আগ্রাসী দিনের বর্ণিল নায়ক

একই সিরিজে ব্যাট হাতে কমপক্ষে ২৫০ রান, বোলিংয়ে কমপক্ষে ১০টি উইকেট এবং ফিল্ডিংয়ে কমপক্ষে ১০টি ক্যাচ নেওয়ার রেকর্ডের কথা ভাবা হয়, তবে রীতিমতো অবিশ্বাস্য মনে হবে। আর এই অবিশ্বাস্য কীর্তি ওয়ানডে ক্রিকেটে দেখা গিয়েছে মাত্র একবার। প্রায় অসম্ভব এই কীর্তি ২০০৫ সালের ভিবি সিরিজে একজন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার গড়েছি - নাম অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস।

ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে এক সিরিজে কোনো ব্যাটসম্যান কমপক্ষে ২৫০ রান করেছেন, এমন ঘটনা কম নয়। এছাড়া এক সিরিজে কোনো বোলার ১০ উইকেট নিয়েছেন, এমন ঘটনাও ঘটেছে অনেকবার। তবে এই দু’টি শর্ত যখন এক করে দেওয়া হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই কাজটা বেশ কঠিন হয়ে যায়।

এসবের তুলনায় উইকেটরক্ষক বাদে কেবল ফিল্ডার হিসেবে এক সিরিজে ১০টি ক্যাচ নেওয়ার রেকর্ড খুবই কম। কিন্তু উপরের তিনটি শর্ত যদি একসাথে হিসেব করা হয় অর্থাৎ একই সিরিজে ব্যাট হাতে কমপক্ষে ২৫০ রান, বোলিংয়ে কমপক্ষে ১০টি উইকেট এবং ফিল্ডিংয়ে কমপক্ষে ১০টি ক্যাচ নেওয়ার রেকর্ডের কথা ভাবা হয়, তবে রীতিমতো অবিশ্বাস্য মনে হবে। আর এই অবিশ্বাস্য কীর্তি ওয়ানডে ক্রিকেটে দেখা গিয়েছে মাত্র একবার। প্রায় অসম্ভব এই কীর্তি ২০০৫ সালের ভিবি সিরিজে একজন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার গড়েছি – নাম অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস।

সাইমন্ডসের জন্ম ইংল্যান্ডের বার্মিংহামে আর সেইসূত্রে তিনি ইংল্যান্ডের নাগরিক ছিলেন। তাছাড়া তার বাবা মা ওয়েস্ট ইন্ডিজের নাগরিক হওয়ার কারণে দ্বীপরাষ্ট্রটির হয়েও খেলতে পারতেন। তবে শেষপর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।

গ্লস্টারশায়ারের হয়ে ১৯৯৫ সালে কাউন্টি ক্রিকেটে অভিষেক হয় সাইমন্ডসের। একটি সফল মৌসুম কাটানোর পর ‘বছরের সেরা তরুণ ক্রিকেটার’ এর পুরস্কার জিতেছিলেন তিনি। এমন পারফর্ম্যান্সের ধারাবাহিকতায় ইংল্যান্ড ‘এ’ দলের হয়ে পাকিস্তান সফরের সুযোগ পান এই অলরাউন্ডার। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলার ইচ্ছে থাকার কারণে প্রস্তাবটি ফিরিয়ে দেন তিনি।

বছর তিনেক পর অস্ট্রেলিয়ার হলুদ জার্সিতে খেলার সুযোগ পান অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস। ১৯৯৮ সালে ভারতের বিপক্ষে প্রথম মাঠে নেমেছিলেন তিনি। ক্যারিয়ারের তৃতীয় ম্যাচেই অপরাজিত ৬৮ রানের ইনিংস খেলে নিজের সম্ভবনার কথা জানান দেন সাইমন্ডস। কিন্তু এরপরই ছন্দ ধরে রাখতে ব্যর্থ হন তিনি। ২০০৩ বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত ৫৪ ম্যাচে বল হাতে ৪৪ উইকেট দখল করতে সক্ষম হলে ব্যাটিংয়ে মাত্র ২৩.৮১ গড়ে তার রান ছিল মাত্র ৭৬২।

এমন সংখ্যার জোরে অস্ট্রেলিয়ার মত দলের বিশ্বকাপ যাত্রায় সঙ্গী হওয়া যায় না৷ কিন্তু ক্রিকেট বিধাতা অন্য কিছু লিখে রেখেছিলেন হয়তো, আর তাই ইনজুরিতে বাদ পড়ায় শেন ওয়াটসনের পরিবর্তে সুযোগ পান অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস। সুযোগ পেয়ে এবার অবশ্য ভুল করেননি সাইমন্ডস, বিশ্ব মঞ্চে নিজের সবচেয়ে বিধ্বংসী রূপ প্রদশর্ন করেন তিনি।

শেন ওয়াটসনের ইনজুরি ছাড়াও ডোপ টেস্ট কেলেঙ্কারিতে শেন ওয়ার্নের নিষেধাজ্ঞার ফলে অস্ট্রেলিয়া তখন শক্তিমত্তায় পিছিয়ে পড়েছিল। এছাড়া আসরের প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে ছিলেন না মাইকেল বেভান, ড্যারেন লেহম্যানের মত দুই তারকা। ওয়াসিম আকরামের শুরুর তান্ডবে দিশেহারা হয়ে পড়ে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং অর্ডার। এরপরই শুরু হয় সাইমন্ডসের সাইমুম ঝড়। মাত্র ১২৫ বলে ১৪৩ রানের বিধ্বংসী একটি ইনিংস খেলে অস্ট্রেলিয়াকে নিরাপদ সংগ্রহ এনে দেন এই আক্রমনাত্মক ব্যাটসম্যান।

