ব্যালকনি থেকে ওয়াসিম আকরাম চেঁচিয়েই উঠলেন প্রায়। ইরফান পাঠান হাওয়ার বিপরীতে বল করছেন অ্যাডিলেড ওভালে। ব্রিসবেনে জহির খানের চোটের পর ভারতের বোলিং লাইন আপ দেখে সিডনির বিখ্যাত মিডিয়া প্রিন্ট খরচ করে লিখে দিয়েছে অজি ব্যাটসম্যানদের চিবিয়ে খাবার জন্য সবচেয়ে সুস্বাদু মুরগীদের নিয়ে এসেছে অধিনয় সৌরভ। ভাজ্জি আঙুলের চোটে আউট। অ্যাডিলেডের ড্রেসিংরুমে ঢোকার আগে সৌরভের কিটব্যাগ বওয়া দেখেই শোকের আবহ স্পষ্ট। নেহেরা-আগারকার-কুম্বলের সাথে পার্টটাইম হিসেবে বীরু আর শচীন!
সামনে কারা? হেইডেন-পন্টিং-মার্টিন-ওয়াহ-ক্যাটিচ!
কেএফসির মুরগীভাজার মতো মুখ করে অজিত আগারকার প্রায় বলেই দিলেন আর একটা পেসার চাই। এদিকে সৌরভ জহিরকে ছাড়তে নারাজ, কিন্তু বাধ্য হয়েই চোটের জন্য দলে এল তরুণ পাঠান। ওয়াসিম তখন পাঠানকে নিজের ছেলের মতো দেখেন। অ্যাডিলেডে অভিষেকেই হেইডেনকে তুলে নেবার পর সৌরভ নাগাড়ে বল করিয়ে যাচ্ছেন রাউন্ড দ্য উইকেটে ফেলে। বাচ্চা ছেলে! ওয়াসিমের চিন্তা পন্টিং যে কনফিডেন্সে কাট মারতে শুরু করেছেন ওভালের খাটো দু-ধার দিয়ে পাঠানের কপালে অভিষেকেই না দুঃখের ভার এসে জমে।
বাঙালির ঘুম ভাঙছে তখন। ভোরের চাদর মুড়ি দিয়ে একটা জাতি বসে গেছে টিভির সামনে। তখন ওভারসিজে টিম গেলে গোটা দেশটা কেমন এককাট্টা হয়ে থাকত। বছরে হাতেগোনা ম্যাচ, সিরিজের আগে দু থেকে তিনটে প্র্যাকটিস ম্যাচ। সৌরভের দাঁতের সৌজন্যে হাতের নখ আর নেই বেশি। স্টিভের বিদায়ী সিরিজে অজি মিডিয়া ছেঁকে ধরেছে সৌরভকে, বেচারা ড্রেসিংরুমে লুকিয়ে এনে রেখে দিয়েছে মাইক ব্রিয়ারলির ক্যাপ্টেনসির বই।
ব্রিসবেনে সৌরভের সেঞ্চুরিটাই তাতিয়ে দিয়েছিল কিন্তু ‘আও কাভি হাভেলি পার’ স্টাইলে অজি ব্যাটিং দানবরা শুরু করলো অ্যাডিলেডে সংহার। প্রথম দিনে ৪০০ রান!
ম্যাচের রাশ পুরোপুরি পান্টারের হাতে।
কিন্তু, চমকে যেতে হয় এই সময়ে এক অধিনায়কের সিদ্ধান্ত দেখে। স্টিভ নামছেন। মার্টিনের প্রস্থান আর স্টিভের শেষবেলার অস্তরাগে লাল হয়েছে অ্যাডিলেডের প্যাভিলিয়ন, রাজকীয় সম্মান নিয়ে আসার পর একি!
সৌরভ তাঁকে অভ্যর্থনা জানালেন বাউন্সারে, পরেরটা একেবারে পাঁজরে, লেগে শর্ট লেগ, মিড উইকেট সাজিয়ে বসে আছেন সৌরভ, যেন চক্রব্যুহে ফেলছেন এক বিদায়ী সম্রাটকে। অ্যাডিলেডের দর্শক অগ্নিগর্ভ!
