ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) – আধুনিক ক্রিকেটে এর চেয়ে বড় বিপ্লব সম্ভবত আর আসেনি। তবে, এটা ঠিক যে – এই বিপ্লবকে ঘিরে যেমন আলোচনা হয় বিস্তর, তেমনি অজস্র সমালোচনাও হয়। আইপিএলে যেমন ক্রিকেট আছে – তেমনি আছে সিনেমাও। নিন্দুকেরা অবশ্য বলেন – এখানে আরেকটা ‘সি’ আছে। আর তা হল ‘ক্রাইম’।
আইপিএল ও ক্রাইম – এই প্রসঙ্গেই যখন আলাপ তখন যে কেউই আসলে ২০১৩ সালের আসরের স্মৃতিচারণা করতে বাধ্য। সেবারই ফ্র্যাঞ্চাইজি ভিত্তিক এই ক্রিকেট টুর্নামেন্টে সপ্তম আসরে দানা বেধেছিল আসরটির সবচেয়ে বড় বিতর্কের। শুধু আইপিএলই নয় – ক্রিকেটের ইতিহাসেও এমন বিতর্ক ও সমালোচিত স্ক্যান্ডালের দেখা খুব বেশি মেলেনি।
ঘটনার সূত্রপাত রাজস্থান রয়্যালসের তিন ক্রিকেটারকে ঘিরে – ভারতের বিশ্বকাপজয়ী ফাস্ট বোলার শ্রীশান্ত, আঙ্কিত চাভান ও অজিত চান্ডিলা। তিনজনকেই গ্রেফতার করে দিল্লী পুলিশ। অভিযোগ তিনজন বাজিকরদের সাথে জড়িয়ে স্পট ফিক্সিং কেলেঙ্কারিতে নাম লিখেছিয়েন। কেঁপে ওঠে ক্রিকেট বিশ্ব। বিশেষ করে শ্রীশান্তের মত প্রতিষ্ঠিত একজন ক্রিকেটারের এই তালিকায় নাম দেখাটা ছিল খুবই হতাশাজনক, মাত্র বছর দুয়েক আগেই তিনি ভারতের হয়ে মুম্বাইয়ের ওয়াঙখেড়ে স্টেডিয়ামে জিতেছেন বিশ্বকাপের ট্রফি।
তবে, ঘটনা এখানেই শেষ নয়। এক সপ্তাহ বাদে গ্রেফতার হন গুরুনাথ মেইয়াপ্পান। তিনি হলেন চেন্নাই সুপার কিংস দলের অধ্যক্ষ। মুম্বাই পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে প্রতারণা ও জালিয়াতির মামলায়। পুলিশ এটাও জানায় যে, তাঁর বিরুদ্ধে বাজিকরদের কাছে তথ্য পাচারের অভিযোগও আছে। ফিক্সিং বিষয়ে তাঁর ফোনালাপও ফাঁস হয়ে যায়। বিন্দু দারা সিং-সহ বলিউডের কয়েকজন অভিনেতার বিরুদ্ধেও বুকিদের সাথে যোগাযোগের খবর পাওয়া যায়।
আর এই গুরুনাথের আরেকটা পরিচয় আছে। তিনি হলেন তৎকালীন বোর্ড অব কনট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়ার (বিসিসিআই) সভাপতি এন শ্রীনিবাসনের মেয়ের জামাই। এই শ্রীনিবাসন হলেন ইন্ডিয়া সিমেন্টের কর্ণধার। আর ইন্ডিয়া সিমেন্ট হল চেন্নাই সুপার কিংসের কর্ণধার। এই চেন্নাইয়ের হয়েই খেলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি কিংবা সুরেশ রায়না মত তারকারা।
ভারত জুড়ে শ্রীনিবাসনের পদত্যাগের দাবি ওঠে। তবে, শ্রীনিবাসন ছিলেন অনঢ়। তবে, ক্রমেই চাপ বাড়ছিল। তবে, গণমাধ্যম ও মিডিয়া ও সরকারী চাপের মুখে তিনি সরে যেতে বাধ্য হন। সে বছর দুই জুন জগমোহন ডালমিয়া অন্তবর্তীকালীন সভাপতি মনোনিত হন। যদিও, ২৭ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্ডের আদশে আবারো ডালমিয়াকে সরতে হয়। আট অক্টোবর থেকে সুপ্রিম কোর্টের অনুমতির ভিত্তিতে আবারো দায়িত্ব নেন শ্রীনিবাসন।
