সুনীল সাগরে মনোহরী গাভাস্কার

পরবর্তী কালের তারকারা যখন নভোশ্চরদের মত আপাদমস্তক সুরক্ষা নিয়ে ক্রিজে যান তখন ভাবলে সত্যিই অবাক লাগে নিজের টেকনিকের ওপর কতখানি ভরসা ও বিশ্বাস থাকলে খালি মাথায় প্রত্যেকটা কামানের গোলার মৃত্যুচুম্বন এড়িয়ে উইকেটে চাবুক হাতে রাজত্ব করা যায়। তাঁর দুর্ভাগ্য জীবনের অধিকাংশ সময়েই পিছনে তাকিয়ে দেখতে হয়েছে এক অগভীর ব্যাটিং লাইন আপকে, যেখানে তিনি প্যাভিলিয়নে তো দলের অর্ধেক শেষ! 

ভারতীয় আকাশে তখন সূর্যাস্ত হয়ে গিয়েছে, কিন্তু ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের আকাশে তখন গনগণে রোদ। ১৯৭১ সালে ভারতের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে সাবাইনা পার্কের প্রথম টেস্ট ড্র হয়েছে আর ত্রিনিদাদের দ্বিতীয় টেস্টে ওই গনগনে রোদের আগুনে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের গতির তেজে পোড়ানোর পরিকল্পনায় ভ্যানবার্ন হোল্ডার, গ্যারি সোবার্স এর ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

এমন সময়েই মঞ্চে আবির্ভাব অশোক মাঁকড় এর সঙ্গী হয়ে বছর বাইশের এক মারাঠি তরুণের। জ্যাক নোরিগা নামক এক অফ স্পিন বোলারের ঘাতক হয়ে ৬৫ রানে সেদিন ফিরলেও পরের দেড় মাস যা কীর্তিকলাপ সেই মারাঠি তরুণ করে গেলেন তাঁর অভিষেক সফরে তা রূপকথার থেকে কোনো অংশেই কম নয়।

দুর্দমনীয় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে সেই মারাঠি তরুণের নামের পাশে ৭৭৪ টা রান। সেই সফরে তাঁকে নিয়ে ক্যালিপসো গান বাঁধা ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের বিরুদ্ধে মোট ২৭ টেস্টে ২৭০০ রান সেই ধারা কেই বয়ে নিয়ে গেছে। পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধেও তাঁর ব্যাট যেন হয়ে উঠতো স্বাধীনোত্তর এক উন্নয়নশীল দেশের মাথা তুলে দাঁড়ানোর মাস্তুল।

কেমন ব্যাটসম্যান ছিলেন সুনীল মনোহর গাভাস্কার? নাহ, এমন এক ক্রিকেট ব্যক্তিত্ব, এমন এক ব্যাটসম্যান কে বাছাই করা শব্দ বন্ধে গাঁথা অসম্ভব। এ যেন ‘শেষ হইয়াও হইলো না শেষ জাতীয়’। এ সেই শিশু, যে রাতে ঘুমোতে যেত ব্যাট টাকে মাথার কাছে নিয়ে। এ সেই কিশোর যে ধৈর্য আর উইকেট এই দুটো হারানোকে চিরকাল ঘৃণা করে এসেছে।

এ সেই যুবক যাঁর ত্রুটিহীন একাগ্রতা, মনোসংযোগ দিয়ে বিপক্ষের গোলা বারুদের সামনে নিজের ঢাল ব্যাটটা নিয়ে পড়ে থেকেছে, তাকে এককথায় ব্যাখ্যা করবে কোন কলম? যে সংকল্প এই মানুষটিকে সুদৃঢ় করেছে, শৃঙ্খলা গড়েছে চরিত্র আর নিষ্ঠায় তৈরী হয়েছে ভিত, এমন ‘বিস্তৃতি’ আর ‘উচ্চতা’ কে ব্যাখ্যা করবে কোনো পন্ডিত?

এটা বুঝতে কারোর অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে ব্যাটসম্যান খালি মাথায় ক্যারিবিয়ান পেস ব্যাটারি – হোল্ডিং, মার্শাল, গার্নার, রবার্টসদের তাণ্ডব সামলেছেন। ইংল্যান্ডের উইলিস, বোথাম বা বিশ্বত্রাস অস্ট্রেলিয়ার লিলি-টমসন, পাকিস্তানের ইমরান-সরফরাজ বা নিউজিল্যান্ডের রিচার্ড হ্যাডলির নতুন বলের সামনে বুক চিতিয়ে ঝুড়ি ঝুড়ি রান করে গেছেন।

তিনি আর যেই হোন সবার থেকে কিছুটা স্পেশালই। স্পেশাল মানুষ টাই আবার ব্যাঙ্গালোরের জল্লাদসম পিচে যেখানে দুই পাক স্পিনার তৌসিফ আহমেদ ও ইকবাল কাশিম ২২ গজের নির্মম ভূখণ্ডে প্রায় সমকোণে বল টার্ন করাচ্ছিলেন সেই বধ্যভূমিতে টেকনিক, টেম্পারমেন্ট, সাহস, সংযম এর মূর্ত প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল ৩২৩ মিনিট লড়াই করে ৯৬ রানের ইনিংস টা। না, তিনি সেদিন জেতাতে পারেননি দেশকে।

