নাসের আল খেলাইফি, বর্তমান ফুটবলে এক পরিচিত নাম। প্যারিস-সেইন্ট জার্মেই দলের একের পর এক চমকপ্রদ ট্রান্সফার খবরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন তিনি। ইউরোপীয় ফুটবল পাড়ায় পরিচিত এই মুখের আরো একটি পরিচয় রয়েছে। প্রেসিডেন্ট খেলাইফি একসময় ছিলেন খেলোয়াড়। তবে ফুটবল নয় টেনিস।
পেশাগত ভাবে টেনিস খেলতেন নাসের আল খেলাইফি। কাতার জাতীয় টেনিস দলের হয়ে খেলা এই খেলোয়াড় ২০০২ সালে তাঁর ক্যারিয়ার সেরা র্যাংকিং ৯৯৫ নম্বরে উঠেছিলেন বর্তমান ফুটবল প্রশাসক খেলাইফি।
টেনিস খেলুড়ে জীবনে খেলাইফির প্রাপ্তির খাতায় হয়ত বড় জায়গা জুড়ে থাকবে সাবেক টেনিস তারকা টমাস মাস্টারের সাথে খেলতে পারার সুযোগ। টমাস মাস্টার ছিলেন সাবেক ফ্রেঞ্চ ওপেন জয়ী এবং বিশ্বের টেনিস তারকাদের মধ্যে দ্বিতীয় সেরা খেলোয়াড়। ১৯৯৬ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত খেলায় বড় ব্যবধানে হেরেছিলেন সেবার নাসের আল খেলাইফি।
তবে দ্বৈততে তুলনামূলক ভাল খেলতেন খেলাইফি। ১৯৯৩ সালের দোহা টেনিস টুর্নামেন্টে ১৬৪০ ডলার বাগিয়েছিলেন নাসের আল খেলাইফি ও তার সতীর্থ রাশিয়ান আন্দ্রে চেরকাসব। কোয়ার্টার ফাইনালের আগের রাউন্ডে ব্রিটিশ খেলোয়াড় জেরেমি বেটস ও দক্ষিণ আফ্রিকান গ্যারি মুলারের কাছে ৬-৩, ৬-৩ ব্যবধানে হেরেও অর্থকড়ি নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন খেলাইফি ও তাঁর রাশিয়ান সতীর্থ।
খেলার মান বিবেচনায় এককের চাইতে দ্বৈতেই কার্যকরী ছিলেন খেলাইফি। টিম হিসেবে খেলার পারদর্শীতা থেকেই টেনিস কোর্টে পরিচয় কাতারের অষ্টম আমির তামিম বিন হামাদ আল-থানি এর সাথে। তারপর বন্ধুত্ব গভীর হয়। দায়িত্বের বণ্টন হয়।
আল-থানি ২০১১ তে প্রতিষ্ঠিত করেন ‘কাতার স্পোর্টস ইনভেস্টমেন্ট’ নামক একটি সংস্থা। কাতারের অষ্টম আমিরের সাথে একসাথে কাতার জাতীয় দলে টেনিস খেলার সুবাদে সুসম্পর্ক থাকার কারণে খেলাইফিকেই আল-থানি প্রদান করেন স্পোর্টস ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব। দায়িত্বের এক বছরের মাথায় খেলাইফির তত্বাবধানে ২০১২ তে কাতার স্পোর্টস ইনভেস্টমেন্ট সংস্থা তাঁদের ইতিহাসের বড় বিনিয়োগ করে ফরাসী ক্লাব প্যারিস সেইন্ট জার্মেই দলের দায়িত্বভার নিজেদের কাঁধে নিয়ে।
অঢেল টাকার ছড়াছড়িতে দলে ভেড়াতে শুরু করেন জাভিয়ার পাস্তোরে, জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ, ডেভিড বেকহ্যাম, থিয়াগো সিলভা, এডিনসন কাভানির মতো তৎকালীন তারকা খেলোয়াড়দেরকে। টাকার হিসেবে জ্লাতানের পেছনে খরচ করেছে ক্লাবটি ১৫.৭ মিলিয়ন পাউন্ড। থিয়াগো সিলভা ৩০, পাস্তোরে ৩৭, কাভানিকে ৫৫ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে ফ্রান্সে এনেছিলেন কাতার স্পোর্টস ইনভেস্টমেন্ট বোর্ড তথা নাসের আল খেলাইপি। বর্তমানেও এ ধারা অব্যাহত রেখে, মেসি, নেইমার, রামোস, এমবাপ্পেদের মতো খেলোয়াড়দেরকে নিজেদের ডেরায় স্থান দিয়েছে পিএসজি।
খেলাইফি একজন দক্ষ সংগঠকের ন্যায় চেষ্টা করছেন তাঁর ক্লাবের ইমেজ, খ্যাতি বাড়াতে। ক্লাবের পাশাপাশি তাঁর দেশের পরিচিতি সমানতালে বাড়াতে সচেষ্ট তিনি৷ তাঁর দেশ কাতার মাথাপিছু আয় অনুযায়ী পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশ। এদের অর্থনীতির পুরোটাই প্রাকৃতিক জ্বালানির উপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতা কমানোর পরিকল্পনা থেকে প্রতিষ্ঠিত হয় কাতার ইনভেস্টমেন্ট সংস্থা।
কাতার প্রচুর পরিমাণ তেল ও গ্যাস উৎপাদন ও বিপনন থেকে প্রাপ্ত অর্থ বর্তমানে বিশ্বের লাভজনক অনেক প্রোজেক্টে বিনিয়োগ করছে। ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত কাতার ইনভেস্টমেন্ট কর্তৃপক্ষ জনসম্মুখে আসে। তারপর থেকে এর প্রসার ঘটে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাতার স্পোর্টস ইনভেস্টমেন্ট ও কাতর হোল্ডিংস এর সহয়তায়। প্রায় ১০০ বিলিয়ন পাউন্ডের সম্পদ রয়েছে সংস্থাটির। যা মূলত কাতার সরকারের মনিটরিং এর আওতাধীন। এই সংস্থার শেয়ার রয়েছে ইংল্যান্ড ভিত্তিক বার্কলেস ব্যাংকিং খাত থেকে শুরু করে জার্মান অটোমোবাইল কোম্পানি ভক্সওয়াগনে।
এছাড়াও খেলাইফির নেতৃত্বে টিভি নেটওয়ার্ক বেইন স্পোর্টস পরিচালনা করছে কাতার। যা বিশ্বব্যাপী ফুটবল সম্প্রচারে বেশ সমাদ্রিত। পিএসজির পাশাপাশি বেশকিছু ইউরোপীয় ফুটবল ক্লাবের সাথেও সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কাতারের৷
ফুটবলার কেনার বিশাল বড় অংকের সব চেকে সই করার পাশাপাশি নিজের দেশের ভাবমূর্তি, অর্থনীতিতে বেশ বড় ভূমিকা রাখছেন সাবেক এই টেনিস খেলোয়াড়, নাসের আল খেলাইফি। এমন এক একনিষ্ঠ, দেশপ্রেমিক সংগঠকই হয়ত খুঁজে বেড়ায় পৃথিবীর বড় বড় দেশগুলো। খেলাইফি সাহেব টেনিস কোর্ট ছেড়েছেন, বুদ্ধির খেলা ছাড়েননি।