ভারতের পাঞ্জাবে দ্বাদশ শ্রেণি পাশের পর আপনাকে কেউ জিজ্ঞাসা করবে না, আপনি ভবিষ্যতে কি করতে চান বরং উল্টো সবাই আপনাকে বলবে, ‘কিরে! কানাডা কবে যাচ্ছিস/যাচ্ছো?’
আসলে এটা আমাদের কাছে অনেকটাই হাস্যকর!
আর্শদ্বীপ সিং,পাঞ্জাবের বাঁ-হাতি ফাস্ট বোলার। ২০১৭ সালে তার বাবার সাথে এমনই একটা আলাপ হয়। কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি। বয়স ভিত্তিক ক্রিকেট দলে তাঁর সুযোগ পাওয়া কতটা কঠিন ছিল, কতটা অনিশ্চিত ছিল ক্রিকেটে তার এই পথচলার ভবিষ্যৎ – এটুকুতেই যা বোঝা যায়।
তার বাবা সবসময়ই চাইত আর্শদ্বীপ তার অন্যান্য ভাইদের মতই কানাডা যাক, প্রথমত পড়াশোনা এরপর সে সেখানে নিজেকে ‘সেটেল’ করুক।
আর্শদ্বীপ অনেক সাহস সঞ্চয় করে আরও একটা বছর ক্রিকেটের সাথে থাকতে চেয়ে বাবার কাছে অনুরোধ করে। সেই বছরটিই তার জন্য স্মরণীয় হয়ে যায়। মূলত জেলাপর্যায়ে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পারফরমেন্সের জন্য পাঞ্জাব অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়েই তাঁর ক্রিকেট ক্যারিয়ারের যাত্রা শুরু হয়। তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে মূল্যবান সময় আসে নিউজিল্যান্ডে যখন সে ২০১৮ সালে ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জয়ী দলের স্কোয়াডে জায়গা পায়।
আর্শদ্বীপ হাসতে হাসতে বলছিলেন, ‘এখন যদি আমাকে ব্রাম্পটনে যেতে হয়, তবে আমি ছুটি কাটাতেই যাব। অন্য কিছুর জন্যে নয়।’
কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের হয়ে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) খেলে ফিরে আর্শদ্বীপ বলেন, ‘গত চার মাস আমার কাছে স্বপ্নের মতন ছিল, অনেকটা ২০১৮ এর মতনই। যখন আমি ‘রাহুল দ্রাবিড়ের অধীনে ভারতীয় অনু-১৯ এর ড্রেসিং রুমে ছিলাম, আমার জীবনের সেরা সময়টা উপভোগ করেছি।’
নেটে প্রাকটিসের সময়,আর্শদ্বীপ, কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের কোচ, অনিল কুম্বলের থেকে ক্রমাগত ভাল করার জন্য অনেক কিছু পেয়েছেন। শুধু তাইই নয়, তিনি ‘ইউনিভার্স বস’ খ্যাত গেইলের সাথে অনেক মজার সময় কাটানোর পাশাপাশি মোহাম্মদ শামির থেকেও বেশ কিছু বোলিং টিপস ও পেয়েছেন। মাঠে সে ম্যাচের শেষের দিকে পিনপয়েন্ট অ্যাকুরেট ইয়র্কারের সৌজন্যে রোহিত শর্মা, আন্দ্রে রাসেল, মানিশ পান্ডের মত ব্যাটসম্যানদের আউট করে ম্যাচ জিতিয়েছেন।
সব মিলিয়ে আর্শদ্বীপ পাঞ্জাবের হয়ে লিগ পর্যায়ের ১৪ ম্যাচের মধ্যে ৮ ম্যাচ খেলে। এই ৮ ম্যাচে তিনি ৮.৭৭ ইকোনমি রেটে ৯ উইকেট সংগ্রহ করেন।
কিন্তু, ম্যাচে তাঁর কার্যকারিতা, তাঁর পরিসংখ্যান দিয়ে বিচার করবার মত নয়। ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তাঁর ঠাণ্ডা মাথার বোলিং, মিডল ওভারে তার কন্ট্রোল এবং বোলিংয়ে তার ভ্যারিয়েশন দেখানোর যে ইচ্ছাশক্তি তা সত্যিই প্রশংসার দাবীদার।
একজন নতুন খেলোয়াড়, যে কিনা পাঞ্জাবের হয়ে মাত্র তিনটি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলেছে, সেই খেলোয়াড়টিই মোহাম্মদ শামি, ক্রিস জর্ডান, শেলডন কটরেলকে নিয়ে বানানো বোলিং লাইন আপেও নিজের সাফল্যের চিহ্ন রেখে এসেছেন।