কিন্তু, যে সাহস ও লড়াইয়ের প্রতিচ্ছবি দেখিয়েছিলেন জীবনের শেষ টেস্টে সেটাই ছিল তার আগের ১৬ বছর ধরে একই ভাবে হিসেবি হয়ে চলা এক নিম্ন মধ্যবিত্ত বাড়ির কর্তার ব্যাটন নিয়ে চলার প্রতীক। একটা দুর্বল দেশের পক্ষে ব্যাটিং ওপেন করে একটা ‘স্টেডি স্টার্ট’ দেওয়ার মাধ্যমে পরের ব্যাটসম্যানদের মধ্যেও সাহস সঞ্চয় করার কাজটাও ধারাবাহিক ভাবে করতে হয়েছে তাঁকে।

একটু বেহিসেবি আর অসতর্ক হলেই দেশ পড়বে বিপাকে, চিন্তার এই পাহাড় নিয়ে বিলাসী স্ট্রোক আর অ্যাডভেঞ্চারিজমকে বিসর্জন দিয়ে পড়ে থাকতে হয়েছে তাঁকে। হাতের ব্যাট কখনো প্রতিবাদ আবার কখনো তাঁর প্রতিষ্ঠার লড়াই।

পরবর্তী কালের তারকারা যখন নভোশ্চরদের মত আপাদমস্তক সুরক্ষা নিয়ে ক্রিজে যান তখন ভাবলে সত্যিই অবাক লাগে নিজের টেকনিকের ওপর কতখানি ভরসা ও বিশ্বাস থাকলে খালি মাথায় প্রত্যেকটা কামানের গোলার মৃত্যুচুম্বন এড়িয়ে উইকেটে চাবুক হাতে রাজত্ব করা যায়। তাঁর দুর্ভাগ্য জীবনের অধিকাংশ সময়েই পিছনে তাকিয়ে দেখতে হয়েছে এক অগভীর ব্যাটিং লাইন আপকে, যেখানে তিনি প্যাভিলিয়নে তো দলের অর্ধেক শেষ!

১৯৭১ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে গোটা সিরিজে ৭৭৪ দিয়ে শুরু করে। ওল্ড ট্রাফোর্ডের ১০১, অকল্যান্ডের ১১৬, পোর্ট অফ স্পেনের ২২০, ওভালের ২২১,পার্থের ১২৭, করাচির ১৩৭ বা ব্যাঙ্গালোরের ২৩৬ – কত অমর, মহাকাব্যিক, মাস্টারপিস ইনিংস তাঁর ব্যাটে।

টেস্টে প্রথম ১০০০০ রান, ব্র্যাডম্যানের ২৯ সেঞ্চুরির পাহাড় প্রথম টপকানো এগুলো বোধহয় ‘সানি’কেই মানায়। ফিল্ডার গাভাস্কার আর ধারাভাষ্যকার গাভাস্কার ও কম আকর্ষণীয় নন, টেস্ট ক্রিকেটে তাঁর ১০৮ ক্যাচ বা শারজায় ১৯৮৫’র ভারত-পাক একদিনের ম্যাচে তাঁর তিনটি অবিস্মরণীয় ক্যাচ ফ্রেমে বন্দি হয়ে থাকার মতনই। ছিলেন অসাধারণ ক্ষুরধার ক্রিকেট মস্তিস্ক, কমেন্ট্রি বক্সে বসে তাঁর সূক্ষাতিসূক্ষ বিশ্লেষণ সেই আভাস এখনো দিয়ে যায়।

‘নীল আকাশের এই ধ্রুবতারা’ সম গাভাস্কার তাঁর মনোহরী ব্যাটিংয়ে যেভাবে ১৭ বছর বিশ্বক্রিকেটকে মোহমুগ্ধ করেছিলেন। তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। এক গরিব, স্বপ্ন দেখতে শেখা দেশের তরুণদের কাছে রোলমডেল ছিলেন গাভাস্কার। আজকের টি-টোয়েন্টি’র উড়নচণ্ডী ব্যাটধারীরা ভাবতেই পারেননা, উচ্চাঙ্গের ক্রিকেট শিক্ষা ও চর্চার বিষয়টা ঠিক কী!

তাঁর ১২৫ টেস্ট আর ১০৮ একদিনের ম্যাচের মধ্যে রয়ে গেছে ব্যাটসম্যানশিপ, স্পোর্টসম্যানশিপ, ক্যাপ্টেনশিপের কত উজ্জ্বল রঙ, উজ্জ্বল সুর, ছন্দময় কবিতা, নিখুঁত বিজ্ঞান – সবই যেন জ্যামিতিক পারফেকশনে। বড় মানুষ হয়েও থেকেছেন মাটির কাছাকাছি। এটাও বোধহয় গাভাস্কারীয় শিক্ষা, বড় হতে গেলে বিনম্র হতে হয়।

বড় হওয়ার সাথে বিনম্র হওয়ার কোনো বিরোধ নেই, এটাই সুনীল মনোহর গাভাস্কার। যুগে যুগে গাভাস্কার বোধহয় একজনই আসেন যিনি শত প্রতিকূলতার মধ্যেও মাস্তুলটা তুলে ধরতে পারেন সেই নিম্ন মধ্যবিত্ত কর্তাটির মত। যাঁর জন্য ক্যালিপসো এর মূর্ছনায় লর্ড রিলেটর গেয়ে উঠতে পারেন, ‘ইট ওয়াজ গাভাস্কার, দ্য রিয়েল মাস্টার, জাস্ট লাইক আ ওয়াল!’

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...