ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগে অপরাজিত, আন্তর্জাতিক বিরতিতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত ১৩ ম্যাচে মাত্র ১ টি হার। গত দশকজুড়ে একের পর এক হতাশা তৈরি করা এসি মিলানের হঠাৎ এই উত্থান যেন সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীরা স্বপ্নের ভাবতে পারেনি। কিন্তু সেটাই করে যাচ্ছেন তোনালি-ইব্রাহিমোভিচরা। দৃশ্যপটের বাইরে থাকা এসি মিলানের উত্থান কি ফ্লুক নাকি পর্দার আড়ালে থাকার সুযোগটা কাজে লাগিয়ে কামব্যাকের গল্প?
পুরো ফুটবল বিশ্ব একটা বিশাল বন হলে, এসি মিলান সেই বনের নখদন্তহীন ঘুমন্ত সিংহ। আগের মতো তোড়জোড় হয়তো নেই, শিকারে বের হলেও ক্লান্ত হয়ে পরে। লুকিয়ে লুকিয়ে লোকে হাসে বটে, কিন্তু সামনে এলে, আহারে রাজা মশাইয়ের কী হাল বলে টিটকিরি মারতেও ছাড়ে না। সিংহের রাজত্ব্য কী আর জেব্রার হাতে মানায়? সিংহহীন রাজ্যে যতই তোড়জোড় চালাক না কেন, অপর রাজ্যে গেলেই তো দেখা মিলে আসলরূপ। যতই তোড়জোড় করুক না কেন, রাজা যে শেষমেশ সিংহই। তবু কেউ কেউ রাজার আগমনের অপেক্ষায় থাকে, সমর্থকদের ছোট মনে ছোট আশা; সে মিলান বনে তাণ্ডব চালিয়েছে একদিন পুরো বনে তোড়জোড় করেছে, সেই রাজা ফিরবে।
শৈশব রঙিন করা এসি মিলানের এই অবস্থা যেকোনো ফুটবল সমর্থক এক বাক্যে স্বীকার করবেন। গত দশকের শুরুতেও যেখানে মিলানের জয়জয়কার, সেখানে পুরো দশকটা ছিল তাদের জন্য হতাশার। একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত, প্রেসিডেন্সির পরিবর্তন আর বাজে সিদ্ধান্তের দরুন চোখের সামনে তারকাজ্জ্বল এসি মিলান পরিণত হয় ধ্বংসযজ্ঞে। কিন্তু এই মৌসুমে যেন দেখা মিলছে এক নতুন মিলানের।
খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসা এই মিলানের সামনে যেন কেঁউই বাধা নয়। বরং ইতালিয়ান লিগ শাসন করা ইউভে-ইন্টারকে এক ধাক্কা ছুড়ে ফেলে দেওয়া এই মিলানকে কেউ যেন চিনতেই পারছে না। কী এমন হলো এসি মিলানের, দুই বছর আগেও যাদের নিয়ে আশা করতে না পেরে কোচিং ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন কিংবদন্তি জেনেরো গাত্তুসো, তারা কীভাবে আর শীর্ষে? আজকের গল্পটা অবশ্য এই ধ্বংসযজ্ঞ কিংবা তার পরিণতি নিয়ে নয়, বরং মিলানের ফিনিক্স পাখি হয়ে উঠার গল্প। কোভিড পরবর্তী এসি মিলান কি শুধুই ফ্লুক? নাকি এতো বছরের সাধনার ফলাফল?
