অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহর। শহরের ক্রিকেট স্টেডিয়ামের নামকরণ সেই শহরের নামেই। ‘সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ড’ ধারণ ক্ষমতা প্রায় ৪৮০০০। তিল ধারণের ঠাই সেদিন খুঁজে পাওয়া দায় হয়ে গিয়েছিল। দিনটা ছিল ২০০৪ সালের ছয় জানুয়ারি। সেদিন এক কিংবদন্তির অবসরের দিন। স্টিভ ওয়াহ সেদিন টেনে নিয়েছিলেন নিজের টেস্ট ক্যারিয়ারের ইতি।
অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের মধ্যকার টেস্ট সিরিজের চতুর্থ টেস্ট। টেস্টটা ড্র হয়েছিল। কিন্তু এই ড্রয়ের পেছনে রয়েছে দুর্দান্ত সব ক্রিকেটীয় প্রদর্শন। একেবারেই শুরু থেকে শুরু করা যাক। বেশ উজ্জ্বল সকালে ভারত জয় পেয়ে যায় টসে। পিচটা খুব ব্যাটিং সহায়ক ভেবেই শুরুতে ব্যাটিং এর সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন সৌরভ গাঙ্গুলি। নিজের ব্যাটারদের উপরও নিশ্চয়ই তাঁর অগাধ ভরসা ছিল। সেই ভরসার প্রতিদান ভারতীয় ব্যাটাররা দিলেন বটেই।
শচীন টেন্ডুলকারে দ্বিশতক ও ভিভিএস লক্ষণের দেড়শো পার করা রানের উপর ভর করে প্রথম ইনিংস শেষে ৭০৫ রানের পুঁজি পায় ভারত। খরচ হয় সাত উইকেট। বিশাল বড় লিড। পেরোতে হবে অজিদের হয় সেই পাহাড়সম রান কিংবা ফলোঅন। কোন রকমে সামাল দিল অজি ব্যাটাররা।
জাস্টিন ল্যাঙ্গার ও সায়মন ক্যাটিচের শতকের পর ৪৭৪ রানে থেমে ছিল অস্ট্রেলিয়ার ইনিংস। অজি অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহ ৭২ বলে ৪০ রানের একটা ছোট্ট ইনিংস খেলে ক্রিজে ছিলেন মোট ৯০ মিনিট। গুরুত্বপূর্ণ এক নক।
এরপর ভারত আবার ব্যাটিং এ নামে। যেহেতু ততক্ষণে অস্ট্রেলিয়া ফলোঅন এড়িয়ে ফেলেছে। মোটামুটি ব্যাটিং তখনও করা যাচ্ছিল সিডনির সেই পিচে। দুই উইকেটের বিনিময়ে স্কোরবোর্ডে আরো ২১১ রান যুক্ত করে ভারত। অর্ধ-শতক করেন বীরেন্দ্র শেবাগ, শচীন টেন্ডুলকার ও রাহুল দ্রাবিড়।
দ্রুত রান তুলে অস্ট্রেলিয়াকে ৪৪৩ রানের এক টার্গেট ছুঁড়ে দেয় ভারত। চতুর্থ দিনে শেষ বিকেলে অস্ট্রেলিয়াকে পুনরায় ব্যাটিং এ নিমন্ত্রণ জানায় ভারত। ভারতীয় বোলাররা ছিল দারুণ ফর্মে। তাছাড়া শেষ বিকেলে একটা উইকেট তুলে নেওয়াই ছিল ফন্দি। কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ে অজি ওপেনাররা সামলে নেন পরিস্থিতি।
পঞ্চম দিনের শুরুতেই বাঁধা দেয় বৃষ্টি। সেদিন মেঘঘন অস্ট্রেলিয়ার আকাশ হয়ত চাইছিল না স্টিভ ওয়াহের শেষ টেস্টটায় তাঁর নামের পাশে হারের ট্যালি যুক্ত হোক। সেই ইচ্ছাটা বোধ করি ওয়াহের মধ্যেও কাজ করেছিল। আর করেছিল রিকি পন্টিং এর মধ্যে।
বিশাল বড় টার্গেট তাড়া করে জয়ের জন্যই খেলতে চেয়েছিল অজিরা। কিন্তু টেস্টের পঞ্চম দিনের উইকেটে আসলে টিকে থাকাটাই বড্ড চ্যালেঞ্জিং একটা বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সেখানে চারশোর বেশি রান তাড়া করে জেতার আশা করা আকাশ-কুসুম স্বপ্নের সামিল।
অন্তত ড্র হোক। সেই প্রত্যাশা নিয়ে টেস্টের পঞ্চম দিন অর্থাৎ ৬ জানুয়ারি ২০০৪ সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে হাজির হয়েছিল ১৮৯৯৮৯ জন দর্শক। যা কিনা স্টেডিয়ামটির ধারণ ক্ষমতার প্রায় পাঁচ গুণ। তবে একটা ড্র কিংবা একটা জয়ের আশায় সেদিন দর্শকেরা মাঠে আসেননি।
তাঁরা এসেছিলেন এক কিংবদন্তিকে বিদায় জানাতে। তাঁরা এসেছিলেন স্টিভ ওয়াহকে বিদায় জানাতে। স্টিভ ওয়াহ সেদিন তাঁর পারফর্মেন্সে হতাশ করেননি সেই স্টেডিয়াম ভরা দর্শকদের।
৮০ রানের একটি দারুণ ইনিংস খেলেছিলেন ওয়াহ। তাঁর থেকেও যেটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেদিন তা হচ্ছে বাইশ গজে টিকে থাকা। তিনি ছিলেন। খেলেছিলেন ১৫৯ বল। ক্রিজে ছিলেন ১৭৯ মিনিট। ঘন্টার হিসেব করলে যা দাঁড়ায় প্রায় তিন ঘন্টা।
সেই তিন ঘন্টায় ম্যাচটি ধাবিত হয়েছিল ড্রয়ের দিকে। নতুবা ফলাফল ভিন্ন হতে পারত। ওয়াহের শেষ টেস্টে একটা হার লেখা হয়ে থাকত। ওয়াহ যখন আউট হলেন ততক্ষণে বিকেল গড়িয়েছে। খেলার দিকও গড়িয়েছিল ভিন্ন পথে। অগত্যা দুই দলকে ড্র মেনে নিতে হল।
এর মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটে প্রায় দুই দশকের এক ক্রিকেটীয় যাত্রার। যেখানে ছিল প্রায় ১৯ হাজার রান ও ২৮৭ উইকেট। বিদায় বেলায় অস্ট্রলিয়ান এই কিংবদন্তির উইকেট তুলে নিয়েছিলেন ভারতীয় কিংবদন্তি অনিল কুম্বলে, তাঁর ক্যারিয়ারের ৬১৯টি টেস্ট উইকেটের মাঝে এই একটি উইকেটও রয়েছে। ওয়াহের উইকেট তুলে নিতে কুম্বলেকে সাহায্য করেছিলেন আরেক কিংবদন্তি শচীন টেন্ডুলকার, যার নামের পাশে রয়েছে শতকের শতক হাঁকানোর অনন্য রেকর্ড।