সম্রাট ও পঞ্চ ঘাতক

গত পঞ্চাশ বছরের সবচেয়ে বিধ্বংসী ব্যাটসম্যানের তালিকা তৈরি করতে বললে বেশিরভাগ বোদ্ধা যার নাম শীর্ষে রাখবেন তিনি হচ্ছেন ভিভ রিচার্ডস। পেস – স্পিন নির্বিশেষে তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করে এসেছেন। তাঁর দুলকি চালে হাঁটা, চ্যুইং গাম চিবোতে চিবোতে স্ট্যান্স নেওয়া, বিদ্যুৎ গতিতে বল তুলে উইকেট ভেঙ্গে দেওয়া – সব মিলিয়ে ক্রিকেট মাঠে তিনি থাকতে অন্য কাউকে সম্রাট ভাবা সম্ভব ছিল না। লয়েডের রত্ন খচিত ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের তিনি ছিলেন অবিসংবাদিত কোহিনূর।

গত পঞ্চাশ বছরের সবচেয়ে বিধ্বংসী ব্যাটসম্যানের তালিকা তৈরি করতে বললে বেশিরভাগ বোদ্ধা যার নাম শীর্ষে রাখবেন তিনি হচ্ছেন ভিভ রিচার্ডস। পেস – স্পিন নির্বিশেষে তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করে এসেছেন। তাঁর দুলকি চালে হাঁটা, চ্যুইং গাম চিবোতে চিবোতে স্ট্যান্স নেওয়া, বিদ্যুৎ গতিতে বল তুলে উইকেট ভেঙ্গে দেওয়া – সব মিলিয়ে ক্রিকেট মাঠে তিনি থাকতে অন্য কাউকে সম্রাট ভাবা সম্ভব ছিল না। লয়েডের রত্ন খচিত ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের তিনি ছিলেন অবিসংবাদিত কোহিনূর।

টেস্ট এবং একদিনের ম্যাচ, দুটোতেই ভিভ রিচার্ডসের রেকর্ড অসাধারণ। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও ঠিক যে অন্তত টেস্টে তার থেকে ভালো রেকর্ড অনেক ব্যাটসম্যানের আছে। ভিভের সমসমায়িকদের মধ্যে গ্রেগ চ্যাপেল, জাভেদ মিয়াদাদ বা সুনীল গাভাস্কারের রেকর্ড অনেক ক্ষেত্রেই ভিভের চেয়ে ভালো ছিল।

এবার ভিভের রেকর্ডের আরও একটু গভীর অ্যানালাইসিস করা যাক। টেস্ট ক্রিকেটে ভিভ রিচার্ডসের গড় সব দেশের বিরুদ্ধে ৪০এর ওপরে। একমাত্র নিউজিল্যান্ড ছাড়া, যেখানে তিনি মাত্র তিনটে টেস্ট খেলেছেন, সব দেশের মাটিতেও তার গড় ৪০এর বেশি। ম্যাচের প্রথম থেকে চতুর্থ ইনিংস – সবেতেই তার গড় ৪৮ থেকে ৫৪র মধ্যে ঘোরাফেরা করেছে। নিজের স্বদেশে বা বিদেশে, দুই জায়গাতেই তার গড় প্রায় ৫০। যদিও তার সব ইনিংসের স্ট্রাইক রেট পাওয়া যায় না, যে কটা ইনিংসের পাওয়া যায় তাতে সেটা প্রায় ৭০। আজকের দিনেও এই স্ট্রাইক রেট অসম্ভব ভালো বলে গন্য হবে। আর একদিনের ক্রিকেটে সেই স্ট্রাইক রেট গিয়ে ঠেকেছিল ৯০এর ওপর।

এ হেন ভিভ যে কোন বোলারকে তোয়াক্কা করবেন না সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। সারা ক্যারিয়র জুড়ে তিনি লিলি, টমসন, ইমরান, হ্যাডলি, বোথাম, কপিলদের আগুনের মোকাবিলা তিনি করে গেছেন হেলমেট ছাড়াই। বরং কিছু ক্ষেত্রে বোলারদের হেলমেটের দরকার পড়েছে।

অবশ্য যে বোলারদের নাম উল্লেখ করলাম তারাও সর্বকালের সেরাদের অন্যতম। কিন্তু ভিভ রিচার্ডসের বিরুদ্ধে তাদের সাফল্য কতটা? কোন এমন বোলার কি আছেন যাকে সম্ভ্রম করে চলতেন স্বয়ং ভিভ?