- সিল্ভিও বার্লুসকোনি: একাধারে মিলানের নায়ক ও ভিলেন
মিলানের আজকের উত্থানটা বেশ কয়েকভাগে ভাগ করা যায়। এলিয়ট কোম্পানির আগমণের পূর্বে আর পরে। ইতালিয়ান বড় তিন ক্লাব মূলত চালায় মূল হেভিওয়েট তিন ইতালিয়ান পরিবার। ইউভেন্তাসের অ্যাগনেল্লি ফ্যামিলি, ইন্টারের মোরাত্তি ফ্যামিলি আর মিলানের বার্লুসকোনি। কিন্তু গত দশকের শুরুতে ইউরোপের ব্যবসায়িক মন্দা বড়সর ধাক্কা দেয় ইতালিয়ানদের ব্যবসায়। যে কারণে ধাক্কা লাগে দুই মিলান পরিবারের গায়ে। অর্থনোইতিক মন্দায় না চলছিল বার্লুসকোনির কন্সট্রাকশন আর স্টক মার্কেট, না চলছিল মোরাত্তি ফ্যামিলির পেট্রোলিয়াম ব্যবসা। অন্যদিকে ফিয়াট গাড়ির নির্মাতা আগনেল্লি পরিবার এগিয়ে যাচ্ছিল নিজেদের গতিতেই।
তৎকালীন ইতালির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কারণে বেশ বড়সরই ধাক্কা লাগে তার গায়ে। ব্যাক্তি মালিকানাধীন ক্লাব হওয়ায় মিলান সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ছিল তার উপর। কিন্তু বার্লুসকোনি যখনুই নিজের ব্যবসা ও রাজনীতি বাঁচাতে হাতটান করলেন, বিপদে পরলো এসি মিলান। বয়স্ক খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া দল, ফিউচার প্ল্যানে গড়িমসি করার ফল বেশ ভালোভাবেই পরে মিলানের উপর। তাই ব্যর্থতার দায় মাথায় নিয়ে ২০১৭ সালে এসি মিলানের একাংশ মালিকানা বিক্রি করে দেন প্রেসিডেন্ট সিলভিও বার্লুসকোনি। তার কাছ থেকে একাংশের মালিকানা কিনে নেয় চায়নিক ব্যবসায়ী লি ইয়ংহং।
চায়নিজ মালিক লি ইয়ংহং এসি মিলানকে যতটা না ক্লাব হিসেবে দেখেছিলেন, তার থেকে নিজের আরেকটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখেছিলেন। ইউরোপিয়ান ক্লাবের টাকার খেলায় কিছুটা ইনভেস্ট করে শতগূনে লাভ কামিয়ে নিতে চেয়েছিলেন তিনি। সে সুযোগে বেশ কিছু খেলোয়াড়ও কিনেছিলেন বটে, কিন্তু এসি মিলানের মতো ভঙ্গুর ক্লাবের কাছ থেকে আর যাই হোক, এত দ্রুত লাভের আশা করা যায় না। মিলানকে কেনার টাকাও একবারে না দিয়ে ভাগ ভাগ করে দিচ্ছিলেন লি। যে কারণে বেশ কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ ট্রান্সফার কিছু টাকার জন্য হাতছাড়া হয় মিলানের। শেষ পর্যন্ত ভাগে ভাগে টাকা না দিতে পেরে এক বছরের মাথায় ফেরত যান ইয়ংহং। মিলান সমর্থকদের চোখের মনি থেকে চোখের বালি হয়ে যান লি। তখনই মিলানের ত্রাতা হয়ে আসে এলিয়ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি। লি ইয়ংহংয়ের কাছে থাকা পুরো অংশের মালিকানা কিনে নেয় অ্যামেরিকান এই কোম্পানি। মিলানের উত্থানের দ্বিতীত ভাগ শুরু এখান থেকে।