তার উন্নতি কে তার খেলা ম্যাচসংখ্যার দিক থেকেও দেখা যেতে পারে। গত মৌসুমে যে কিনা মাত্র তিনটি ম্যাচ খেলতে পেরেছিলেস, উন্নতির জন্যই ভিন্ন একটা ফ্র্যাঞ্চাইজির হয়ে নয়টি ম্যাচ খেলতে পেরেছেন।
তাহলে প্রশ্ন হল পরিবর্তন টা কোথায় হল? আর্শদ্বীপকে দুই বছরের মধ্যে তুলনা করতে বলা হলে তিনি উত্তর দিলেন, ‘আসলে গত মৌসুমে তারা আমার দিকে ভাল করে তাকানোর সুযোগ পায় নি, তাছাড়া আমি সেবার খুব বেশি ঘরোয়া ম্যাচও খেলিনি। কিন্তু, পরবর্তীতে লখনৌতে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-২৩ দলে বিপক্ষে যখন ভাল খেলি, তখন সেখান থেকে আমি বেশ ভাল আত্মবিশ্বাস পাই।’
‘আমার মনে হয়, তখনই আমাকে সবাই খেয়াল করে। কিন্তু এ বছর আইপিএল শুরুর আগে পুরোমাসব্যাপী চলা অনুশীলন ক্যাম্পটা অনেক সাহায্য করেছে। কেননা, পুরো কোচিং স্টাফরা প্রত্যেকটা খেলোয়াড়কে আলাদা আলাদা ভাবে দেখার জন্য যথেষ্ঠ সময় পেয়েছে। আমি প্রাকটিস ম্যাচগুলাতে অনেক উইকেট পাই, আমার মনে হয় সবকিছু সেখান থেকেই শুরু হয়। অনিল কুম্বলে স্যার আমাকে বলেছিল, আমি এবার শুরু থেকেই সুযোগ পেতে পারি এবং তার জন্য আমি যেন প্রস্তুত থাকি। আমি নেট এবং প্রাকটিস ম্যাচে ভাল বল করার আত্মবিশ্বাস কেই সামনে নিয়ে এগিয়ে যায়!’, যোগ করেন তিনি।
আর্শদ্বীপ লকডাউনের পুরো চারটি মাস বাবার সাথে তাদের বাসার ছোট্ট জিমে ট্রেনিং করে কাটান। যখন চন্ড্রিগড়ের অবস্থা কিছুটা ভাল হয়, তখন তিনি যুবরাজ সিংয়ের পাঞ্জাবের তরুণ খেলোয়াড়দের জন্য তৈরি ক্যাম্পে যান। সে সময়ে আইপিএল আয়োজনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি।
আইপিএল শুরু হলে, আর্শদ্বীপ শামি-জর্ডান এর সাথে ভাল সম্পর্ক বজায় রাখা শুরু করেন। ফ্রি সময় গুলোতে তাদের সাথে বোলিং নিয়ে আলোচনা করতেন।
তিনি বলেন, ‘শামি ভাই একজন বিশ্বমানের বোলার। সে সবমসময়ই তরুণ খেলোয়াড়দের মধ্যে তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করবার জন্য আগ্রহী থাকেন। প্রেসার সিচুয়েশনে কিভাবে বল করা যায়, কিভাবে চিন্তা করা যায়? – এই জিনিসগুলা আমাকে শামি ভাই বলেছেন।’
‘এর পাশাপাশি সে আমার সিম পজিশন নিয়েও কাজ করেছেন, যেটা আমি মনে করতাম, আমার সবসময়ই উন্নতি করা যাবে। আমার এখনো মনে আছে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের বিপক্ষে ম্যাচে আমি শেষ ওভার বল করছিলাম। কাইরেন পোলার্ড আমাকে পরপর দুই বলে দুটা ছক্কা মারে। এর পরেই শামি ভাই এগিয়ে আসে এবং আমাকে বলে চিন্তা না করে আমার সেরা ডেলিভারিটা করতে। সাথে এটা না ভাবি, সামনে কে আছে, কাকে বল করছি! এমনকি পরের বলেও যদি আমি ছক্কা খাই – তারপরও ভাবা যাবে না।’
তাহলে সেটা কি, আর্শদ্বীপের মানসিকতা পরিবর্তনে সাহায্য করেছিল? তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই। কেননা এরপরে যখন আমি বড় কোনো খেলোয়াড়কে বল করেছি, আমি শান্ত থাকি, মাথার ভেতরে কিচ্ছুই রাখি না। মিটিংয়ের সময় আলাদা আলাদা ব্যাটসমানকে নিয়ে আলাদা পরিকল্পনা করা হয়, আমি সেটাই মনে রাখার চেষ্টা করি। এটা উইকেটের চরিত্রের ওপরও নির্ভর করে, কেমন বিহেভ করছে! এটা মূলত ব্যাটসমানের সাথে বোলারের যুদ্ধ। এখানে কোচ বা অধিনায়কের বেশি কিছু করার থাকে না। তাই আমার নিজেকেই যা করার করতে হবে।’
