জার্মানির সর্বকালের সেরা একাদশ

বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম পরাশক্তি জার্মানি। চারবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা যেন এক মূর্তিমান আতঙ্ক। পৃথিবীর ফুটবল খেলুড়ে যেকোন দল জার্মানির বিপক্ষে খেলতে নামার আগে কয়েক রাতের ঘুম হারাম করে তাদেরকে রুখে দেবার পরিকল্পনা নিশ্চয়ই করে। অদূর ভবিষ্যতে ব্রাজিল জাতীয় দল সাক্ষী হয়েছিল তাঁদের ধ্বংসযজ্ঞের। বিশ্বকাপের মঞ্চে ব্রাজিলের মাঠেই তাদেরকে নাকানিচুবানি খাইয়ে ৭-১ এর বিশাল জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে জোয়াকিম লো এর নেতৃত্বের জার্মানি। সেবারের বিশ্বকাপটাও জিতেছিল জার্মানি।

আজ ‘খেলা ৭১’ জার্মানির মত এক ফুটবল পরাশক্তির সর্বাকালের সেরা একাদশ নিয়ে হাজির আবারও। এবারের ফরমেশন ৪-৩-৩। আসলে জার্মানি তাঁর ইতিহাসে এত সব আলোচিত ফুটবলারের জন্ম দিয়েছে যেখান থেকে সেরা ১১ জনকে বের করা খুব কঠিন। চলুন সেই কঠিন কাজটাই শুরু করা যাক।

  • গোলরক্ষক: ম্যানুয়েল ন্যয়ার

গোলরক্ষকের দায়িত্ব প্রতিপক্ষের শট রুখে দেওয়া। তবে সম্ভবত ম্যানুয়েল ন্যয়ার এই তথাকথিত দায়িত্বের অবসান ঘটিয়েছেন। একজন গোলরক্ষক শুধু শট ঠেকিয়ে দেবার দায়িত্ব পালন করবেন কেন? তিনিও একাদশের একজন। তিনিও আক্রমণে সহয়তা করবেন, সহয়তা করবেন রক্ষণে। এই মতাদর্শের বা খেলার ধরণের প্রবর্তক কিংবা প্রচারক ধরা যেতে পারে ন্যয়ারকে।

ন্যয়ার গোলপোস্ট ছেড়ে যথাসময়ে এগিয়ে এসে যেমন রক্ষণে ভূমিকা রাখেন ঠিক তেমনি নির্ভুল পাস বাড়িয়ে দিতে পারেন মধ্য মাঠেরও আরও উপরে। সাহসিকতার সাথে যে কোন পরিস্থিতি নিজের আয়ত্বে নিতেও তিনি অনবদ্য। আর গোলবারে তিনি যেন আস্ত এক দেয়াল। তাঁকে ফাঁকি দিয়ে গোল করা এক প্রকার অসাধ্য। তাঁর মত কম্পেক্ট একজন গোলরক্ষকের সন্ধানে কত যুগ অপেক্ষায় বাকি দলগুলো।

তবে ন্যয়ারকে জার্মানির সর্বকালের সেরা একাদশে রাখতে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন জার্মানির ফুটবলের আরেক অসাধারণ গোলরক্ষক অলিভার কান। তিনিও ছিলেন চীনের দূর্গের সমান অটল। তবে ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ জয়ে ম্যানুয়েল ন্যয়ারের ভূয়সী পারফরমেন্স এবং ব্যক্তিগত অর্জন হিসেবে গোল্ডেন গ্লাভস জেতা ন্যয়ারকে জায়গা করে দিয়েছে। ২০০৯ থেকে এখন অবধি ১০৬ ম্যাচে জার্মান গোলবারের এই অতন্দ্র প্রহরীতেই তাই ভরসা রাখছে খেলা ৭১।

  • রক্ষণভাগ: ফিলিপ লাম, ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার, ইয়ুর্গেন কোহলার ও পল ব্রেইটনার  