এলিয়ট কোম্পানির মাধ্যমে ব্যক্তি থেকে কোম্পানির হাতে মালিকানা চলে যায় মিলানের। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হলেও খেলার মূল্য এরা বুঝেছে। যতই ব্যবুসায়ী মনোভাব থাকুক না কেন, এসি মিলানের বিশাল প্রতিপত্তির গল্প এদের জানা। তাই তড়িৎ সিদ্ধান্তের ফল পেতে শুরু করে মিলান। এলিয়ট কোম্পানি আসতে না আসতেই দলে ভিড়তে থাকে তারকারা। একসময় যারা এসি মিলানের মাঠে রাজত্ব্য করেছেন তাদের দেখা মিলতে শুরু করে বোর্ডে। লিওনার্দো ফেরত আসেন স্পোর্টিং ডিরেক্টর হিসেবে, মালদিনি আসেন ডেভোলাপমেন্ট ডিরেক্টর হিসেবে। কোচ হিসেবে তো জেনেরো গাত্তুসো আছেনই। মিলানের আজকের উত্থানের গল্পের ভিত তৈরি করা হয়েছিল সেদিনই।
- গাত্তুসোর হাত ধরেই দিনবদলের শুরু
যদিও বলার মতো কোনো মৌসুম ছিল না সেটা কিন্তু জেনেরো গাত্তুসোর হাত ধরে মিলান যেন নতুন করে পথের দিশা খুঁজে পেয়েছিল। এতোদিন ধরে হারের বৃত্তে ঘুরে বেরানো মিলান অবশেষে ক্লাব লিজেন্ডের হাত ধরে ঘরে ফেরবার তোড়জোড় চালাচ্ছিল। মৌসুম শেষে নিজের ক্লাবকে বিদায় বলেন গাত্তুসো আর লিওনার্দো। প্রত্যেকেই নিজেদের ক্যারিয়ারের অন্য দিশা খুঁজতে ছেড়ে দেন মিলানের হাত। লিওনার্দোর জায়গায় প্রমোশন পান মালদিনি আর মালদিনির জায়গায় আসেন জবেনোমির বোবান।
১০ বছর একসাথে খেলা মালদিনি-বোবান ড্যুয়োর প্রধান কাজ ছিল দলকে উইনিং ট্র্যাকে ফেরত আসা দল যাতে ছুটে না যায়। ঘোড়া হঠাৎ টগবগিয়ে উঠলে তা লাগামছাড়া হতে বেশিক্ষণ লাগে না। নতুন কোচের আগমণে যেকোনো সময় ভেঙ্গে পর্যে পারে গাত্তুসোর হাতে গড়ে উঠা ভিত। তাই ইতালিয়ান লিগের ঝানু কোচ মারকো জিয়াম্পাওলোর হাতে দায়িত্ব সঁপে দেওয়া হলো মিলানের। কোচ তো হলো, এবার দরকার কোচের রেইনফোর্সমেন্ট। দাহ্রে খেলতে আসা ফ্র্যাঙ্ক কেসি আর থিও হার্নান্দেসকে পাকাপাকিভাবে কিনে মৌসুম শুরু করেছিল মিলান।
আর তার সাথে যুক্ত হয়েছিল পর্তুহিজ ফরোয়ার্ড রাফায়েল লিয়াও আর আলজেরিয়ান মিড ইসমাইল বেননাসের। দলে যতজন না যোগ দিয়েছিল তার থেকে বেশি মানুষকে পত্রপাঠে বিদায় জানিয়েছিল মিলান। ৮ জন দল ছেড়েছেন ফ্রিতে, দুই তরুণ তুর্কি প্যাট্রিক কুত্রনে আর লোকালেত্তি ছাড়া কারো কাছ থেকেই তেমন একটা কিছু আদায় করতে পারেনি মালদিনি-বোবান ড্যুয়ো। মনে আশা গতবারের রেখে যাওয়া গাত্তুসোর ভিতের উপর পিলার বসানো শুরু করবেন জিয়াম্পাওলো।
- মালদিনি-বোবান: মিলানের নতুন কাণ্ডারি
কিন্তু সে আশায় গুঁড়েবালি। মালদিনি-বোবান ড্যুয়োর পয়সা যেন সব জলে গেল। যে লিয়াও-বেননাসেরকে কিনতে এতো খাটাখাটনি করলেন তাদের দেখাও মিলছিল না মাঠে। মাঠে দেখা না গেলেও ফল আসলে ক্ষতি কী? কিন্তু তাতেও শূণ্য। মিলানের মাঠে কিংবা মাঠের বাইরে কোনো অবস্থাই যেন ভালো যাচ্ছিল না। বোর্ডের আস্থা শুধু কোচ নয় উঠে গিয়েছিল মালদিনি-বোবান জুটির উপরেও।