আমরা সেই বিষয়েই আজ একটু খোঁজখবর নেব।

টেস্ট ক্যারিয়রে ভিভকে পাঁচ বা তার বেশিবার আউট করেছেন মোট পাঁচজন বোলার। অস্ট্রেলিয়ার ডেনিস লিলি (৯ বার) ও জেফ থমসন (৫ বার)। এবং সেই যুগের তিন দুর্ধর্ষ অলরাউণ্ডার – ভারতের কপিল দেব (৭ বার), ইংল্যান্ডের ইয়ান বোথাম (৭ বার) এবং পাকিস্তানের ইমরান খান (৫ বার)।

নামগুলো আরও একবার লক্ষ্য করুন – লিলি, থমসন, কপিল, বোথাম ও ইমরান। যদি কোন কাল্পনিক বিশ্ব একাদশের বোলিং আক্রমণে এই পাঁচ ঘাতক থাকেন তাহলে বিপক্ষ টিমের ব্যাটসম্যানদের বিনিদ্র রজনী যাপন প্রায় বাঁধা।

যদি না সেই ব্যাটসম্যানের নাম ভিভ রিচার্ডস হয়। নাকি তিনিও ব্যাতিক্রম নন? দেখা যাক।

রিচার্ডস বনাম লিলিকে দিয়েই আরম্ভ করা যাক। সর্বকালের সেরা দুই বিধ্বংসী ক্রিকেটার একে অপরের মুখোমুখি হয়েছেন মোট ২১ বার, তার মধ্যে লিলি ভিভকে ৯ বার আউট করেছেন। কিন্তু লিলিকে তার মূল্যও দিতে হয়েছে। লিলি দলে থাকা অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ২১ ইনিংসে ভিভের মোট সংগ্রহ ৯২৬ রান, গড় ৪৮.৭৪। আর যে ৯ ইনিংসে লিলি আউট করেছেন ভিভকে সেই ইনিংসগুলোয় ভিভের গড় আরও সাংঘাতিক – ৬১.৩৩।

তবে কি ভিভ – লিলির ডুয়েলে ভিভকেই জয়ী ঘোষণা করে দেওয়া যেতে পারে?

অত তাড়াহুড়োর কিছু নেই। লিলি-ভিভকে নিয়ে আবার না হয় আলোচনায় ফেরা যাবে। ততক্ষনে অন্য চারজনের বিরুদ্ধে ভিভের রেকর্ড একটু দেখে ফেলা যাক।

জেফ থমসনকে অনেকেই সর্বকালের দ্রুততম বোলারের শিরোপা দিয়ে থাকেন। অনেকটা জ্যাভ্লিন ছোঁড়ার ভঙ্গীতে বল করতেন থমসন। গুড লেন্থের একটু পেছন থেকে আচমকা বাউন্স নেওয়া বল যে কতবার ব্যাটসম্যানদের হাসপাতালে পাঠিয়েছে তার লেখাজোখা নেই।

মোট ১৮ বার টমসনের মুখোমুখি হয়েছেন ভিভ। এই ১৮ ইনিংসে তার মোট সংগ্রহ ৭৮৫ রান, গড় ৪৩.৬১। তবে লিলির তুলনায় ভিভ কম আউট হয়েছেন থমসনের বলে আর এই পাঁচটা ইনিংসে তার মোট রান ১৪০, গড় ২৮।

লিলি আর থমসনের মধ্যে কে ভিভের বিরুদ্ধে বেশি সফল? এই প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়। লিলির তুলনায় টমসন ভিভকে কম রানে প্যাভিলিয়নে ফেরত পাঠাতে সফল হয়েছেন। তবে ক্রিজে সেট হয়ে যাওয়ার পর ভিভের বিরুদ্ধে টমসনের সাফল্য নেই। লিলি কিন্তু বার দুয়েক সেঞ্চুরি করার পরও ভিভকে আউট করেছেন, আর একবার ৯৮এর স্কোরে।