অস্ট্রেলিয় ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠতম অধিনায়কের এ কি অপমান! টেস্টের মসনদে একে তো সৌরভ দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন স্টিভকে মিনিটখানেক তাই নিয়ে মেলবোর্ন প্রায় যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। ‘Let him come to baggy green’- এই ছিল শিরোনাম। ২০০৩-০৪ এ অজিরা হিংস্রতার সবচেয়ে দুর্গম কাঁটা বিছানো পথ সাজাচ্ছিলেন টিম ইন্ডিয়ার জন্য আর সৌরভ কিনা স্টিভের জন্য বডিলাইন রাখলেন?
ইতিহাস মনে রাখে তার চরণরেখাকে। ঠিক যেমন এই এডিলেড দেখেছিল ডনের মাটিতে সচিনের ব্যর্থতা, আবার সিডনিতে প্রত্যাবর্তন তেমনই দ্রাবিড় নামক সভ্যতার কাছে ক্যাঙ্গারুর দেশে সমস্ত নদীর মিলে যাবার অপরূপ রূপ!
দ্রাবিড়-লক্ষ্মণ ৫৫৬ রানের পাহাড়ের সামনে দাঁড়ালেন, স্টিভের গ্রাস কেড়ে নেওয়ার ব্লু-প্রিন্ট ফের লেখা হল ইডেন থেকে এডিলেডে কিন্তু সৌরভ যে লোকটিকে বোর্ডের বিপক্ষে গিয়ে ব্যাক করলেন সেই আগরকর দ্বিতীয় ইনিংসে তুলে নিলেন ৬ উইকেট, তাও এডিলেডের মতো ব্যাটিং সারফেসে।
আজ ভারতের বিদেশ সফরে ব্যর্থতার মাঝে স্পষ্ট হচ্ছে স্টিভের অবয়ব। অজি সাম্রাজ্যে অকুতোভয় একটা দল, যেন আলেকজান্ডারের নৌবহরের সামনে এগারোজন পুরু, যার পেশীর বাহুল্য নেই রয়েছে আত্মপ্রত্যয়। স্টিভ থেকে পন্টিং-এ ঢলে পড়ছে অজি সভ্যতা, এদিকে অন্ধকার থেকে বাঁক নিয়ে আরও আলোর কাছে ছুটতে চাইছে ভারতীয় ক্রিকেট।
এই বোর্ডার-গাভাস্কার তাই টেস্ট সিরিজ তো নয় যেন ইতিহাসের হলদে দলিল যা পেরেছিল একটা পুরো জাতিকে ভোর পাঁচটায় টিভির সামনে বসিয়ে দিতে, আজও ভারতের বিলেত সফর এলে মনে পড়ে চ্যানেল নাইনের সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে সৌরভ বলছেন, ‘হতে পারে এটা ওর (স্টিভ ওয়াহ) শেষ সিরিজ, কিন্তু যেকোনো মূল্যে আমরা এখানে চ্যালেঞ্জ জানাতেই এসেছি। পুরো স্কোয়াড আমার সাথে, আমরা লড়াই করবো, দেখা যাক কি হয়।’
স্পষ্ট ভেসে ওঠে এতগুলো বছর পরেও ব্রিসবেন, এডিলেড থেকে সিডনির টানেল দিয়ে বেরিয়ে আসছেন পড়ন্ত বেলার স্টিভ আর ঝকঝকে বেহালার তরুণ, একটা গোটা জাতি দুলে উঠছে প্রতিটা মুহুর্তে টিভির সামনে বসে,ব্যাগীগ্রিণ সাম্রাজ্যের মাঝে কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ার মতো চিকচিক করে উঠছে ভারতীয় ক্রিকেটের মুকুট, এক বিদায়গাথার পাণ্ডুলিপিতে লেখা হচ্ছে অন্য আগমণীর সুর।