ভুল সময়ে, ভুল জায়গায় জন্মেছিলেন তিনি

ক্ষুদে গড়নের লোকেরা বাইশ গজে বরাবরই নিজেদের শারীরিক আকৃতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছেন। এই তালিকায় হানিফ মোহাম্মদ কিংবা শচিন টেন্ডুলকাররা যেমন আছেন, তেমনি একালে মুমিনুল হক কিংবা মুশফিকুর রহিমরাও আছেন।

আরেকজন আছেন। তিনি হলেন – টাটেন্ডা টাইবু। যদিও, তাঁকে ‘লিটল মাস্টার’-এর চেয়ে ‘অনন্ত আক্ষেপ’ নামে ডাকাই শ্রেয়। কারণ, ভুল সময়ে ভুল দেশে জন্মেছিলেন তিনি। জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট কেবল একাই ধ্বংস হয়নি, টাইবুর মত কিছু প্রতিভাকেও শেষ করে দিয়েছে।

৫ ফুট ৫ ইঞ্চি আকৃতির শরীর নিয়েও তিনি ছিলেন অসাধারণ এক উইকেটরক্ষক! উইকেটের পেছনে তিনি যেমনটা পারদর্শী ছিলেন ঠিক ততোটাই মনমুগ্ধকর ছিল তাঁর ব্যাটিং। জিম্বাবুয়ে দলের হয়ে দলের ক্রান্তিকালে একাই পাড়ি দিয়েছেন অনেকটা পথ!

২০০১ সালের জুন মাস, বয়স তখন তাঁর কেবল মাত্র আঠারো পূর্ণ হলো, হারারেতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে সেবছরই নিজের প্রথম ওয়ানডে খেলে ফেলেন জিম্বাবুয়ের এই খেলোয়াড়। তবে প্রথম ম্যাচে নিজেকে চেনাবার কোনো সুযোগ পান নি তিনি, ম্যাচ শেষে ১ রান করে অপরাজিত ছিলেন তিনি। সেই থেকে ওয়ানডেতে তাঁর পথ চলা।

এরপর জিম্বাবুয়ের হয়ে খেলেছেন দীর্ঘ ১১ বছর! দলের প্রয়োজনে তাঁকে একাই ব্যাট হাতে লড়তে হয়েছিল অসংখ্যবার! ১৫০ ওয়ানডেতে ২৯.২৫ গড়ে করেছেন ৩৩৯৩ রান! এর মাঝে ছিল দু’টি সেঞ্চুরি এবং ২২ টি হাফ সেঞ্চুরি!

ওয়ানডেতে নিজের স্বপ্নের ইনিংসটির কথা বললে হয়তো তিনি ২০০৭ সালের আগস্টে হারারেতে অনুষ্ঠিত দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে খেলা ৩য় ওয়ানডে ম্যাচটির কথাই বলতেন। সেবার টস জিতে প্রথমে ব্যাট করতে নামে দক্ষিণ আফ্রিকা, প্রোটিয়ারা কতোটা বিধ্বংসী হতে পারে তা সবারই জানা।

তাই, স্বভাবতই ৩২৪ রানের বিশাল টার্গেট ছুড়ে দেয় জিম্বাবুয়েকে। তবে জিম্বাবুয়েও ছেড়ে কথা বলে নি, এই বিশাল টার্গেটকেও প্রায় ছুঁয়েই ফেলেছিল জিম্বাবুয়ে। হ্যামিল্টন মাসাকাদজা, ভুসিমুজি সিবান্দা, ব্রেন্ডন টেইলরের পর প্রোটিয়াদের উপর মূল আঘাতটিই হেনেছিল এই টাইবু।

সে ম্যাচে ১২৯ বলে ১০৭ রান নিয়েও ছিলেন তিনি অপরাজিত! তার ব্যাটে ভর করেই জিম্বাবুয়ে চলে গিয়েছিল জয়ের একেবারে দ্বারপ্রান্তে। তবে দলের অন্য ব্যাটসম্যানেরা একেবারেই সঙ্গ দিতে না পারায় সেদিন জিম্বাবুয়ের ইনিংস থেমেছিল ২৯৫ রানে! ২৮ রানের হার হলেও জিম্বাবুয়ের জন্য এ ছিল এক বিশাল প্রাপ্তি, তাইবুর জন্য তো বটেই। কেননা যে সময়ের কথা বলছি তখন ক্রিকেট বলতেই ধরা হত অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত ইত্যাদি দলগুলোকে।

২০০১ সালে জুন মাসে ওয়ানডে অভিষেকের পরপরই জুলাইয়ে হয়ে যায় টেস্ট অভিষেকও। ২০০১ সালে তাঁর অভিষেক হলেও জিম্বাবুয়ের টেস্ট অধিনায়কের খেতাবটা পেতে বেশি সময় লাগেনি এই ক্রিকেটারের।