রক্ষণে বেকেনবাওয়ার কিংবা ফিলিপ লাম যে কারো সেরা একাদশে থাকবে সে বিষয়ে তর্কের সৃষ্টি হবার কারণ খুব একটা আছে বলে মনে হয় না। তাই এদেরকে নিয়েই রক্ষণ সাজানো, তাদের সাথে থাকছে আরও দু’জন সেরাদের সেরা।

ডান পাশ থেকেই শুরু করা যাক। রক্ষণের ডান পাশের দায়িত্ব পিলিপ লাম ছাড়া দেবার মত বলিষ্ঠ কাঁধ জার্মানির ফুটবলে খুব কমই আছে। গঢ়নের কিছুটা খর্বাকৃতির হলেও তিনিই যে সেরা রাইট ব্যাক তাতে সন্দেহ নেই। মাঠের যেকোন পজিশনে সাবলীলভাবে খেলতে পারার দক্ষতা আছে লামের।

এছাড়াও তাঁর ফুটবলীয় শৈলী আর নেতৃত্ব গুণ তাঁকে এই সেরাদের সেরা তালিকায় রাখার দাঁড়িপাল্লায়, একটা দিক তাঁর দিকে ঢলে পরে পূর্ণ সমর্থন জানায়। তাছাড়া জার্মানির হয়ে ১১৩ ম্যাচ খেলে ২০১৪ এর বিশ্বকাপ জয়ে তিনি দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন সামনে থেকেই। সেই দিক বিবেচনায়ও তিনি সেরাদের সেরা একাদশে জায়গা করে নিয়েছেন।

লামের পাশে সেন্ট্রাল ডিফেন্সে থাকবেন ইয়ুর্গেন কোহলার। ১৯৯০ বিশ্বকাপ জয়ী জার্মানি দলের রক্ষণের গুরুদায়িত্ব পালন করা কোহলার হতে পারেন বেকেনবাওয়ারের যোগ্য সঙ্গী। তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ, তিনি খুবই ঠান্ডা মাথার একজন ডিফেন্ডার ছিলেন তাঁর সমসাময়িক সময়ে।

তিনি অপেক্ষা করতেন প্রতিপক্ষের ভুল করবার কিংবা মনোযোগ একটু নড়বড়ে হবার। তারপর ছোঁ মেরে বল কেড়ে নিতেন। এছাড়াও তাঁর পিন পয়েন্ট স্লাইডিং ট্যাকেলে যে কত আক্রমণ তিনি নসাৎ করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। জার্মানির হয়ে ১০৫ ম্যাচে রক্ষণের ভার সামলেছেন তিনি। বিশ্বকাপের পাশাপাশি ১৯৯৬ এর ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশীপ শিরোপা জয়ে রেখেছিলেন তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা।

ফাঞ্চ বেকেনবাওয়ার ব্যতীত জার্মানির রক্ষণ কল্পনা করা যেমন বোকামি, তেমন তাঁকে অবমাননা করার শামিল। জার্মানির ফুটবলের মেগাস্টার কিংবদন্তি বেকেবাওয়ার ছিলেন অসাধারণ ধৈর্য্যের অধিকারি। তিনি সর্বপ্রথম কোন ডিফেন্ডার হিসেবে প্রমাণ করেছিলেন যে রক্ষণভাগের খেলোয়াড় হতে শুধু যে শারীরিক শক্তি লাগে তা নেহায়েত একটি মিথ।

শারীরিক সক্ষমতার পাশাপাশি ধৈর্য্য এবং একগ্রতা দিয়েও প্রতিপক্ষের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া যায় বল। রক্ষণভাগের খেলোয়াড় হয়েও মাঝমাঠ বরাবর বল নিয়ে দূর্বার গতিতে ছুটে চলা তাঁকে ১৯৬৬ এর বিশ্বকাপে তৃতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা হতে সহয়তা করে। পশ্চিম জার্মানির হয়ে ১৯৭৪ বিশ্বকাপ জেতা দলের অধিনায়ক ছিলেন তিনি এর আগে অবশ্য ১৯৭২ এর ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ জয় করেছেন ফাঞ্জ বেকেনবাওয়ার।