মৌসুমের ৩ মাস গড়াতে না গড়াতেই টানাটানি শুরু হয় চাকরি নিয়ে। স্পোর্টিং ডিরেক্টর হিসেবে আরবি লাইপজিগের কোচ রালফ রাগনারিকের আসা যেন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এমতাবস্থায় ছাটাই করা হয় জিয়াম্পাওলোকে, বোর্ডের স্বাধীনতা পাচ্ছেন না বলে চাকরি ছাড়েন স্বাধীনচেতা জবেনোমির বোবান। হাতি-ঘোড়া-মন্ত্রী সব হারিয়ে মালদিনি নিজের সৈন্য নিয়েই চলা শুরু করলেন দাবার বোর্ডে।
কোচ হিসেবে আনলেন ইতালিয়ান লিগের আরেক পোড় খাওয়া কোচ স্তেফানো পিওলিকে। মৌসুমের ৪ মাস গড়াতে না গড়াতেই সবাই নিশ্চিত, মৌসুম শেষ্রে তল্পিতল্পা গুটাচ্ছে মালদিনি-পিওলি জুটি। রাফল রাগনারিকই রোজানারিদের ভবিষ্যৎ। তা আরো নিশ্চিত করলেন পিওলি, ১১ ম্যাচে মাত্র ৩ জয় নিয়ে। মালদিনির হাতে যখন সব আশা শেষ তখনই ত্রাতা হয়ে এলো উইন্টার ট্রান্সফার উইন্ডো।
- বদলে যাওয়া মিলানের দুই কাণ্ডারি
কথায় আছে ‘এক মাঘে শীত যায় না’। কথায় আরো আছে ‘মরা হাতির দাম লাখ টাকা।’ এসব প্রবাদ বাক্য মালদিনি শুনেছেন কিনা জানা নেই, তবে মালদিনির লক্ষ্য ছিল একটাই। কোনমতে একটা সৈন্য নিয়ে দাবার বোর্ডের অন্যপাশে পৌঁছুতে পারলেই কেল্লা ফতে; সেই সৈন্য মন্ত্রী হয়ে ম্যাচ ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম। সে লক্ষ্যে যেন “ফোর ডি চেস” খেলা শুরু করলেন মালদিনি। চাকরি যে তার সুতোয় ঝুলছে।
এলএ গ্যালাক্সির সাথে চুক্তির আকি আর ৬ মাস। মৌসুম শেষে জ্লাতান যে আমেরিকা ছাড়ছেন তা আর বলতে। আজীবন ইউরোপে খেলা জ্লাতান তখন ইউরোপে আসতে এক পায়ে খাড়া। দুই পা ভাবলেন না মালদিনি। একসময়ের শত্রু ইব্রার কাছে নিয়ে গেলেন কন্ট্রাক্ট, বেতন যা চাইলেন তাতেই রাজি; মনে মনে যেন বললেন, শুধু রোজানারি জার্সিটা একবার গায়ে তোল বাপ। বাকিটুকু ‘ভিনি ভিসি ভিডি’। এলেন, দেখলেন, জয় করলেন।
ক্রিসমাস পার করে পা রাখলেন মিলানে। মিলান তখন আতালান্তার কাছে পাঁচ গোল হজম করে বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত। এক ম্যাচ সময় নিলেন, এরপরের ম্যাচেই ক্যালিয়ারিকে দিয়ে শুরু। হারের বৃত্তে ঘুরতে থাকা মিলান যেন প্রাণ পেল জ্লাতানে। গোল-এসিস্ট বাদ দিলেও রাতারাতি যেন দলের চেহারাই পালটে দিয়েছিলেন জ্লাতান। মিলান ছেড়ে প্যারিস যাত্রার ঠিক আগে যেমনটা রেখে গিয়েছিলেন, সেখান থেকেই যেন শুরু করলেন ইব্রা।
