৮ উইকেটে ১৫১। শাহিন আফ্রিদির প্রথম বলেই স্কোয়ার লেগে কেমার রোচের ক্যাচ ফেলে দেন হাসান আলি! শুধু ক্যাচই না ম্যাচটাই যেনো ফেলে দেন হাসান! অবশ্য সেই শোধ পরের ওভারেই তুলেন হাসান। এরপরের ওভারে বোলিংয়ে এসে ওয়ারিকানকে ফেরান হাসান আলী। ১৫১ রানে ৯ম উইকেটের পতন ঘটে!

শেষ উইকেটে ক্যারিবিয়ানদের প্রয়োজন ১৭ রান, হাতে মাত্র ১ উইকেট! তখনো ক্রিজে ঠায় দাঁড়িয়ে কেমার রোচ। একপ্রান্তে জেডান সিলস ডিফেন্স করছিলেন; আরেক প্রান্তে সিঙ্গেল নিয়ে ধীরে ধীরে লক্ষ্যের কাছে যাচ্ছিলেন রোচ। সিঙ্গেল নিয়েই একসময় দলের রান ৯ উইকেটে ১৬২। আর মাত্র দরকার ৬ রান।

কিন্তু, উইকেটের জন্য দরকার স্রেফ একটি ভালো বল, একটি ম্যাজিকাল বল। ৫৭ তম ওভারে বোলিংয়ে আসলেন হাসান আলি। না তিনি পারলেন না পাকিস্তানি সমর্থকদের প্রত্যাশার সেই ম্যাজিকাল ডেলিভারিটি করতে! তার দ্বিতীয় বলে এজ হয়ে স্লিপ এবং কিপারের মাঝ দিয়ে চার আদায় করে নেন কেমার রোচ! প্রয়োজন মাত্র ২ রান! তীরে এসে ক্যারিবিয়ানদের তরী কি ডুববে? নাকি রোচের দক্ষতায় তরী বন্দরে পৌঁছাবে?

পরের দুই বল ডট। ওভারের পঞ্চম বলে ফুলার লেন্থের ডেলিভারি ড্রাইভ করেই দৌড়ে দুই রান আদায় করে নেন রোচ! কিংস্টনে এক নাটকীয় টেস্টের সমাপ্তি! রোচের অপরাজিত ৩০ রানে ক্যারিবিয়ানরা ১ উইকেটের ঐতিহাসিক জয় তুলে নিলো! টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের দ্বিতীয় আসরের প্রথম জয় তুলে নিলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

এর আগে প্রথম ইনিংসে আগে ব্যাট করে ফাওয়াদ আলমের ফিফটিতে ২১৭ রানে থামে পাকিস্তানের ইনিংস। জবাবে প্রথম ইনিংসে ব্রাথওয়েটের ৯৭ ও হোল্ডারের ফিফটিতে ২৫৩ রানে গুড়িয়ে যায় স্বাগতিক ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ৩৬ রানে পিছিয়ে থেকে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে বাবর আজমের ফিফটির পরেও বাকিদের ব্যাটিং ব্যর্থতায় ২০৩ রানে অলআউট হয় সফরকারীরা।

জায়ডেন সিলস শিকার করেন পাঁচ উইকেট। ১৬৮ রানের লক্ষ্যমাত্রা তাড়া করতে নেমে শাহিন আফ্রিদির তোপে মাত্র ১৬ রানেই ৩ উইকেট হারায় ক্যারিবিয়ানরা। এরপর ৪৮ রানে ৪, ৯২ রানে ৫ থেকে একসময় ক্যারিবিয়ানদের অবস্থা দাঁড়ায় ৭ উইকেটে ১১৪ রান। সেখান থেকে রোচের ব্যাটিং দৈন্যতায় ১ উইকেটের শ্বাসরুদ্ধকর জয় পায় ক্যারিবীয়রা।

টেস্ট ক্রিকেটের অসাধারণ এক সেশন দেখলো ক্রিকেটপ্রেমীরা। থ্রিলারে ভরা শেষ সেশনে আফ্রিদি, হাসান আলীদের ম্যাচ জয়ের আপ্রাণ চেষ্টা, আরেকদিনে রোচের ম্যাচ জয়ী ইনিংস! টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ম্যাচের সাক্ষী হলো ক্রিকেট দুনিয়া।

যারা এই টি-টোয়েন্টির যুগে বলেন – টেস্ট ক্রিকেটের রোমাঞ্চ নেই – তাঁদের জন্য অনন্য এক বিজ্ঞাপন হয়ে রইলো এই টেস্ট। আজো কোনো ক্রিকেট পিপাসু মনের খোড়াক মেটাতে এমন একটা ম্যাচই যথেষ্ট!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link