এবার লেফটব্যাকের পালা। লেফটব্যাকে ১৯৭৪ এ বিশ্বকাপ জয়ী দলে বেকেনবাওয়ারের সতীর্থ পল ব্রেইটনারকে দায়িত্ব দেওয়া সবচেয়ে নিরাপদ ও কার্যকরী হতে পারে। রক্ষণটা ঠিকঠাক সামলে নিয়ে তিনি তাঁর ক্ষিপ্রতা কাজে লাগিয়ে বল নিয়ে ছুটে যেতেন প্রতিপক্ষের গোলবারের দিকে।

ব্রেইটনার প্রতিপক্ষের মধ্যমাঠ ও রক্ষণের মাঝে মুহুর্তেই ছেঁদ করে ফেলতেন তাঁর ক্ষিপ্রতা দিয়ে। বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে ৮০ মিটার দৌড়ে একক প্রচেষ্টায় করা তাঁর গোলটা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে চিরকাল।

  • মধ্যমাঠ: লোথার ম্যাথিউস, বাস্তিয়ান শোয়েনস্টেইগার ও টমাস মুলার

৪-৩-৩ ফরমেশনে অভিজ্ঞতা কিংবা খেলার মানের বিচারে লোথার ম্যাথুস মাঠের ডান কিংবা বাম পাশ যেকোন পজিশনে খেলার জন্য যোগ্য এবং তাঁর সঙ্গী হিসেবে থাকবেন বাস্তিয়ান শোয়েনস্টেইগার আর অ্যাটাকিং মিড পজিশনে টমাস মুলারের বিকল্প নেই।

লোথার ম্যাথুস ছিলেন একজন বক্স-টু-বক্স ডিফেন্ডার। পুরো মাঠ জুড়ে দেখা মিলত লোহার ম্যাথুসের। পাঁচটি বিশ্বকাপেও অংশ নিয়েছিলেন তিনি পশ্চিম জার্মানির হয়ে। এর মধ্যে কেবল ১৯৯০ এর বিশ্বকাপের মুকুট উঠেছিল দলসহ তাঁর মাথায়।

পরিশ্রমী এই ফুটবলার ১৯৮০ এর ইউরোও জিতেছিলেন। এছাড়া দলের হয়ে ১৫০ ম্যাচ খেলে করেছিলেন ২৩ গোল। বিশ্বকাপের পঁচিশ ম্যাচে অংশগ্রহণ করে নিজের করে নিয়েছেন এক অনন্য রেকর্ড।

বাস্তিয়ান শোয়েনস্টেইগার জার্মানির ফুটবলের আরেক উজ্জ্বল নক্ষত্র। মিডফিল্ড মাস্টারমাইন্ড আখ্যা পাওয়া শোয়েনস্টাইগার জার্মানির হয়ে খেলেছেন ১২১ ম্যাচ করেছেন ২৪ গোল।

তবে তিনি তাঁর বল পাসের দক্ষতা ও পজিশন জ্ঞান কাজে লাগিয়ে আক্রমণ সাজাতেই বেশি মনোযোগী ছিলেন তাঁর সময়ে। মধ্যমাঠের যেকোন পজিশনে খেলতে সক্ষম শোয়েনস্টাইগার ২০১৪ এর বিশ্বকাপ জয়ে ছিলেন জার্মানির অন্যতম এক কারিগর।

মাত্র ২১ বছর বয়সে বিশ্বকাপের গোল্ডেন বুট জেতা টমাস মুলার থাকবেন এটাকিং মিডফিল্ডে। তিনি জার্মানির সর্বকালের সেরা একাদশে একজন প্লেমেকারের ভুমিকা পালন করতে পারবেন বলে আশা করা যায়। ২০১০ এ গোল্ডেন বুট জেতা মুলার শুধু যে ২০১৪ তে এসে বিশ্বকাপ জেতা দলের সেরা খেলোয়াড় ছিলেন তা নয়।