এছাড়া সেমিফাইনালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রায় একই পরিস্থিতি থেকে দলকে টেনে তুলেছিলেন অ্যান্ড্রু। অজি মিডলঅর্ডারের দায়িত্বহীন ব্যাটিংয়ে যখন চোখ রাঙ্গাচ্ছিল ছোটখাটো স্কোরের ভয় তখনই ব্যাট হাতে ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন সাইমন্ডস। লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যানদেরকে সঙ্গী করে অপরাজিত ৯১ রানের একটা দায়িত্বশীল ইনিংস খেলে ২১২ রানের একটা লড়াই করার মতো স্কোর এনে দেন অস্ট্রেলিয়াকে।

সেই বিশ্বকাপের পর থেকে দলে নিজের জায়গা নিয়ে আর ভাবতে হয়নি সাইমন্ডসকে। ২০০৫ সালে ভিবি সিরিজের প্রথম ফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৯১ রানের ইনিংস, কিংবা ২০০৬ সালের ভিবি সিরিজে শ্রীলংকার বিপক্ষে মাত্র ১০ রানেই ৩ উইকেট পড়ার পর ১৫১ রানের ইনিংসগুলো প্রমাণ দেয়, সাইমন্ডস আসলে বড় আসরের খেলোয়াড়ই ছিলেন।

পুরো ক্যারিয়ারে ২০০ এর কাছাকাছি ওয়ানডে ম্যাচ খেলা সাইমন্ডস পাঁচ হাজারের উপর রান করেছেন। ৯০ এর উপর স্ট্রাইকরেট আর ৪০ এর কাছাকাছি গড়; লোয়ার-মিডল অর্ডারের অনেক ব্যাটসম্যানদের জন্য ঈর্ষনীয় পরিসংখ্যান বটে। তাছাড়া বল হাতে সাইমন্ডস মাত্র ৩৭ গড়ে ১৩৩টি উইকেট নিজের পকেটে পুরেছেন। এছাড়া তার বোলিং ইকোনমিও পাঁচের কাছেই।

অল্প কিছুদিন টেস্ট ফরম্যাটে খেলেছেন সাইমন্ডস। ২৬ টেস্টের ক্যারিয়ারে ২টি সেঞ্চুরিসহ ৪০ এর উপর গড়; খুব ভালো না হলেও লোয়ার-মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানের জন্য খুব বাজে রেকর্ডও নয়। তবে বল হাতে কিছুটা ম্লান ছিলেন সাইমন্ডস। সাদা পোশাকে মাত্র ২৪ উইকেট সংগ্রহ করতে পেরেছেন তিনি।

টি২০ ক্রিকেটের শুরুর দিকে খেলেছিলেন অ্যান্ড্রু, ১৪ ম্যাচ খেলা এই অলরাউন্ডারের স্ট্রাইক রেট ১৬৪ আর ব্যাটিংগড় ৪৮.১৪! আর বোলিংয়ে ৯ এর কাছে ইকোনমিতে ৮ উইকেট নিয়েছেন সাইমন্ডস। এছাড়া ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে ডেকান চার্জার্স এবং মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের হয়ে খেলেছেন এই অজি গ্রেট।

সর্বজয়ী অস্ট্রেলিয়া’ ক্রিকেট দলে ওয়ানডে ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড়েরা খেলে গিয়েছেন। ম্যাথু হেইডেন- আদাম গিলক্রিস্টকে সর্বকালের সেরা ওপেনিং জুটিদের মধ্যে উপরের দিকে রাখা হয়। উইকেটকিপার হিসেবেও ওয়ানডের সর্বকালের সেরা আদাম গিলক্রিস্ট। তিন নম্বর পজিশনে ওয়ানডে ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি রান করার কৃতিত্ব পন্টিংয়ের, মাইকেল বেভানকে সর্বকালের সেরা ফিনিশার হিসেবেই মানা হয়, শেন ওয়ার্ন আর ম্যাকগ্রা তো সর্বকালের ওয়ানডে একাদশেই সুযোগ পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন।

কিন্তু অলরাউন্ডারের জায়গাতে অজিদের সর্বকালের সেরা কিংবা সময়ের সবচেয়ে সেরা খেলোয়াড় ছিলেন না। মার্ক ওয়াহ, স্টিভ ওয়াহ, টম মুডি, ব্র্যাড হগ এর মত আরো অসংখ্য খেলোয়াড়কে দিয়ে চেষ্টা করা হলেও কেউ আসলে কার্যকরী অলরাউন্ডার হয়ে উঠতে পারেননি। অজি দলের সেই অভাবেরই অনেকটা পূরণ করেছিলেন অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস। এক সিরিজে ২৫০ রান, ১০ উইকেট আর ১০ ক্যাচ নেয়া কিংবা ২০০৩ বিশ্বকাপে নায়কোচিত কীর্তি; এসব মৃত্যুর পরও বাঁচিয়ে রাখবে ক্যাঙ্গারুর দেশের এই কিংবদন্তিকে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...