একটা উক্তি, একটা মন্তব্য মুহূর্তের মধ্যে বনে যেতে পারে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। তেমনই এক মন্তব্যের সূত্রপাত ঘটিয়েছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ভঙ্গুর মানসিকতা নিয়েই পদার্পণ করেছে। তবুও দুই খানা ম্যাচ জিতে নেওয়া সম্ভব হয়েছে। যার ফলের সেমিফাইনালে যাবার একটা পথও সৃষ্টি হয়েছে। তবে সাকিব মনে করেন তেমনটা হলে তা হবে অঘটন।
মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে ভারতের মুখোমুখি হবে টিম টাইগার্স। এটাকে একপ্রকার অঘোষিত কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচই বলা চলে। যে জিতবে সে দলই সেমিফাইনাল দৌড়ে একধাপ এগিয়ে যাবে। সেদিক বিবেচনায় ম্যাচের উত্তাপটা নিশ্চয়ই টের পাওয়া যাচ্ছে। তাছাড়া বিগত বছরগুলোতে ভারত-বাংলাদেশ লড়াই একটা আলাদা মাত্রা পেয়েছে। এই দুই দলের সমর্থকরা প্রচণ্ডরকম আবেগি। ঠিক সেকারণেই ম্যাচে উত্তেজনার পারদ আকাশ ছুঁয়ে ফেলে।
কিন্তু এবার ম্যাচের আগেই বাংলাদেশের অধিনায়ক সাকিব আল হাসান যেন সেই আগুনে পানি ঢেলে দিলেন। তিনি অকপটে স্বীকার করলেন, ‘ভারত এই টুর্নামেন্ট জিততে এসেছে, বাংলাদেশ আসেনি। আমরা তাদের বিপক্ষে জিততে পারলে সেটা আপসেট হিসেবেই গণ্য হবে। আর আমরা সেই আপসেটটা ঘটাতে চাই।’
এমন মন্তব্য অবশ্য পুরো ক্রিকেট দুনিয়াকে দুইটি ভাগে বিভক্ত করেছে। বাংলাদেশের সমর্থকদের মন:ক্ষুণ্ণ হয়েছে। তাছাড়া ক্রিকেট বিশ্বের বহু কিংবদন্তিদের কাছে এমন মন্তব্য নেতিবাচক মানসিকতার বলেও মনে হয়েছে। সেই দলে রয়েছে পাকিস্তানের দুই কিংবদন্তি ফাস্ট বোলার ওয়াসিম আকরাম ও ওয়াকার ইউনুস।
পাকিস্তানের এক গণমাধ্যমে হওয়া অনুষ্ঠানে ওয়াসিম একজন অধিনায়ককে ইতিবাচক হবার পরামর্শই দিয়েছেন। তাছাড়া সাকিবের এমন মন্তব্যের নিন্দাও করেছেন ওয়াসিম আকরাম। তিনি বলেন, ‘যখন বিশ্বকাপের মত একটা টুর্নামেন্টে আপনার সেমিফাইনালে যাওয়ার সুযোগ থাকে, তাও আবার শক্তিশালী এবং টুর্নামেন্টের ফেভারিট দলের বিপক্ষে খেলে তখন আপনাকে কিঞ্চিৎ হলেও আত্মবিশ্বাস প্রদর্শন করতে হয়। তবে সাকিবের মন্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট বোঝা যায় যে তিনি ম্যাচের আগেই ধরে নিয়েছেন তাঁর দল হারতে চলেছে।’
সাকিবের এই নেতিবাচক মানসিকতা দলের জন্য কখনোই সুফল বয়ে নিয়ে আসবে না। তাছাড়া একটা দলকে চাঙ্গা রাখতে সেই দলের অধিনায়ককেই দায়িত্ব নিতে হয় তাঁর বাচনভঙ্গি ও কথাবার্তায়। ওয়াসিম বলেন, ‘এমন একটা পরিস্থিতে, এমন একটা ম্যাচ যখন আপনি একজন অধিনায়ক হিসেবে খেলতে যাবেন আপনাকে অবশ্যই পজিটিভ হতে হবে। তাছাড়া আপনার মস্তিষ্কে এটাও থাকতে হবে যে যেকোন প্রতিপক্ষের বিপক্ষে আমরা এই ম্যাচটি জিতব।’
