লেগ সাইডে খেলতেই বেশি পছন্দ করতেন। সেজন্য ক্রিকেট বোদ্ধাদের কটুক্তির স্বীকারও হয়েছেন অনেক। তবে তাতে রস টেলরের কীই বা আসে যায়। তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলে গিয়েছিলেন নিজের মত করে, নীরবে-নীভৃত্বে। কখনো ব্রেন্ডন ম্যাককালাম কিংবা কখনো কেন উইলিয়ামসনরা নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট আকাশে চাঁদ হয়ে এসেছেন। তবে দূর আকাশে সবসময়ই ছিলেন দ্য রস টেলর।
নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সফল ব্যাটসম্যান বললে ভুল হবেনা। টেস্ট, ওয়ানডে কিংবা টি-টোয়েন্টি তিন ফরম্যাটেই, যেকোনো কন্ডিশনে, যেকোনো প্রতিপক্ষের বিপক্ষে সমান কার্যকর। একটা লম্বা সময় নিউজিল্যান্ডের হয়ে একসাথে তিন ফরম্যাটেই খেলেছেন। নিউজিল্যান্ড কখনো হেসেছে, কখনো কেঁদেছে তবে এক ধ্রুব তারার মত টেলর সবসময় রান করে গিয়েছেন।
এখন নিউজিল্যান্ড যে দলটাকে নিয়ে গর্ব করে। বিশেষ করে টেস্ট ক্রিকেটে গত কয়েকবছরে কিউইদের যে কাব্যগাথা। এর পিছনে সবচেয়ে বড় অবদান ছিল ডানহাতি এই ব্যাটসম্যানের। নিউজিল্যান্ডের ব্যাটিং লাইন আপের নিউক্লিয়াস ছিলেন একেবারে। কিউইদের সাফল্যে কখনো আলোটা ম্যাককালামের উপর পড়েছে, কখনো উইলিয়ামসনের উপর। টেলর হয়তো আঁধারে থাকতেই পছন্দ করতেন, যেনো নিজের কাজটা করে যাওয়াতেই তাঁর পরম আনন্দ।
এইতো বছর সাতেক আগেও এমন সুদিন ছিল না নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের। ২০১২-১৩ সালের দিকে টানা হারের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল দলটা। এমনকি ১৯৫০ সালের পর সেই প্রথম টানা পাঁচ টেস্ট ম্যাচ হেরেছিল নিউজিল্যান্ড। তখনই কিউদের দায়িত্বটা নেই ম্যাককালাম। তবে এই অধিনায়কের পাশে এক অনন্ত শিখার মত জ্বলে গিয়েছেন রস টেলর।
এরপর ম্যাককালাম যখন বিদায় নিলেন তখন দায়িত্বটা পড়লো কেন উইলিয়ামসনের কাঁধে। কেন উইলিয়ামসন দলটাকে বিশ্বের সেরাদের কাতারে নিয়ে যাওয়া শুরু করলেন। এবারো অনন্ত সাথী রস টেলর। টেলর, উইলিয়ামসনরা মিলে পরলেন টেস্ট ক্রিকেটের সর্বোচ্চ মুকুট। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালেও ভারতের বিপক্ষে কিউইদের ভরসা এই টেলর। যার তুলির আঁচড়েই রঙিন হলো টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা।
২০০৬ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যাত্রাটা শুরু করেছিলেন। টেস্ট ক্রিকেটে শুরুটা বছরখানেক বাদে। এরপর প্রায় দেড় দশকের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার। এই সময়টাতে কিউইদের ক্রিকেটে অনেক পালাবাদল হয়েছে। তবে চার নম্বরে এই নিপাট ভদ্রলোক ছিলেন ধ্রুব।
যতদিন খেলেছেন ধারাবাহিক ভাবে রান করে গেছেন। নিউজিল্যান্ডের হয়ে টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রানের মালিক হয়েছেন। বিশ্বের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে তিন ফরম্যাটেই ১০০ ম্যাচ খেলার কীর্তি গড়েছেন। তবে কখনো কোন দম্ভ, অহংকার প্রকাশ করেননি। মাঠ কিংবা মাঠের বাইরে নূন্যতম কোন ভুল হলেও জিহ্বা কামড়ে ক্ষমা চেয়েছেন।
সবমিলিয়ে রস টেলর ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম ভদ্রলোক। এই ভদ্রলোক দেশটির হয়ে এখন পর্যন্ত ১১০ টি টেস্ট খেলেছেন। সেখানে ৪৪.৮৭ গড়ে তাঁর ব্যাট থেকে এসেছে ৭৫৮৪ রান। ৩৫ হাফ সেঞ্চুরির পাশে আছে ১৯ টি সেঞ্চুরি। সর্বোচ্চ ২৯০ রানের ইনিংসও খেলেছেন বাইশ গজে দাঁড়িয়ে। এমনকি রঙিন পোশাকের ক্রিকেটেও ব্যাটটা তাঁর কথাই শুনতো।
কিউইদের হয়ে খেলা ২৩৩ ওয়ানডে ম্যাচে ৪৮.২০ গড়ে রান করেছেন। এই ফরম্যাটে ২১ সেঞ্চুরি নিয়ে করেছেন ৮ হাজারেরও বেশি রান। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সর্বোচ্চ ১৮১ রানের অপরাজিত সেই ইনিংসটাও এখনো জ্বল জ্বল করে ক্রিকেট বইয়ের পাতায়। এছাড়া ১০২ টি-টোয়েন্টি ম্যাচেও আছে ১৯০৯ রান। ঝুলিতে আছে ৭ টি হাফ সেঞ্চুরিও।
এই সংখ্যাগুলোই প্রমাণ করে ক্রিকেটার টেলর আসলে কতটা সমৃদ্ধ ছিলেন। ঠিক কতটা মেঘ জমলে এমন বৃষ্টি হয়ে রান ঝড়ে। তবে এসব ছাপিয়ে তিনি মনে থাকবেন নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের এক সেতুবন্ধন হিসেবে। তিনি মনে থাকবেন সদা মাথা নিচু করে থাকা নিপাট এক ভদ্রলোক হিসেবে। লুটেরু রস পৌতোয়া লোট টেলর থাকবেন আমাদের অন্তরের অন্ত:স্থলে।