অর্থাৎ একবার টমসনের গতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার পর তার বিরুদ্ধে তেমন অসুবিধে হয় নি ভিভের, কিন্তু লিলি সবসময়ই বিপজ্জনক।

লিলি (বামে) ও থমসন

বোথামের ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ভিভের মোট সংগ্রহ ১৩০০ রান, গড় ৬১.৯০। যে ৭বার বথাম ভিভকে আউট করেছেন সেই ইনিংসগুলিতেও ভিভের গড় যথেষ্ট সম্মানজনক – ৪৭.৪৩। বোঝাই যাচ্ছে মাঠের বাইরে দুইজনের মধ্যে যতই বন্ধুত্ব থাক, মাঠের মধ্যে বথামকে ছেড়ে কথা বলেন নি ভিভ রিচার্ডস।

এবারে কপিলদেব। ভিভের মুখোমুখি কপিল হয়েছেন মোট ২৫টি ইনিংসে আর তার মধ্যে তিনি ভিভকে আউট করেছেন মোট ৭ বার। এই ২৫ ইনিংসে ভিভের মোট রান ১০১৮, গড় ৪০.৭২। আমাদের আলোচ্য পাঁচ বোলারের মধ্যে ভিভের গড় কপিলের ভারতের বিরুদ্ধেই সবচেয়ে কম। যে ৭বার কপিল আউট করেছেন রিচার্ডসকে এই ইনিংসগুলয় তার গড় আরও কম, ৩৩.৭১। আর যাই হোক, কপিলের বিরুদ্ধে ডুয়েলে ভিভকে এই মুহূর্তে এগিয়ে রাখা যাচ্ছে না।

ইমরানের নেতৃত্বে পাকিস্তান কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে একটা সময় সমানে সমানে টক্কর দিয়ে গেছে। এবার দেখা যাক এই দুই চ্যাম্পিয়নের সম্মুখ সমরের ফল কি দাঁড়িয়েছে।

মোট ২৩টি ইনিংস খেলেছেন ভিভ ইমরানের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে, মোট রান ১০৭৪, গড় ৪৬.৭। যে পাঁচবার ইমরান ভিভকে আউট করেছেন সেই ইনিংসগুলিতে কিন্তু ভিভ তেমন সুবিধে করতে পারেন নি। ২৩.৪০ গড়ে ১১৭ রান করেছেন মাত্র। অনেকটা টমসনেরই মতো নয় ভিভ ইমরানের বলে ইনিংসের আরম্ভেই আউট হয়ে গেছেন, নয় বেশ বড়সড় স্কোর খাঁড়া করেছেন। আর সেট হয়ে যাওয়া ভিভকে ইমরান আউট করতে পারেন নি।

এবারে আমরা একটু অন্যভাবে বোঝার চেষ্টা করব এই পাঁচজন ফাস্ট বোলারের পারফর্মেন্স। যেভাবে আমরা ভিভের রান আর গড় নিয়ে আলোচনা করলাম, ঠিক সেইভাবে এই পাঁচজনের ভিভের ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে কেমন পারফর্মেন্স ছিল সেটা দেখে নেওয়া যাক।

ডেনিস লিলি ২৫.৩৫ গড়ে ৫৫টি উইকেট নিয়েছেন রিচার্ডস খেলা অবস্থায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে। এই সংখ্যাগুলি বাকি চারজনের ক্ষেত্রে এইরকম – থমসন ২৭.৯২ গড়ে ৫১ উইকেট, বথাম ৩৫.৮৪ গড়ে ৫৮ উইকেট, কপিল ২২.৯৯ গড়ে ৭২ উইকেট এবং ইমরান ২৩.৩৮ গড়ে ৬৫ উইকেট। প্রত্যেকেই সেই সময়কার এক নাম্বার দলের বিরুদ্ধে শুধু ৫০এর ওপর উইকেটই নেন নি, একমাত্র বোথাম ছাড়া বাকি চারজনের গড়ও যথেষ্ট ভালো। এখানেও কপিলদেব সবচেয়ে উজ্জ্বল যদিও সামগ্রিক ক্যারিয়রে অন্যদের তুলনায় তার বোলিং গড় খারাপ। বথামের সপক্ষে একটা কথাই বলার – তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে যে চারটি সিরিজ খেলেছেন তার প্রত্যেকটিই প্রায় পূর্ণ শক্তির ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ১৯৮০ থেকে ১৯৮৬র মধ্যে।

