১৯৮৮ সালের সাত মার্চ। মধ্য বসন্তের ইডেন পুরোপুরি ভরা না হলেও ক্লাবহাউস, এল ব্লকের কিছুটা আর বি ব্লক মিলিয়ে কিছুটা। খেলা মোটামুটি গড়িয়ে গেছে, দুপুর পেরিয়ে প্রায় বিকেল। তিনি নামলেন। মাথায় একটা গাঢ় নীল রঙের হেলমেট। হেঁটে চলেছেন ক্রিজের দিকে, একবার আকাশের দিকে, সূর্যের দিকে তাকালেন। গার্ড নিলেন, লেগ স্টাম্প।
ব্যাটের নিচটা দিয়ে, ব্যাটিং শ্যু-র ডগাটা দিয়ে সামান্য ঘষে নিয়ে দাগ স্পষ্ট করলেন। তারপর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে ঈষৎ ঝুঁকে ব্যাটের উপর ভর দিয়ে পিঠ সোজা রেখে দাঁড়ালেন। ব্যাট তুললেন, নামালেন, তুললেন। পুরো পথটা দিকনির্দেশ করল গালি থেকে ফার্স্ট স্লিপ হয়ে অফ স্টাম্পের অস্ত্বিত্ব পরখ করে পপিং ক্রিজে ডান পা থেকে সামান্য দূরে। যত জোরে ব্যাট তোলা তত জোরে নামে না যেন। ব্যাল্যান্স রয়েছে সেই আগের মতোই। তাকালেন বোলারের দিকে।
রশিদ প্যাটেল, ছুটে আসছেন প্যাভিলিয়ন প্রান্ত থেকে, লম্বা, পেশিবহুল দৌড়। দৌড়ে এসে সামান্য লাফ, তারপর সামান্য শর্ট অব গুডলেন্থে বলটা রাখলেন পঞ্চম স্টাম্পে। বাঁ-হাতি পেসারের স্বাভাবিক অ্যাঙ্গেলে বলটা বেরিয়ে যাচ্ছিল, তিনি ব্যাট চালালেন। বহুব্যবহারে তলোয়ারে জং ধরেছে, তুলির রঙ শুকিয়েছে, রিফ্লেক্সও আগের মতো নেই, কিন্তু সৌন্দর্য্যে খামতি পড়েনি। তিনি ব্যাট চ্যালালেন বল লক্ষ্য করে আড়াআড়ি, সেই স্কোয়ারকাট। যা লিলিকে আছড়ে ফেলেছিল মেলবোর্ন বাউন্ডারিতে, রবার্টসকে চীপকে, হোল্ডিংকে বার্মিংহামে, ম্যাকেঞ্জিকে গ্রিনপার্কে।
সেই স্কোয়ারকাট, কিন্তু বয়স এবং ফিটনেসের অভাব রিফ্লেক্সেও থাবা বসিয়েছে। মুষ্টিমেয় হাজার খানেক দর্শককে নির্বাক করে দিয়ে বল ব্যাটের ভিতরের কানা লেগে মিডল স্টাম্পকে নড়িয়ে দিল। নড়িয়ে দিল আরেকটি ছেলেকেও, সদ্য টিনে পড়া ছেলেটি অনেক আশা নিয়ে তার প্রথম সুপারহিরোর খেলা দেখতে এসেছিল। কিন্তু সময় কারুর জন্য দাঁড়িয়ে থাকে না। সেদিন ভিশির জন্যও দাঁড়িয়ে থাকেনি।
ভিশি, গুণ্ডাপ্পা রঙ্গনাথ বিশ্বনাথ। হারিয়ে যাওয়া পৃথিবীর শেষ রঙিন বাদ্যকর।
আরও বেশ কিছু বছর পিছিয়ে যাই, ২০শে নভেম্বর, ১৯৬৯। কানপুর। তার তিনদিন আগেই ইয়ান রেডপাথের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফিরে এসেছেন অ্যালান কনোলির বলে কোনও রান না করেই। দ্বিতীয় ইনিংসে যখন নামলেন তরুণ ভিশি, তখন স্কোর ৯৪ রানে ২। তিন বলের মাথায়ই টেস্ট ক্রিকেটে তাঁর প্রথম রানটি করে ফেললেন, সেই কনোলির বলই মিডউইকেটে ঠেলে।
