জার্ড মুলার, মিরোস্লাভ ক্লোসার মত জার্মান স্ট্রাইকারদের নাম শুনলে শ্রদ্ধায় মাথা নিচু হয়ে আসে ফুটবল ভক্তদের। এমনিতেও স্ট্রাইকার তৈরিতে অন্য দেশের তুলনায় বেশ এগিয়ে চার বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। এমনই একজন প্রতিভাবান আর দুর্দান্ত স্ট্রাইকার মারিও গোমেজ৷ না, তিনি কোনোভাবেই জার্ড মুলার কিংবা মিরোস্লাভ ক্লোসাদের মত নন। তারপরও অর্জনের তুলনায় প্রাপ্ত স্বীকৃতি পাওয়া হয়নি গোমেজের।
১৯৮৫ সালের ১০ই জুলাই পশ্চিম জার্মানিতে জন্মগ্রহণ করেন মারিও গোমেজ। জার্মানিতে জন্ম হলেও গোমেজের বাবা জোসে গোমেজ গার্সিয়া ছিলেন স্প্যানিশ আর মা ক্রিস্টেল রথ ছিলেন ব্রাজিলিয়ান। সব মিলিয়ে ফুটবলের তিন ঐতিহ্যবাহী দেশের নাম জড়িয়ে আছে মারিও গোমেজের জন্মের সাথে। ব্রাজিল, স্পেন আর জার্মানি যার সাথে মিশে গিয়েছে তার পায়ে তো ফুটবল শোভা পাবেই৷
ছোটবেলা থেকেই তাই ফুটবলের সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে মারিও গোমেজের। ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি রোনালদিনহো, রিভালদোদের খেলা অনুসরণ করে নিজেকে তৈরি করতে শুরু করেন তিনি। ১৩ বছর বয়সে স্থানীয় ক্লাব স্টুটগার্ট ক্লাবের কাছ থেকে প্রস্তাব ফেলেও এত অল্প বয়সে বাড়ি ছেড়ে যেতে রাজি হননি।
পরে অবশ্য ১৬ বছর বয়সে তিনি সেই ক্লাবের একাডেমিতে যোগ দেন। মাত্র দুই বছর পরেই উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগে ফ্র্যাঙ্ক ল্যাম্পার্ড, মার্সেল ডেসাইলির মত তারকাদের বিপক্ষে খেলার সুযোগ পান গোমেজ।
কিংবদন্তি ইতালিয়ান কোচ জিওভান্নি ত্রাপাত্তনির অধীনে নিজের আরো পরিপূর্ণ করে তোলেন মারিও গোমেজ। হয়ে ওঠেন ভরসাযোগ্য ফিনিশার, ২০০৬/০৭ মৌসুমে ১৪ গোল আর সাত অ্যাসিস্ট করে জার্মান ক্লাবটির পঞ্চম বুন্দেসলিগা শিরোপা জেতার পথে সামনে থেকে পথ দেখান গোমেজ। একই বছর তিনি জার্মানির ‘ফুটবলার অব দ্য ইয়ার’ নির্বাচিত হয়েছিলেন। তবে আর এক মৌসুম পরেই শৈশবের ক্লাবকে বিদায় বলেন গোমেজ।
আনুমানিক ৩০-৩৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে জার্মানির সবচেয়ে বড় ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখে যোগ দেন মারিও গোমেজ। সব মিলিয়ে স্টুটগার্টের হয়ে ১২১ ম্যাচ খেলে ৬৩ গোল করেছিলেন গোমেজ। বাভারিয়ানদের তারকাসমৃদ্ধ দলে এসে আরো বেশি গোল ক্ষুধা জেগে উঠেছিলে গোমেজের।
বায়ার্নের হয়ে প্রথম মৌসুমে মাত্র দশ গোল করলেও পরের মৌসুমেই ২৮ গোল করে বুন্দেসলিগার সেরা গোলদাতার পুরষ্কার জিতে নেন। সে বছর লিগ শিরোপা জিততেও সমস্যা হয়নি মিউনিখের ক্লাবটির৷ গোমেজ তখন হয়ে উঠেছিলেন অটো চয়েজ সদস্যদের একজন।