তিনি পুরো টুর্নামেন্টে জুড়েই ছিলেন সেরাদের একজন। তাঁর উপস্থিত বুদ্ধি এবং কঠিন মনোবল কাঁপন সৃষ্টি করতে পারে প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগের খেলোয়াড়দের মনে। তবে এই একাদশে তিনি ফলস নাইন রোলেও দিব্যি মানিয়ে নিতে পারবেন।

  • আক্রমণভাগ: মিরোস্লাভ ক্লোসা, জার্ড মুলার ও জাপ হেইঙ্কস 

সেরা একাদশের আক্রমণভাগের দায়িত্ব তো সেরাদের উপরই বর্তায়। তাইতো এই সেরাদের একাদশের আক্রমণে ডানপাশে জায়গা করে নিয়েছেন মিরোস্লাভ ক্লোসা। বিশ্বকাপ ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলদাতা মিরোস্লাভ ক্লোসা একজন  নি:স্বার্থ খেলোয়াড় হিসেবে গোল যেমন আদায় করে নিতে পারবেন এই দলের হয়ে তেমনি সতীর্থদের দিয়ে গোল করিয়ে নিতে পারবেন সমান তালে।

তাই রাইট উইং থেকে আক্রমণের দায়িত্ব তাঁর উপর ছেড়ে দিয়ে স্ট্রাইকারের সন্ধান করার পালা। তবে ক্লোসা কিন্তু দ্বিতীয় স্ট্রাইকার হিসেবেও বেশ কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারবেন দলের হয়ে, তিনি এমনটা করেও এসেছেন।

জার্ড মুলার জার্মানির ইতিহাসের সেরা একাদশের অটোমেটিক চয়েজ। স্ট্রাইকার হিসেবে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। জার্মানির হয়ে ম্যাচের থেকে গোলের সংখ্যা বেশি জার্ড মুলারের। ৬৮ গোল করেছেন তিনি ৬২ ম্যাচের বিপরীতে। জাত স্ট্রাইকার।

তিনি অতি দানবীয় কিছু করতেন না কিংবা খুব বেশি ক্যারিশম্যাটিক স্বভাবও তাঁর ছিল না। তবুও দলের প্রয়োজনে সব সময় এগিয়ে এসেছেন তিনি। ১৯৭৪ বিশ্বকাপ জয়ী জার্ড মুলার তাই জার্মানির সর্বকালের সেরা একাদশের স্ট্রাইকারের ভূমিকায় থাকছেন।

আক্রমণভাগের বামের দিকটায় জার্মানির এই সেরাদের সেরা একাদশে ভরসার প্রতীক হতে পারেন জাপ হেইকনস। বুন্দেসলিগার চতুর্থ সর্বোচ্চ গোলদাতা হেইকনস ১৯৭৪ এ বিশ্বকাপ জেতার পাশাপাশি ১৯৭২ এর ইউরো জয়ী দলের সদস্য ছিলেন।

মূলত স্ট্রাইকার হিসেবে খেললেও তাঁকে সর্বকালের সেরা একাদশে সেই রোলে দেওয়া গেলো না শুধুমাত্র জার্ড মুলারের গোল করার অভাবনীয় দক্ষতার বিচারে। তবে হেইকনসও সমানতালে গোল কর‍তে সচেষ্ট। মাঠের বাম দিকটা থেকে আক্রমণ হানাবার দায়িত্ব তাঁকে দিয়েই ইতি টানছি জার্মানির সর্বকালের সেরা একাদশের।

মতবিরোধ থাকাটা স্বাভাবিক। আপনাদের ভিন্ন সব অভিমতের প্রত্যাশায় থাকে খেলা ৭১। আর সত্যি কথা হল, এরকম একাদশের ক্ষেত্রে একটু তর্ক-বিতর্ক হবেই!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link