এতোদিন আগে রেখে যাওয়া তলোয়াড়ের যেন আগের মতোই কার্যকর, বোঝা গেল এ দোষ তলোয়াড়ের নয় বরং চালকের। কোভিড আক্রমণের আগে মাত্র ২ ম্যাচে হারের দেখা পেয়েছিল জ্লাতানবাহিনী। কোভিড পরবর্তী মিলান যে ন আরো শাণিত, আরো ভয়াবহ, আরো ভয়ানক। লিগের শেষ চার ম্যাচে প্রতিপক্ষক এ ছিড়েফুড়ে খেয় জায়গা নিশ্চিত করলো ইউরোপে। সাথে সাথে চাকরি বাঁচালেন মালদিনি-পিওলি। আর ওদিকে কপাল পুড়লো রালফ রাগনারিকের। বেচারা মিলানের চাকরি পাওয়ার আশায় আগে ভাগেই বেকার হয়ে বসে ছিলেন।
- এ মিলান অন্য মিলান
নতুন মৌসুমে মিলান নিজেদের পুরোনো দলে যেন হালকা প্রলেপ দিয়েছে। আগের মৌসুমেই ধরে বেঁধে ডেডওড সরানো শুরু হয়েছিল, এবার শুধু লোনে থাকা খেলোয়াড়দের বিদায় দেওয়ার পালা। ইয়ংহং এরায় দলে ভেরা আন্দ্রে সিলভা, রিকার্ডো রদ্রিগেজ আর লুকাস পাকেতা, কেউই নিজেদের সেরাটা দিয়ে পারেনি রোজানারি জার্সিতে, তাই বলতে হয়েছে বিদায়। তার বদলে এনেছে আনতে রেবিচ, ডিয়েগো লাক্সাল্ট আর সান্দ্রো তোনালিকে।
প্রথম দুজন আগের মৌসুম লোনে থেকেই নিজেদের প্রমাণ করেছেন, আর তোনালি? ১৮ বিশ্বকাপ মিস করার পর ঢেলে সাজানো ইতালি দলের ইঞ্জিন ভাবা হচ্ছে তাকে। দলে আরো ভিড়েছেন ইয়াংস্টার পিটার হগ, আর অ্যালেক্সিস সালেমেকার্স। দুই উইঙ্গে যাদের কাজ শুধু বল সাপ্লাই দেওয়া। আর সবচেয়ে বড় দান চেলেছে অভিজ্ঞ ড্যানিশ সাইমন কায়েরকে দলে ভিড়িয়ে। সুসোকে সেভিয়ার কাছে বিক্রি করে নামেমাত্র মূল্যে কায়েরকে ভিড়িয়েছে মিলান। আর তার প্রতিদান তিনি দিচ্ছেন সমানভাবে।
প্রতি ম্যাচে তার ডিফেন্ডিং চোখে লেগে থাকার মতন। মাত্র কয়েকমাসেই হয়ে গিয়েছেন ডিফেন্সের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ মৌসুমের মিলানকে এক লাইনে বুঝিয়ে দেওয়া সম্ভব, ১৩ ম্যাচে ১০ জয়, ২ ড্র আর ১ হার। সিরি-আর শীর্ষস্থান আর টপ গোলস্কোরার দুটোই এসি মিলানের। ইন্টারন্যাশনাল ব্রেকে যাওয়ার আগে একমাত্র হার শুধু লায়নের বিপক্ষে ইউরোপা লিগে।
যদিও এখনই ইউরোপে টার্গেট নেই মিলানের, তাই হারটাও চোখে পরার মতন তেমন বড় কিছু নয়। ইতালিয়ান লিগের সুপারস্টারে ভরপুর ইউভেন্তুস কিংবা রাইভাল ইন্টারকে টেক্কা দিয়ে লিগ লিডার এসি মিলান যেন সেই পুরোনো রূপে গর্জে উঠছে। বিশ্ব যেন প্রস্তুত আরেকবার মিলানের হুঙ্কার শোনার জন্য। কিন্তু মিলান প্রস্তুত তো হুঙ্কার দেওয়ার জন্য?
আপাত দৃষ্টিতে রোজানারিদের উত্থানের সব ক্রেডিট সুইডিশ তারকা জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচের মনে হতে পারে। হারের বৃত্তে ঘুরতে থাকা মিলানের পরশ পাথর ছিলেন জ্লাতান। আসলে কী তাই? শুধুমাত্র ইন্সপিরেশন আর লিডারশিপের জোরেই কী এতোটা পথ পাড়ি দিয়ে শীর্ষ এসি মিলান? এই পরশ পাথর যেদিন বিদায় বলবে সেদিন কী সেই আগের জায়গাতেই ফেরত যাবে মিলান? নাকি কোচ পিওলির হাত ধরে সঠিক পথেই এগুচ্ছে তারা?