অন্যদিকে পাকিস্তানের আরেক কিংবদন্তি পেস বোলার ওয়াকার ইউনুস সাকিবের এমন নেতিবাচক মন্তব্যে অবাক হয়েছেন ভীষণ। তিনি বলেন, ‘আগের ম্যাচটা বাংলাদেশ জিতেছে। জেতার পরই বাংলাদেশের অধিনায়ক বলছে আমরা এখানে জিততে আসিনি। এমন মন্তব্য করে তিনি বরং তাঁর দলকে আশাহীন করছেন। এটা দ্বারা বোঝা যায় আপনি ভয় পাচ্ছেন যে তাঁরা জিততে পারবেন না। তবে সত্যি বলতে ইতিবাচক মন্তব্য এই মুহূর্তে সম্ভবত সবচেয়ে ভাল সিদ্ধান্ত হতে পারত।’
ওয়াকার এমনটাও স্মরণ করিয়ে দেন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের মাঠের খেলায় বড় দল, ছোট দল বলতে কিছু নেই। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট বড্ড বেশি আনপ্রেডিক্টটেবল। দুই বারের বিশ্বকাপ জয়ী দল ওয়েস্ট ইন্ডিজ বাড়ি ফিরে গিয়েছে টুর্নামেন্টের প্রথম রাউন্ড থেকেই। এসব কিছু মাথায় রেখে তিনি বাংলাদেশের কাছ থেকে ইতিবাচক মন্তব্যই প্রত্যাশা করেছিলেন। তাই তিনি বেশ অবাক হয়েছে।
সাকিবের সেই মন্তব্যের পর খোদ বাংলাদেশের সমর্থকদের মধ্যেও বিভক্তি দেখা দিয়েছে। তাছাড়া কিংবদন্তি খেলোয়াড়দের একটা পক্ষ যখন সাকিবের সমালোচনা করছে তখন আরেক পক্ষ সাকিবের মন্তব্যের পক্ষে কথা বলছেন। তেমনই একজন ভারতের সাবেক বাঁ-হাতি পেসার জহির খান। তবে তাঁর কণ্ঠে তাচ্ছিল্যের সুরটা বেশ প্রখর। বেশ জনপ্রিয় ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইট ক্রিকবাজের এক অনুষ্ঠানে জহির সাকিবের বক্তব্য নিয়ে কথা বলেন।
সেখানে জহির বলেন, ‘সাকিব যা বলেছেন তা এক প্রকার সত্যই বলেছেন। সত্যিই যদি ভারতকে বাংলাদেশ হারিয়ে দেয় তবে আপনি নিশ্চয়ই বলবেন না যে, হ্যাঁ এমনটা হবারই ছিল। বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে ভাল খেলছে না। একজন অধিনায়ক হিসেবে নিজের পরিস্থিতি স্বীকার করে নেওয়া বেশ সাহসের কাজ। সাকিব স্বীকার করে নিয়েছে যে তাঁদের টুর্নামেন্ট এখানেই শেষ। তবে তাঁরা আপসেট ঘটাতে চায়। গ্রুপের সেমিফাইনাল লড়াইটা আরও রোমাঞ্চকর করতে চায়।’
সাকিবকে সাহসী অধিনায়ক হিসেবে অভিহিত করেছেন জহির খান। তাছাড়া জহির খানের মতে বাংলাদেশ একটা সময় যেকোন দলকে, যেকোন দিন হারিয়ে দিতে পারত। তবে বাংলাদেশ এখন আর সেই পরিস্থিতিতে নেই। সেদিক থেকে বাংলাদেশের চাইতে এগিয়ে রয়েছে আফগানিস্তান। এখন প্রায় প্রতিটা দলই আফগানিস্তানকে সমীহ করে চলতে চায়। বাংলাদেশ একটা সময় তেমনই সমীহ আদায় করতে সক্ষম হলেও সাম্প্রতিক সময়ে তাদের পারফরমেন্সের গ্রাফটা নিম্নমুখী বলেই মত জহির খানের।
সাকিব ঠিক এমন করেই যেন আলোচনায় থাকতে চান প্রতিটা সময়। তিনি আলোচনায় থাকতে পছন্দ করেন। তিনি আরও একটিবার সেটাই করলেন। এখন দেখার বিষয় বাংলাদেশ কি আসলেই কোন অঘটন ঘটাতে পারেনি কি-না ভারতের বিপক্ষে।