টালমাতাল এই পরিস্থিতিতে বোর্ড ঘটনার তদন্তের জন্য একটা কমিটি গঠন করে। তবে, তাঁদের তদন্ত শুরু হওয়ার আগেই ফাটে নতুন বোমা। দিল্লী পুলিশ জানায় বেটিংয়ে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন রাজস্থান রয়্যাল ফ্র্যঞ্চাইজির মালিক রাজ কুন্দ্রা। রাজ কুন্দ্রা হলেন বলিউড তারকা শিল্পা শেঠির স্বামী। সেজন্যই একটা সময় রাজস্থানের ম্যাচ হলেই গ্যালারিতে হাজির থাকতেন শিল্পা।
এরপর আর রাজস্থানের সাথে থাকতে পারেননি রাজ কুন্দ্রা কিংবা শিল্পা শেঠি। রাজ কুন্দ্রাদের নিষিদ্ধ করে বিসিসিআই। মালিকানা কেড়ে নেয় আইপিএলের গভর্নিং কাউন্সিল।
তিন ক্রিকেটারকেও নিষিদ্ধ করে বিসিসিআই। এর মধ্যে চাভান নিজের দোষ স্বীকার করে নেন। চান্ডিলা এর মধ্যে অন্য অনেক ক্রিকেটারকেই জড়াতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, তাঁর চেষ্টা ধোপে টেকেনি। শ্রীশান্ত আর কখনোই আইপিএল খেলতে পারেননি। লম্বা সময় নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে তিনি আবারও সম্প্রতি ফিরেছেন ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটে।
সেই ঘটনায় দিল্লী পুলিশ মোট ১৭ জনকে গ্রেফতার করেছিল। সেখানে আন্ডারওয়ার্ল্ডের হাত ছিল বলেও তাঁরা জানায়। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি থেকে পাকিস্তানি আম্পায়ার আসাদ রউফকে সরিয়ে নেয় আইসিসি। কারণ, মুম্বাই পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা ছিল স্পট ফিক্সিংয়ে এই আম্পায়ারও জড়িয়েছিলেন।
সেই সময় থেকে বিসিসিআই ও আইসিসি ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের ফিক্সিং ও স্পট ফিক্সিং নিয়ে বেশ তৎপর হয়। এরপর এরকম অভিযোগ তাই উঠেছে সামান্যই। তবে, কথায় আছে না – ‘কয়লা ধুলে ময়লা যায় না।’ তাই আজও নানারকম সন্দেহ উঁকি দেয়। কোনো ম্যাচ একটু জমজমাট হলেই দর্শকমহলে ‘স্ক্রিপটেড…স্ক্রিপটেড’ বলে রব ওঠে।
সেই সময় কোনো কিছু নিয়েই একদম মুখ খোলেননি ভারতের তৎকালীন অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি। ২০১৯ সালে তিনি বলেন, ‘২০১৩ সালটা আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়। আগে পরে কখনোই আমি ওই সময়ের মত এতটা ভেঙে পরিনি। এর কাছাকাছি পরিমান বাজে সময় এসেছিল ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে। সেবার আমরা গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ পরি। খারাপ খেলেছিলাম বলেই বাদ যেতে হয়। কিন্তু ২০১৩ সালের ব্যাপারটা ছিল পুরো ভিন্ন। লোকজন শুধু ফিক্সিং আর স্পট ফিক্সিং নিয়ে কথা বলতো। ওই সময় যেন আর কিছু নিয়ে কথা বলতেই মানুষ ভুলে গিয়েছিল।’