ট্যাক্টিক্যালি পিওলির মিলানকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছে তার খেলোয়াড়েরা। পিওলির খেলার মূল প্রিন্সিপাল তিনটি; ওয়াইডথ, কুইক পাসিং আর প্রেসিং। ইউরোপিয়ান টপ ফাইভ লিগে এমন ট্যাক্টিস নিয়ে খেলা খুবই কষ্টসাধ্য। বিশেষ করে কোভিড প্যান্ডেমিকের পরে যেখানে প্রতিটি দলের প্রতিটি খেলোয়াড়কেই খুবই অল্প সময়ে অনেক বেশি ম্যাচ প্রেশার নিতে হচ্ছে সেখানে ডে বাই ডে প্রেসিং ফুটবল যেকোনো সময় ব্যাকফায়ার করতে পারে। সেখানেই পিওলির দল তাকে দিয়ে যাচ্ছে সার্ভিস। ইউরোপের টপ ফাইভ লিগে মিলানের চাইতে কম বয়সী দল আর নেই। এমনকি স্টার্টিং এলিভেনেও তাদের সাথে টেক্কা দেওয়ার মতো কেউ নেই। মিলানের এই দলের গড় বয়স মাত্র ২৩। অথচ প্রতি ম্যাচেই মাঠে নামছেন ৩১ বছর বয়সী সাইমন কায়ের ও ৩৯ বছর বয়স্ক জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ। এই ইয়াং দলই পিওলিকে সাহস জোগাচ্ছে নিত্যনতুন এক্সপেরিমেন্ট করতে।
পিওলি এসি মিলানে এসেছিলেন ৯ অক্টোবর ২০১৯। আগের কোচ মার্কো জিয়াপাওলোর বহিষ্কারের পরদিনই তাকে কোচ হিসেবে নিয়ে আসে মিলান। প্রথম থেকেই মিলানকে একটা নির্দিষ্ট ছকে খেলানোর চেষ্টা করছিলেন পিওলি। কিন্তু দলের আগাগোড়াই ছিল সমস্যার পরিপূর্ণ। ডিফেন্সে অধিনায়ক রোমানলির সাথে একটা জুটি হয়ে উঠতে পারছিলেন না কেউ। যে কারণে বারবারই ডিফেন্সের ভুলের খেসারত দিতে হচ্ছিল তাকে। মাঝমাঠে কেসি-চানহানগ্লুর সাথে অদল বদল করিয়ে পাকেতা-বিগলিয়া-বেননাসেরকে দিয়ে কোনোমতে সামাল দিয়ে চললেও গোলরক্ষকের সামনে ছিল তথৈবচ অবস্থা। আনতে রেবিচ আর রাফায়েল লিয়াও, দুই ইয়াংস্টার যেন লিডারশিপের অভাবেই খাবি খাচ্ছিল। প্রথম তিন মাস পিওলি তার দলের দূর্বলতা দেখলেন, এরপর আঁটঘাট বেঁধে নামলেন দল সামাল দিতে। জানুয়ারিতে মিলানে যোগ দিলেন মোট চারজন খেলোয়াড়। জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ, সাইমন কায়ের, এলেক্সিস সালেম্যাকার্স আর গোলরক্ষক আসমির বেগোভিচ। চারজনকে নিয়ে বাকি মৌসুমের চিত্রটাই পালটে দিয়েছেন পিওলি। সাথে বাঁচিয়েছেন নিজের চাকরিটাও।
- তারুণ্যের সাথে অভিজ্ঞতার মিশেল
মিলানের এই মৌসুমের ট্যাক্টিস নিয়ে বলতে গেলে প্রথমেই তাদের ফর্মেশন দিয়ে শুরু করা যায়। পিওলি তার অতি পছন্দের ৪-২-৩-১ ফরমেশনেই সাজিয়েছেন রোজানারিদের। তিন কাঠির নিচে গোলরক্ষক জিয়ানলুইজি দোনারোমা তো অতন্ত্র প্রহরী। রক্ষণের চারজনের তিনজন তো প্রায় নিয়মিত। ডানে-বায়ে যথাক্রমে ডেভিড কালাব্রিয়া আর থিও হার্নান্দেস। মাঝে সাইমন কায়েরের সঙ্গীর পরিবর্তন হচ্ছে প্রতি ম্যাচেই। চোট-কোভিড পজিটিভের কারণে না অধিনায়ক এসিলিও রোমানলি হতে পারছেন নিয়মিত, না হতে পারছেন ম্যাথিউ গাব্বিয়া অথবা পিয়েরে কালুলু। তাই অদল-বদল করেই চলছে মিলানের সেন্টার ব্যাক।