কিন্তু একমাত্র রিচার্ডস বনাম বথাম ছাড়া, যেখানে রিচার্ডসকে প্রাধান্য প্রশ্নাতীত, অন্যদের ক্ষেত্রে আমরা কি কোনো সমাধানে পৌঁছতে পেরেছি? একদিকে যেমন রিচার্ডস সব টিমের বিরুদ্ধেই ৪০ বা তার বেশী গড়ে রান করেছেন, অন্যদিকে এই চারজন বোলারও ৩০-এর কম গড়ে ৫০এর ওপর উইকেট নিয়েছেন ভিভের ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে। এর সঙ্গে এটাও যোগ করা যেতে পারে যে রিচার্ডস অপেক্ষাকৃত অনেক বেশী শক্তিশালী দলের হয়ে খেলতেন বলে তিনি কিছুটা হলেও বাড়তি সুবিধে পেয়েছেন।

কিন্তু আমরা দেখতে চাইছি এই পাঁচজন বোলারের বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে ভিভের সাফল্য। যদি আমরা জানতে পারতাম যে শুধু এই পাচজনেরই বলে ভিভ কত রান করেছেন, সেক্ষেত্রে হয়ত আমরা একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারতাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে ভিভ শুধু লিলি, কপিল, ইমরান, বথাম বা টমসনের বলে কত রান করেছেন তার হিসেব আমাদের কাছে নেই।

তবুও একটা মোটামুটি হিসেব করা যায়। বোথামের ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ভিভের মোট রান ১৩০০। এই ম্যাচগুলিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের মোট রান ৮৭৪৬। অর্থাৎ ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের মোট রানের ১৪.৮৬% রান এসেছে ভিভের ব্যাট থেকে। এবারে আমরা যদি ধরে নিই যে ভিভের ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে বোথামের দেওয়া মোট রানের মধ্যে ১৪.৮৬% ভিভের ব্যাট থেকে এসেছে তাহলে আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাব যে শুধুমাত্র বোথামের বলে ভিভের ব্যাক্তিগত সংগ্রহ ৩০৯ রান। আর যেহেতু এই রান দিয়ে বথাম ভিভকে ৭ বার আউট করেছেন, বথামের বিরুদ্ধে ভিভের ব্যাটিং গড় দাঁড়াচ্ছে ৪৪.১৪।

এইভাবে হিসেব করলে দেখা যাবে ডেনিস লিলিই ভিভের বিরুদ্ধে ডুয়েলে সবচেয়ে বেশী সফল। এই হিসেবে তিনি মোট ১৯৫ রানের বিনিময়ে ৯ বার আউট করেছেন ভিভকে – গড় ২১.৬৬। এই গড় ইমরান, টমসন ও কপিলের ক্ষেত্রে যথাক্রমে ৫২.৪০, ৩৯.৮৩ এবং ২৭.২৬। সুতরাং এই ক্রাইটেরিয়ায় লিলি এবং কপিল এগিয়ে।

এখানে একটা কথা পরিস্কার। ভিভ এই পাঁচজনের মধ্যে কারোর ‘বানি’ ছিলেন এই কথাটা বলা যাবে না কোনমতেই। অন্যদিকে একমাত্র বথাম ছাড়া তিনি যে অন্য চারজনকে ব্যাটের দাপটে উড়িয়ে দিয়েছেন সেটাও বলা যাবে না। এই চারজনের বিরুদ্ধে তার লড়াই মোটামুটি ‘ব্যাটল অ্যামঙ ইকোওয়ালস’ ধরে নেওয়া যায়।

তবে এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। লিলি, কপিল, ইমরান বা টমসন বোলার হিসেবে সর্বকালের সেরাদের অন্যতম। এই দুর্দান্ত ঘাতকদের বিরুদ্ধে সম্রাটকেও সমঝে চলতেই হবে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...