দ্য ব্লন্ড বম্বশেল

ক্রিকেট ২০০৭ গেমটায় যতবার মাইকেল ক্লার্ককে দিয়ে বাউন্ডারি হিট করাবেন, ততবার মার্ক নিকোলাস তার দারুণ কন্ঠে বলে উঠবেন ওপরের ওই কথাটা।

ক্লার্কের আগে আরেকটা ব্লন্ড বম্বশেল ছিল অস্ট্রেলিয়ার। তাকে চেনে না এমন ক্রিকেটপ্রেমী তো নেই জানাশোনায়। ধুর! শুধু শুধু লেখা লম্বা করছি। শেন ওয়ার্নকে কে না চেনে!?

শতাব্দীসেরা ডেলিভারি, গ্যাটিং বল, রিচি বেনোর গলায় ‘হি হ্যাড ডান হিম বিটউইন দ্য লেগস’। এই কয়টা শব্দই যথেষ্ট মনে হয়। নাহ! গ্রেটদের নিয়ে আমার মতো অধমের লিখতে বসার এই এক যন্ত্রণা; শব্দ-বিশেষণ-উপমা খুঁজে পাওয়া দায়। তাঁদের নামই যে গোটা একটা বিশেষণ কিংবা অনেকগুলো বিশেষণের সমাহার। দিক হারানো চৌরাস্তায় বসে আছি বুঝলেন? কোন পথে যাব তাঁদের নিয়ে দু’কথা লিখতে।

অবশ্য দায় সারা যায় কেবল নামটা বিশেষণ হিসেবে ব্যবহার করে। তাতেও অবশ্য মন সায় দেয় না ‘ব্যাটা হাদারাম! কী লিখিস এতদিন ধরে? তাঁদের নিয়েই যদি দু’কলম না লিখবি, কিসের এত হম্বিতম্বি’ ব্যস! পড়লাম তো আচ্ছা ঝামেলায়। এই যে! ফাউ ফাউ খেজুরে আলাপ জুড়ে দিলাম।

তার প্রয়াণের খবরটা পেয়েছিলাম মধ্য বাড্ডার জ্যামে বসে। টুইটারে স্ক্রল করতে করতে ফক্স স্পোর্টসে চোখ আটকে গেল! অবিশ্বাস্য! কালজয়ী এক মহানায়কের বিদায়। এক সহকর্মী কল দিল সাথেসাথে আমার কাছে সিউর হওয়ার জন্য। আমি নিজেই যেখানে সেই খবরটা অবিশ্বাস করার মতো বিশ্বাসী একটা সোর্স খুঁজছিলাম।

আসলেই এখন কিছু লেখার মতো পাচ্ছি না। তাই গোটা লেখাটা এলোমেলো লাগতে পারে পড়তে আপনার কাছে। ভেবে রেখেছিলাম অনেক কিছুই লিখব। এত বড় ক্যারিয়ার, এত এত অর্জন, কীর্তি, আলোচনা-সমালোচনা। মাঠ কিংবা মাঠের বাইরে। সংখ্যার আলোড়ন। হিসেবের ঝড়।

যার নেয়া প্রতিটা উইকেটে লেপ্টে আছে একেকটা গল্প, নেপথ্যের গল্প, গল্পের পরবর্তী গল্প। শেষ নেই। মানুষটার গোটা জীবনটাই ছিল গোটা শুভ্র-সফেদ ক্যানভাস। তার ভেতরটার মতো। নানান রঙের আঁকিবুঁকি ছিল নিজের হাতেই দেয়া। কখনো আনাড়ি হাতে, কখনো খেয়ালী-হেয়ালি ঢংয়ে, কখনো সুনিপুণ দক্ষ হাতে।

সাদা হ্যাট, জিংক ক্রিম, সানগ্লাস, রিস্ট ব্যান্ড, জিহবা দিয়ে ঠোঁটটা ভিজিয়ে নেয়া। দুলকি চালের রান-আপ, নাকি হাঁটা বলব। বোলিং মার্ক থেকে পপিং ক্রিজ পর্যন্ত তো হেঁটেই যেতেন। পোয়েট্রি ইন মোশন।