২০১২/১৩ মৌসুমে স্বপ্নিল সময় কাটায় বায়ার্ন মিউনিখ এবং মারিও গোমেজ। ঘরোয়া আধিপত্যের পাশাপাশি ইউরোপেও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে বাভারিয়ানরা। এছাড়া ডিএফবি পোকাল কাপও জিতে ট্রেবল জয় করে তাঁরা।
লিগ শিরোপা, চ্যাম্পিয়ন্স লিগসহ সম্ভাব্য সব জেতার পর নতুন কিছুর স্বাদের জন্য জার্মানি ছাড়েন গোমেজ। চলে আসেন ইতালিতে, ফিওরেন্তিনার সাথে চুক্তি করেন এই স্ট্রাইকার। এর আগে বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে ১১৫ বার মাঠে নেমে ৭৫ গোল করেছিলেন তিনি।
যা হোক, ইতালিতে আসার পর একেবারেই ভাল শুরু হয়নি মারিও গোমেজের। ইনজুরির কারনে বেশ লম্বা সময় ভুগতে হয় তাকে। অফ ফর্ম আর ইনজুরির কারনে তাকে ২০১৫ সালে লোনে তুর্কি ক্লাব বেসিকটাসে পাঠিয়ে দেয় ফিওরেন্তিনা। এখানে এসে পুনরায় নিজেকে ফিরে পান গোমেজ। তুর্কি ক্লাবটির হয়ে মাত্র ৩৩ ম্যাচে ২৬ গোল করেন তিনি। এর পরের বছরই ইতালিতে না ফিরে ঘরের ছেলে ঘরে চলে আসেন।
জার্মানির উলফসবার্গ ক্লাবের হয়ে নতুন অধ্যায় শুরু করেন তিনি। দুই বছর সেখানে খেলার পর চক্র সম্পন্ন করে শৈশবের স্মৃতিময় স্টুটগার্ট ক্লাবের জার্সি গায়ে জড়ান মারিও গোমেজ। আর তাদের দুই বছর সেবা দেয়ার পর নিজের পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে বুটজোড়া তুলে রাখার সিদ্ধান্ত নেন এই জার্মান। ক্লাব ক্যারিয়ারে ৪৫৬ ম্যাচে ২৩১ গোল, ২০১৩, ২০১৪ সালের সেই ইনজুরি না হলে হয়তো আরো বেশি গোল থাকতো তার নামের পাশে।
আরো একটা আক্ষেপের জায়গা সৃষ্টি করেছিল ইনজুরি। ইনজুরির কারনেই ২০১৪ সালের ব্রাজিল বিশ্বকাপের বিমানে উঠতে পারেননি। শিরোপা তো জার্মানি জিতেছে; ভাগ্যের সুদৃষ্টি থাকলে হয়তো ঘরে বসে নয়, নয়্যার ওজিল, ক্রুসদের সাথেই উৎসব করতেন গোমেজ।
এরপর অবশ্য ২০১৮ সালের বিশ্বকাপ খেলেছিলেন কিন্তু গ্রুপ পর্ব থেকেই জার্মানি বাদ পড়ে যাওয়ার হতাশায় আন্তর্জাতিক ফুটবলকে বিদায় বলে দেন মারিও গোমেজ। ২০০৭ সালে অভিষেক তারপর ২০১৮ তে অবসর, মাঝের এই এগারো বছরে জার্মানির জার্সিতে ৭৮ ম্যাচ খেলে ৩১ গোল করেছেন গোমেজ।
মারিও গোমেজ ছিলেন একজন সাহসী ফিনিশার, যে কোনো মূল্যে জালের দেখা পাওয়া ছিল তার একমাত্র লক্ষ্য, তার নেশা। এটি পুরোপুরি সত্য যে, তিনি বুন্দেসলিগার ইতিহাসে সবচেয়ে আন্ডাররেটেড তারকাদের একজন। লিগে ৩০০ ম্যাচে মোট ১৬৫টি গোল এবং ৪৮টি অ্যাসিস্ট করেছেন গোমেজ।
এটি তাকে লিগ ইতিহাসের সর্বকালের স্কোরার তালিকায় ১২তম স্থানে রেখেছে। মাত্র চারজন খেলোয়াড়ের গোল পার মিনিটের অনুপাত গোমেজের চেয়ে ভালো।
তবে মারিও গোমেজ জার্মানির সর্বকালের সেরাদের একজন কিনা সেই আলোচনা খুব কম দেখা গেলেও তিন বারের বুন্দেসলিগা বিজয়ীকে অবশ্যই তার প্রজন্মের সেরাদের একজন হিসেবে মনে রাখবে ভক্ত-সমর্থকরা।