মাঝমাঠ নিয়ে বেশ বড়সর এক্সপেরিমেন্ট চালিয়েছেন পিওলি। গত মৌসুমের ডাবল পিভোট রোলে থাকা মোট পাঁচজনের তিনজনকেই পত্রপাঠে বিদায় বলেছে বোর্ড। সেখানে শুধু যুক্ত হয়েছেন ইতালিয়ান সান্দ্রো তোনালি। তাতে বিশেষ কোনো সমস্যা হচ্ছে না বৈকি। দুই আফ্রিকান ইসমাইল বেননাসের আর ফ্র্যাংক কেসি যেন মাঝমাঠের দুই ট্যাংক। ক্রিয়েটিভিটি হয়তো অতটা নেই, কিন্তু দলের প্রয়োজনে ট্র্যাক ব্যাক করা কিংবা মাঝমাঠ ধরে রেখে পুরো খেলা চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তাদের বিকল্প পাওয়া মুশকিল।
ক্রিয়েটিভ অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে মিলানের মাঝমাঠ আর অ্যাটাকের সুতিকাগার হলেন তার্কিশ হাকান চালহানগ্লু। আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খেলছেন স্প্যানিশ ইয়াংস্টার ব্রাহিম ডিয়াজ। রিয়াল থেকে লোনে এসেও নিজের সেরাটা দেখাচ্ছেন তিনি। আর ডানে-বামে দুই উইংয়ে ভরসার পাত্র অ্যালেক্সিস সালেম্যাকার্স আর রাফায়েল লিয়াও। বয়স কম হলে কী হবে, খেলাতে তার বিন্দুমাত্র ছাপ নেই।
আর সবার সামনে তো আছেনই জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ। এতোগুলো তরুণ তুর্কিকে গাইড করার দায়িত্ব যেন একা হাতে নিয়ে নিয়েছেন। নইলে কী আর প্রেস কনফারেন্সে এসে সরাসরি বলেন, ‘ওদের কোনো প্রেশার নেই। প্রেশার শুধু আমার জন্য। ওরা খেলাটা এনজয় করে, সেটাই করতে দিন। দলকে টেনে নিয়ে যাওয়ার প্রেশার আমি খুব ভালোমতোই সামাল দিতে জানি।’ সবমিলিয়ে মিলানের স্টার্টিং লাইন-আপ আর সাব মিলিয়ে দলটা হয় অনেকটা এরকম।
এবার আসা যাক পিওলির ট্যাক্টিসে। মিলানের ডিফেন্স মূলত নির্ভর করে ম্যান মার্কিঙ্গয়ের উপর। আর স্টার্টিং ফরমেশনে ডিফেন্সে সাপোর্ট দেওয়ার মতন মোট ৬ জন থাকার কারণে একজন বল লুজ করলে খুব সহজেই আরেকজনকে পাওয়া যায়। ডাবল পিভট হিসেবে খেলা বেননাসের আর ফ্র্যাংক কেসি প্রয়োজনমতো ডিফেন্সে নেমে এসে সুযোগ করে দেন দুই উইং ব্যাককে সামনে এগুনোর।
ফলে তিনজন সেন্টার ব্যাকের সাথে দুই উইংয়ে সাপোর্টও পায় মিলানের অ্যাটাক। মাঝেমধ্যে হাকান চালহানগ্লুও নিচে নেমে এসে সাহায্য করেন দলের বিল্ড-আপে। আর তখন দলের টার্গেট ম্যান ৬ ফুট ৫ ইঞ্চি জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ। তার হেডিং দক্ষতা আরো সুবিধা করে দিয়েছে মিলানের উইঙ্গারদের। উইং দিয়ে কোনোমতে কাট-অন করে ক্রস করলেই কোনো না কোনোভাবে খুঁজে পাবে জ্লাতানের মাথা।