২০০৪ সালে সেবার টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে স্বিকৃতি পাবার পরই জন্ম দেন এক নতুন রেকর্ডের। এখন পর্যন্ত টেস্ট ক্রিকেটে এতো কম বয়সী (২১) অধিনায়ক দেখেনি ক্রিকেটবিশ্ব। তবে তরুণ হলে কি হবে ক্রিকেটের মারপ্যাঁচ সেই তরুণ বয়সেই ধরতে পেরেছিলেন জিম্বাবুয়ের এই উইকেট রক্ষক-ব্যাটসম্যান।

বাংলাদেশের বিপক্ষে বরাবরই জ্বলে উঠতো তাঁর ব্যাট।

২০০৫ সালের জানুয়ারির কথা। বঙ্গবন্ধু জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে চলছিল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশের দ্বিতীয় টেস্ট।

প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নামে জিম্বাবুয়ে, বোর্ডে ৩০০ রান জমা হতে না হতেই (২৯৮) গুড়িয়ে যায় দলের সবাই। ব্যাটিংয়ে অন্যরা ব্যর্থ হলেও লড়েছিলেন তাইবু, ২৯৪ বলে ৮৫ রানের সে ইনিংসটিতে ছিল আটটি চারের মার। তবে নিজেদের প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশের অবস্থা হয় আরো শোচনীয়।

ব্যাট করতে নেমে সুবিধে করতে পারেননি দলের কেউই, তাই ২১১ রানেই অলআউট হতে হয় বাংলাদেশকে। দ্বিতীয় ইনিংসে জিম্বাবুয়ে ব্যাট করতে নামলে আবারো বাংলাদেশের পথের কাটা হয়ে দাঁড়ায় সেই চিরচেনা টাইবু! ৩৪০ বলে ১৯ চার এবং দুই ছয়ের মারে করেন ১৫৩ রান!

ব্যাটিঙে টাইবু ছিলেন যেন এক আস্থার প্রতীক হিসেবে। ২০০৮ সালে তাই হয়ে যায় আইপিএল খেলবার সুযোগও। সেবার কলকাতা নাইট রাইডার্সের জার্সি গায়েই দেখা গিয়েছিল জিম্বাবুয়ের এই ডানহাতি ব্যাটসম্যানকে।

ব্যাটসম্যান তাইবু যেমন সফল ঠিক উইকেটরক্ষক টাইবুও ছিলেন বেশ সফল। ওয়ানডেতে ১৫০ ম্যাচে নিয়েছিলেন ১১৪ টি ক্যাচ এবং ব্যাটসম্যাকে ৩৩ বার স্ট্যাম্পিং এর ফাঁদে ফেলেছিলেন! অন্যদিকে ২৮ টেস্টে নিয়েছিলেন ৫৭ টি ক্যাচ ও স্ট্যাম্পিং করেছিলেন পাঁচটি।

শুধু ব্যাটিং আর কিপিং নয় বোলার হিসেবেও দেখা গিয়েছিল ৮৪ টি ওয়ানডেতে! তবে বোলিংয়ে ছিলেন একেবারেই ফ্যাকাশে। পুরো ওয়ানডে ক্যারিয়ারে নিয়েছেন কেবল মাত্র দুটি উইকেট। তবে, ‍উইকেটরক্ষণের কাজ থেকে বোলিংয়ে যে এসেছিলে – তাই তো বেশি!

বয়স যখন কেবল মাত্র ২৯ তখনই সকল ধরণের ক্রিকেট থেকে বিদায় জানান এই ক্রিকেটার। নি:সন্দেহে ক্যারিয়ারটা আরো বড় হতে পারতো তাঁর। কিন্তু, বোর্ডের বিরুদ্ধে কথা বলার পরই জীবনটা অতিষ্ট হয়ে উঠেছিল তাঁর। তিনি ও তাঁর পরিবার প্রাণ নাশের হুমকিও পেয়েছিলেন। এত কিছুর ভিড়ে আর যাই হোক ক্রিকেট খেলা যায় না!

ক্রিকেটারের জীবন ছাড়ার পর বিচিত্র এক জীবন কাটিয়েছেন টাইবু। একটা সময় ধর্মকর্মের প্রতি অনেক আগ্রহী হয়ে পড়েন। জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের (জেডসি) সাথে বাজে সম্পর্ক ভুলে বোর্ডে সম্পৃক্ত হয়েছে। আবার সব ছেড়ে ছুড়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেও ফিরেছেন। তাতে তাঁকে ঘিরে আক্ষেপটা আরো বেড়েছে।

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link