‘আমার ভেতরে যদি সেরকম আত্মবিশ্বাস না থাকে তবে সেটা পুরো দলের জন্যই একটা নেতিবাচক ধারণা দেয়। আমার কাছে, ব্যাটসমান যত বড়ই হোক না কেন, আমার খেয়াল থাকে, বলটাকে ঠিকঠাক ভাবে করা!’, যোগ করেন আর্শদ্বীপ সিং।
আর্শদ্বীপ ১৩০ কি.মি /ঘন্টাতে বল করে। তাঁর বল সুইং করানোর দক্ষতা আছে। ২০০৬ সালের ইরফান পাঠানের করা হ্যাট্ট্রিক আর্শদ্বীপের ক্রিকেটীয় স্মৃতির মধ্যে অন্যতম।
এরপর পরই পাঠান তার ‘আইডল’ বনে যান। যখন ‘আইডল’ই আপনাকে নিয়ে ভাল কথা বলবে, তখন সেটা শুনতে কার না ভাল লাগে। আজকাল, আর্শদ্বীপ মিচেল স্টার্কের বোলিং দেখে, যদিও তার এবং স্টার্কের পারসোনালিটি সম্পূর্ণ ভিন্ন।
আর্শদ্বীপ বললেন, ‘আমি আমার কোচ জয়ন্ত রাইয়ের সাথে আমার গতি বাড়ানো নিয়ে কাজ করছি। আমি আমার হাতের গতি বাড়ানোর সাথে সাথে দৌড়ানোর সময়ের ছন্দের মিল এনে গতি বাড়াতে চাচ্ছি। আইপিএলের পরে আমি মাত্র এক সপ্তাহের বিশ্রাম নিয়েছি, আর তারপরই আমি ট্রেনিংয়ে ফিরে এসেছি।’
আর্শদ্বীপ জানেন, তিনি এখন কোথায় অবস্থান করছে এবং কোনগুলা তার জন্য বেশি জরুরী। তিনি দৃষ্টি রাখছেন ভবিষ্যতের দিকে। আইপিএলের জৌলুসে তিনি নিজেকে হারাতে চান না। মাঠে তিনি পাঞ্জাবের কিংবদন্তি হতে চান।
তিনি বলেন, ‘আমি প্রথমত লাল বলে সফল হইতে চাই। পাঞ্জাবকে রঞ্জি ট্রফির নক আউটে তুলতে চাই। আমি সত্যিই ভুলেই গেছি আমরা সবশেষ কবে জিতেছিলাম, তাই আমি এটা করতে চাই এবং ইতিহাসের অংশ হতে চাই রঞ্জি টফি জেতার মধ্য দিয়ে। আমি একজন ধারাবাহিক এবং ভরসাযোগ্য বোলার হতে চাই।
আর্শদ্বীপ খেলা দেখার চেয়ে খেলতেই বেশি পছন্দ করে। তিনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘আমি মোটে একটি ম্যাচেই স্টেডিয়ামে গিয়ে দেখেছিলাম, সেটা ছিল চ্যাম্পিয়নস লিগের অকল্যান্ড এইচেস বনাম কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের মধ্যে, ছয় বছর আগে। যদিও আমি অনেক হকি খেলা দেখেছি। পাঞ্জাবে হকি অনেক বড় একটি খেলা তাই আমার বাবা আমাকে ছোটকালে হকি দেখতে নিয়ে যেত। আমার এখনো মনে আছে, আমরা চারজন বাবার স্কুটারে চড়ে যেতাম। আমি সামনে, বাবা চালাত আর বোন এবং মা পেছনে থাকতো।’
‘বাবা তখন বলত, তুমি যখন বড় হবা, সফল হবা একটা বড় গাড়ি কিনবে এবং আমরা তখন সবাই সেই গাড়িতে করে অনেক আরামে ঘুরে বেড়াব। আমার এখনো মনে পড়ে কথাটা।‘, যোগ করেন তিনি।
আর্শদ্বীপ তাঁর কথা রেখেছেন, স্বপ্ন পূরণ করেছেন। তিনি এখন একটি এসইউভি, একটু টয়োটা ফরচুনারের মালিক। গাড়ি চালিয়েই এখন তিনি মাঠে আসেন। সম্ভবত এখনই সময় তার ভাগ্যকে চালিয়ে সব ধরনের ফরম্যাটে নিজেকে সফল করার যাতে কিনা সে একদিম দেশের হয়েও খেলতে পারে। এমনকি এখন তাঁর পরিবারের সকল ধরনের সহযোগিতাও তিনি পাচ্ছে। কানাডাকে তিনি পুরোপুরিভাবেই পেছনে ফেলে দিয়েছে।