মায়াবতী প্রেমের শেষ অধ্যায়

প্রেম ধীরে মুছে যায়,

নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়

ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো’র বুটজোড়াও ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে যাওয়ার সাথে সাথে পুরোনো হয়ে যায়। কেউ কেউ ফিনিশড আখ্যাও দেয়। তবু বুটজোড়া রোনালদোর। মাঠে নামা মাত্রই জীবন্ত হয়ে পড়ে তারা৷ বয়সের বাঁধা ডিঙিয়ে বলকে সজোরে আছড়ে ফেলতে চায় গোল লাইনের ওপাশে। দুমড়ে মুচড়ে দিতে চায় প্রতিপক্ষকে। তবু ইচ্ছের বিরুদ্ধে থমকে দাঁড়াতে হয়, বয়সটা বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। তখন বয়সের অংকের এক জটিল সমীকরণ মেলাতে বসতে হয়।

৩৬ বছর বয়সে যখন ‘সিরি এ’ ছাড়তে চাইলেন তখন অনেকে ধরে নিয়েছিলো তুলনামূলক সহজ কোন লিগেই দেখা যাবে বুড়োটাকে। কিন্তু সবাইকে চমকে দিয়ে ইউরোপের সবচেয়ে প্রতিযোগিতামূলক লিগে ফিরলেন তিনি৷ কিংবদন্তি হওয়ার শুরুটা যেখানে, কিংবদন্তি হয়ে সেখানেই ফিরেছিলেন।

তরুণ বয়সের ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে যখন ফিরেছেন ক্রিশ্চিয়ানো তখন তার পারফরম্যান্স নিয়ে সন্দিহান ছিল অনেকেই। পাঁচ ম্যাচে ছয় গোল;যার মাঝে আবার তিনটি ম্যাচ উইনিং গোল; করে একা হাতে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের নক আউট পর্বে তুলে দিয়ে সব সন্দেহ সমূলে উৎপাদন করেছিলেন।

কিন্তু যারে দেখতে নাহি পারি তার চলন বাঁকা। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের নড়বড়ে অবস্থান যেন রোনালদোকে ট্রল করার সবচেয়ে বড় অস্ত্রতে পরিনত হয়। দলের পক্ষে সর্বোচ্চ গোল করা সত্ত্বেও তাকে বানানো হয় দলের বোঝা! মরার উপর খাঁড়ার ঘা এর মতই সর্বশেষ ম্যানচেস্টার ডার্বি খেলতে পারেননি ইনজুরিতে।

তাতেই যেন নিন্দুকের ঢোলে বাড়ি লাগলো। সমালোচনার তূণে বারবার বিদ্ধ হলেন রোনালদো। যতবারই নিন্দুকের নিন্দে কানে এসেছে ততবারই নিজের পারফরম্যান্স দিয়েই তা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। টটেনহ্যাম হটস্পারের বিপক্ষে যখন মাঠে নেমেছিলেন তখন একরাশ দুশ্চিন্তা ছিল, হয়তো ছিল নিজেকে উজাড় করে দেয়ার তীব্র মানসিক শক্তি।

সেই শক্তিতেই হয়তো নিজ হাতে লিখে ফেললেন কাব্য। সর্বশেষ ম্যাচে গোল না পাওয়া রোনালদো কতটা ভয়ংকর তার আরো এক নিদর্শন যেন ওল্ড ট্র্যাফোর্ড বিশ্বের সম্মুখে উপস্থাপন করলো। নিজের সবচেয়ে ভয়ংকরতম রূপে মাঠে নেমেই ম্যাচের মাত্র বারো মিনিটের সময় ডি বক্সের কিছুটা দূর থেকেই ডান পায়ের বুলেট শট। কিছুই করার ছিল না হুগো লরিসের৷ বলের আশ্রয় হয় জালে।

এমন গোল মনে করিয়ে দেয় পুরোনো সেই সিআরসেভেন এর কথা। এরপর টটেনহ্যাম সমতায় ফিরলেও জোডান সানচো’র অ্যাসিস্ট থেকে নিঁখুত ফিনিশিংয়ে আবারো রেড ডেভিলদের লিড এনে দেখে পর্তুগীজ এই সেনসেশন। কিন্তু ম্যাচের বয়স যখন ৭২মিনিট তখন ইউনাইটেড অধিনায়ক হ্যারি ম্যাগুয়ের নিজেই নিজেদের জালে বল পাঠিয়ে দেন। ২-২ এ সমতায় ম্যাচ।

আত্মঘাতী গোলেই নাটকের সমাপ্তি হয় নি,বাকি ছিল উপসংহারের। আর ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো নিজ হাতেই উপসংহার টেনে দিলেন। অ্যালেক্স টেলেসের চমৎকার ভাসানো কর্নার কিকে মাথা ছুঁইয়ে তৃতীয়বারের মত এগিয়ে দেন ম্যান ইউনাইটেড। আর এই গোলেই পূর্ন তিন পয়েন্ট নিশ্চিত হয় তাদের। পূর্ণ হয় একজন অতিমানবের হ্যাটট্রিকও। অতিথি স্পার্সদের সমাধি একাই গড়ে দেন এই অতিমানব।

‘ফিনিশড’ আখ্যা পাওয়া রোনালদো হ্যাটট্রিক করেছেন, জিতিয়েছেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে। তবে গল্পটা এখানেও শেষ হয়নি। তিন গোলের প্রথমটায় তিনি বসেছিলেন সর্বকালের সেরা গোল স্কোরার জো বাইকেনের পাশে আর দ্বিতীয় গোল করার মধ্যদিয়ে বাইকেনকে পিছনে ফেলে রোনালদো হয়ে গেলেন বিশ্বের সর্বকালের সর্ব্বোচ্চ গোলদাতা।

প্রিমিয়ার লিগে পুনরায় ফিরে আসার পরে এটি রোনালদোর প্রথম হ্যাট্রিক। তবে এর আগে ২০০৮ সালের ১২ই জানুয়ারি প্রথম প্রিমিয়ার লিগ হ্যাটট্রিক করেছিলেন আর ঠিক ১৪ বছর ২ মাস পর তুলে নিলেন নিজের দ্বিতীয় হ্যাটট্রিক। এমন এক সময় বেছে নিলেন যখন তাকেই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল। সর্বকালের সেরা হওয়ার এইতো বৈশিষ্ট্য; দলের প্রয়োজনে সবার আগে।

রোনালদোর এমন পারফরম্যান্স শুধু নিন্দুকের জন্যই যন্ত্রনাময় নয়, ভক্তদের জন্যও অদ্ভুত। যতটা মুগ্ধ করেছে, ততটাই জ্বালা সৃষ্টি করেছে হৃদয়ে। অনেকটা বিচ্ছেদের আগে প্রেমিকের মনের অবস্থার মতই; যে জেনে ফেলেছে মায়াবতী প্রেমিকার এসমস্ত দেখাই ঠাঁই পাবে শেষ দেখার তালিকায়। রোনালদোও যে শেষের পথেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link