এসি মিলানের অসাধারণ উইংপ্লে তাদের সুযোগ করে দিয়েছে ওয়াইড এরিয়াতে ইন-আউট সুইচ পজিশন প্লেয়িঙ্গয়ে। যেখানে উইং ব্যাক আর উইঙ্গার ওয়ান-টু-ওয়ান কিংবা সেন্টার ব্যাকের কাছ থেকে লং বল নিয়ে খুব সহজেই ডি-বক্সে ঢুকে পরতে পারে। দুই পাশেই দ্রুতগতির ও কার্যকরী উইংগার থাকায় অন্য সব দলই মিলানকে ঘিরে পরিকল্পনা সাজানোর সময় উইঙ্গারদের কাজ হয় নিচে নেমে উইং ব্যাককে সাহায্য করে। আর সেটিকেই সুযোগ হিসেবে নেন পিওলি। স্যালেমেকার্সের সঙ্গে কালাব্রিয়া আর লিয়াওয়ের সাথে থিও হার্নান্দেস চালিয়ে একের পর এক অ্যাটাক করেন উইং দিয়ে।
উইঙ্গারদের সাপোর্ট আর ওয়ান-টু-ওয়ান প্লের সাপোর্ট দিতে হাকান ও জ্লাতান চলে যান একপাশে। ফলে প্রতিওক্ষ দলের পুরো ডিফেন্সিভ স্ট্রাকচার চলে আসে একপাশে ডিফেন্ড করার জন্য। ঠিক তখনই লং পাসে উইং সুইচ করে দেয় মিলান। ফলে ফাঁকা ডিফেন্সের সুযোগ কাজে লাগিয়ে গোলের সুযোগ তৈরি করতে পারে মিলান। যে কারণে উইং ব্যাক থেকেও গোল পাচ্ছে মিলান অহরহ।
এটুকু শুনে মনে হতে পারে মিলানের দুই উইং ব্লক করে দিলেই হয়তো মিলানকে থামিয়ে দেওয়া সম্ভব। কিন্তু তা নয়। বরং মিলানের মিডফিল্ডে হাকান-বেননাসের-কেসি ত্রয়ীর কার্যকারিতা দেখা যায় তখন। উইং ব্লক করে দিলে স্বাভাবিক ভাবেই প্রতিপক্ষ উইঙ্গে চাপ থাকে বেশি। যে কারণে মাঝমাঠের ফাঁকা জায়গার সদব্যবহার করে মিলানের মাঝমাঠ। ডিফেন্সচেরা কয়েকটি শর্টপাস খুব সহজেই জায়গা করে দেয় প্রতিপক্ষের ডি-বক্সে।
এছাড়াও সাইমন কায়েরের লংবলের কথা না বললেই নয়। যেমনটা দেখা গিয়েছিল স্পেৎজিয়ার সাথে। আবার রোমা- ইন্টারের সাথে ব্যবহারর করেছে ওয়াইড উইং প্লে, তাদের থ্রি-ম্যান ডিফেন্স মাঝমাঠ দিয়ে ভাঙ্গা যেখানে ছিল প্রায় অসম্ভব। বলা বাহুল্য এতোকিছু সম্ভব হয়েছে ইব্রাহিমোভিচের জন্যই। তার মতো অভিজ্ঞ তারকা ডি-বক্সে শুধু গোলই করছেন না বরং তার ইন্টিলিজেন্ট প্লে, অফ দ্যা বল মুভমেন্ট আর হোল্ড-আপ প্লেয়িং সুযোগ করে দেয় অন্যদেরও ভালো খেলার। যেমনটা ব্রাহিম আর হাকান নিয়মিতই করছেন ডি-বক্সের বাইরে টপ অফ দ্যা বক্স থেকে শ্যুট নিয়ে।
লিয়াও, থিও আর স্যালেমেকার্সের মতো গুড রানার্সের সঙ্গে তোনালি, বেননাসের আর হাকানের গুড পাসিংয়ের সাথে শর্টপাসিং আর উইঙপ্লে ইউরোপের অন্যতম সুন্দর ফুটবলের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে সহজেই। হয়তো আটালান্টার মতো যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে পারেনি কিংবা ইউভেন্তুসের মতন স্টার পাওয়ার; কিন্তু এই মিলানে মিলানের মতৈ সুন্দর। যেমনটা ছিল আশি-নব্বই কিংবা এই শতাব্দীর শুরুতে, কার্লো আঞ্চেলত্তির হাত ধরে। মিলানের এই ফুটবল, এই হঠাৎ সাফল্য কোনো ফ্লুক নয়। বরং পিওলির ক্যালকুলেটিভ ভাবনা-চিন্তার ফসল। কিন্তু মিলানের এই উড়তে থাকা ফিনিক্স পাখির উত্থান হবে নাকি ইকারাসের মোমের পাখা তা বলে দিবে সময়ই!