ওই ছোট্ট সময়টায় চিন্তা চলতো নিউরনে। কীভাবে খেলাবেন ব্যাটারকে, আর কীভাবে আউট করবেন। ব্যাটার ভাবতো ওয়ার্নকে তিনি খেলতে পারছেন আরামে, বোকা ব্যাটার বুঝতোই না, ওয়ার্ন আউট করার জন্যই ওভাবে তাকে খেলতে দিচ্ছেন বলেই মিডল হচ্ছে।

কোনটা ফেলে কোনটা বলি। বড্ড ঝামেলা। ওয়ার্নের ৭০০ নম্বর টেস্ট উইকেট, সিডনিতে হ্যাট খুলে দর্শকদের কুর্নিশ। মাথায়ও আসছে না এখন সব। একটু সময় নিয়ে ঘেটেঘুটে লিখব, সেটাও হতে দিচ্ছে না আলসে বাঙালির মন।

আচ্ছা, মাঠের বাইরের জীবন তো উত্তাল ছিল তাঁর। সাদা ক্যানভাসে হরেক রকম চিত্র। কত নারী এসেছে জীবনে, কত স্ক্যান্ডাল তার বর্ণময় জীবনে। টিন্ডার, বিয়ার, জুয়ায় আবদ্ধ ছিল জীবন। আর ছিল ক্রিকেট। ওসবের প্রভাব কি মাঠের খেলায় পড়তে দিয়েছেন? দেননি।

একেকটা স্ক্যান্ডালের পর জরিমানা, কতশত নিউজ, পরকীয়ায় জড়িয়ে বিবাহবিচ্ছেদ; তবুও সন্তানদের আগলে রেখেছেন। মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন, সেসব দিয়ে চাইলে জাজ করতে পারেন, আবার নাও পারেন। সিদ্ধান্ত আপনার।কিন্তু সেসব ঝড় তো উড়িয়ে দিয়েছেন কব্জির মোচড়ে, মস্তিষ্কের ধারে, একেকটা গুগলি-ফ্লিপার-ড্রিফটারে।

সোনালী চুলো লোকটা নিজেও স্বীকার করেছেন অনিয়মের জীবনটাই ছিল তার জীবন। এক আয়ুষ্কালের জীবনটা জীবনের মতো করে উড়িয়ে দিতে আর ক’জন পারে? উত্তাল জীবনে বিশ্বাসী, বিয়ার-মাংসপ্রেমী মানুষটা পেরেছেন।

তাই এখনো লেগস্পিন শব্দটা নিয়ে আড্ডা জমলে টেবিল চাপড়ে সবাই তাঁর নামটাই বলে। কদিন আগেও দ্য হান্ড্রেডে নীরবতা নেমেছিল তার স্মরণে। বারবার প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবেন বলেই ওয়ার্নের আবির্ভাব হয়েছিল ধরাধামে। কোনো এক ১৩ সেপ্টেম্বরে।

রেকর্ড-সংখ্যার কচকচানি আমার লেখায় আসলে পাবেন না। কেবল মুগ্ধতাটুকু তুলে ধরার চেষ্টা করি। ওয়ার্ন ছিলেন মাঠের গুন্ডা। ছিলেন এক মোহময় চরিত্র। যার ডানহাতে জাদু খেলা করতো। ম্যাজিশিয়ান বলতে যা বুঝি আমরা। মাথায় ওই কালো হ্যাটের জায়গায় ছিল সাদা ফ্লপি, হাত ওই ম্যাজিক স্টিকের জায়গায় ক্রিকেট বল। ভেতরটা ছিল সাদা।

দ্য গ্রেটেস্ট শো ম্যান। চলে গেছেন শো গুটিয়ে। ব্যাকড্রপে হাজারটা জাদুর নজির রেখে। ওই যে পর্দাটাও নেমে আসছে, ড্রামরোলসের সাথে। এরপরেও দ্য শো মাস্ট গো অন। কেউ না কেউ শো এগিয়ে নিয়ে যাবে লিগ্যাসির ব্যাটনটা হাতে ধরে। যতদিন ক্রিকেট থাকবে, লেগিরা থাকবে ততদিন বারবার প্রকটভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবেন – ‘ওয়ার্নি: দ্য ব্লন্ড বম্বশেল ফ্রম ভিক্টোরিয়া!’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link