ক্যান্ডি শহরে তখন রাত নেমেছে।
ম্যাচ শেষ করে ইউরোপিয়ান ধাঁচের এই শহর চষে বেড়াচ্ছিলাম আমরা দুটো ভাতের জন্য। কলম্বোতে যা হোক, ভাতের হোটেল মিলেছিলো। ক্যান্ডিতে এরা মনে হয় ফাস্ট ফুড খেয়েই বেঁচে থাকে। সেই ফাস্টফুডের একটা দোকানে গিয়েই মুষ্টি পরিমান ভাত পেলাম আমরা ‘রাইস’ বলে। তাই খেয়ে ঢেকুর তুলছিলাম। এর মধ্যে দেখি কয়েক জন ক্রিকেটার।
ম্যাচ শেষে হোটেলে গিয়ে তরতাজা হয়ে এরাও বেরিয়েছেন বুঝি শহর দেখতে।
ক্রিকেটারদের দেখে সবাই এগিয়ে গেলো; একটু কথাবার্তা বলে যদি কিছু নিউজ পাওয়া যায়। এক পাশে দেখি শশ্রুমিন্ডিত ভদ্রলোক এক দাঁড়িয়ে কী একটা স্টেশনারি জিনিস দেখছেন। মুখটার দিকে তাকাতে চিনলাম-আমাদের সাকলায়েন মুশতাক।
এক পেয়ে ভাবলাম, আমিও না হয় দু লাইন কথা বলে ফেলি।
কাছে গিয়ে পরিচয় দিতে গড় গড় করে কথা শুরু করলেন। দু-এক মিনিটের মধ্যে আমার স্টোরি দাঁড়িয়ে গেল। আমি সটকে পড়বো ভাবছিলাম। বললেন, ‘ব্যস্ত না হলে চলো হাঁটি।’
সৌজন্য রক্ষা করতে রাজী হয়ে গেলাম।
আমরা হাঁটছি। অচেনা ক্যান্ডির অচেনা রাস্তা ধরে হালকা শীতের কোমলতার মধ্যে বিড়ালের মতো করে হাঁটছি। আর সাকলাইন মুশতাকের কথা শুনছি। তিনি মন্ত্রমুগ্ধের মত কথা বলে চলেছেন। নিজের খেলোয়াড়ী জীবনের কথা, জীবনে পাওয়া বা না পাওয়ার কথা। কখনো যেন আমরা জীবনের পরের জীবন, বেঁচে থাকার অর্থ, মানব জীবনের সার্থকতা এসব নিয়ে আলাপ শুরু করে দিয়েছি। একটা সময় আমি নিজেকে একটু পেছনে আবিষ্কার করলাম।
সামনে চেয়ে দেখলাম, সফেদ পোশাক পরা সাকলাইন মুশতাক একটু সামনে হাঁটছেন আর দুই হাত উচু করে আমাকে বা যে কাউকে বলে চলেছেন, ‘জীবনটাকে কাজে লাগানো উচিত, মেরে ভাই। এই জীবন আর আসবে না।’
বলে যখন পেছন ফিরে তাকালেন তখন তার চোখ একটু ভেজা।
সেই রাতে আমি আবিষ্কার করলাম অন্য এক সাকলাইন মুশতাককে। কৈশোর থেকে টেলিভিশনে দেখেছি তাকে। দেখেছি কেমন করে ঘুর্নি বলের জাদুতে ঘায়েল করেন বোলারদের। ঢাকায় বেশ কিছুদিন ধরে দেখেছি কেমন করে গড়ে পিটে মানুষ করতে পারেন তরুণ স্পিনারদের। এই রাতে আমি দেখলাম সেই মানুষটার ভেতরের অন্য এক মানুষ। যে এই জগতের বাইরের অনেক কিছুতে মগ্ন হয়ে আছে এবং নিজের সার্থকতা খুঁজে বেড়াচ্ছে মানুষের মধ্যেই।
সাকলায়েন মুশতাক বা মুশতাক আহমেদ বরাবরই আমার খুব পছন্দের চরিত্র।
স্পিনারদের প্রতি চিরকালই আমার বাড়তি একটা টান আছে। তারওপর সাকলায়েন ছিলেন অবিশ্বাস্য এক ট্রেন্ড সেটার। অফস্পিন ব্যাপারটাকে সত্যিই ‘খতরনাক’ একটা শিল্পে পরিণত করেছিলেন।
অফ স্পিনের অনেক ভেরিয়েশন সাকলায়েনের আগেও দেখা গেছে। কিন্তু তিনি প্রথম অফ স্পিনে উল্টো ঘোরা বলটার আমদানি করলেন। মানে লেগ স্পিনাররা যেটা গুগলি করেন, সেটার অফস্পিন ভার্শন। তিনি এটার নাম দিলেন দুসরা। আর এটা দিয়ে মোটামুটি বিশ্বজয় করে ফেলেছিলেন। ভারতের বিপক্ষে চেন্নাইতে পাকিস্তানকে ১২ রানে জেতানো সেই ম্যাচ নিশ্চয়ই সাকলাইনের ক্যারিয়ারে হাইলাইটস হয়ে থাকবে।
হঠাৎ করেই নিজের ধার হারিয়ে ফেলা, শোয়েব মালিকের উত্থান এবং পাকিস্তানী ম্যানেজমেন্টের খানিকটা খামখেয়ালী মিলিয়ে খুব অল্পতেই সাকলাইনের ক্যারিয়ারটা শেষ হয়ে গেছে। ৪৯ টেস্টে ২০৮ উইকেট এবং ১৬৯ ওয়ানডেতে ২৮৮ উইকেট সাকলাইনকে বোঝানোর জন্য ঠিক যথেষ্ট না।
আসলে ক্রিকেট পরিসংখ্যান দিয়ে এই মানুষটাকে বুঝতে যাওয়াটাই ভুল।
কিছুদিন বাংলাদেশের কোচ ছিলেন বলে এখনও বাংলাদেশ দল সম্পর্কে বলতে গিয়ে ‘আমাদের দল’ বলেন। বাংলাদেশ থেকে ফোন পেলে সাত সকালে খাঁটি বাংলায় বলেন, ‘কেমন আছেন?’ নিজেই জিজ্ঞেস করেন যে, দলের সবাই কেমন আছে। সাংবাদিকদের খোঁজ নিতেও ভুল করেন না।
এই মানুষটাকে ক্রিকেট দিয়ে মেপে কী আটকানো যাবে!