ধীরে ধীরে স্কোরবোর্ডে রান বাড়তে থাকল, এরই মধ্যে বেরিয়ে এসেছে তাঁর কবজি থেকে দৃষ্টিনন্দন ফ্লিক, অন ড্রাইভ এবং অবশ্যই স্কোয়ার ড্রাইভ। কিন্তু ১২৫ স্কোর হতে না হতেই অশোক মাঙ্কড় আউট এবং পতৌদির শূন্য ও অশোক গন্দোত্রার কম রানে আউট হতেই স্কোর ১৪৭এ ৫। সোলকার নামলেন আর তারপর স্বমহিমায় প্রথমবারের জন্য প্রকাশ পেলেন বিশ্বনাথ। গ্রিনপার্কের ঘাস চিরে তাঁর স্কোয়ার ড্রাইভ আর স্কোয়ার কাট ভবিতব্যের খড়গের মত নামা শুরু হল।
ঝুঁকে ব্যাট নিয়ে দাঁড়িয়ে, বল আসার আগে বিশেষ শাফল করা নেই, কিন্তু বল চোখের লাইনে পৌঁছলেই, দ্রুত ফুটওয়র্ক আর ঢেউয়ের আছড়ে পড়া। ব্যাট আসে গালি থেকে? বেশ কথা, বল কোথায় যায়? কেন, বাউন্ডারি! সেঞ্চুরি করেও থামলেন না ভিশি। সর্বমোট ২৫টা চার দিয়ে সাজানো ইনিংস ১৩৭এ পঞ্চম দিনে যখন থামল, তখন শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়ার ড্রয়ের জন্য খেলা ছাড়া গতি নেই আর।
অথবা একদিনের ক্রিকেট ধরলে, ১৯৭৯এর দ্বিতীয় প্রুডেনশিয়াল বিশ্বকাপ! প্রথম ম্যাচ। বার্মিংহামে উইকেটের তাজা ভাব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়, টসে জিতে লয়েড ফিল্ডিং নিলেন। নেবেনই বা না কেন! তাঁর হাতে রয়েছে বিশ্বত্রাস অ্যান্ডি রবার্টস, মাইকেল হোল্ডিং, জোয়েল গার্নার এবং কলিন ক্রফট। তিন উইকেট দ্রুত পড়ে গেলে ভিশি হাল ধরলেন। যেমন ভাবে তিনি বারবার ধরেছেন। আসলে সহজ উইকেটে সহজ বোলিং-এর বিরুদ্ধে রান করা যেন শিল্পের পরিপন্থী। অন্ততঃ জিআরভির ক্রিকেট দর্শন তাইই বলে। তাই ৭৫-এ মাদ্রাজ বা ৭৪-এর ম্যানচেস্টার।
৭৪-এর ম্যানচেস্টার লোকে মনে রেখেছে গাভাসকারের সেঞ্চুরি আর দ্বিতীয় ইনিংসের ৫৭র জন্য। ভেজা উইকেটে উইলিস, হেন্ড্রিক, ক্রিস ওল্ড আর ডেরেক আন্ডারউডকে সামলানো তো মুখের কথা নয়। গাভাসকার আউট হয়ে যাবার পরেও অষ্টম উইকেট পর্যন্ত ধরে ধরে স্বভাববিরুদ্ধ খেলে ম্যাচকে শেষ সেশনে নিয়ে যাওয়ার ইনিংসটা কেন জানি না বিস্মৃতির অতলে চলে গেছে। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বল দেখে খেলা এবং শটে কমিট না করা এভাবেই ৫০ হয়েছিল সেবার। কিন্তু ক্রিস ওল্ডের দ্বিতীয় নতুন বলটা গুডলেন্থ থেকে হঠাৎ লাফিয়ে যখন ব্যাটের কানা নিল, তখন অনেক চেষ্টা করেও সরাতে পারেননি ভিশি নিয়তিকে।
একইভাবে, বার্মিংহামেও। অবশ্য বার্মিংহামে ভিশির অসি বারবার ঝলসে উঠেছে। রবার্টসের বিষাক্ত আউটস্যুইং ঝলসে দিয়ে আশ্রয় পেয়েছে বল পয়েন্ট বা ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্ট বাউন্ডারিতে। আর হোল্ডিং-এর অফকাটার? মিডল স্টাম্প থেকে চকিত কব্জির হোকাসফোকাসে তা চলে গেছে স্কোয়ারলেগ বিলবোর্ডের নিশ্চিত নিবাসে।
আর ক্রফট বাউন্সার দিলেও পিছপা নন ভিশি, ছোট্ট চেহারা, আরও ঝুঁকে স্টান্স, সব পেরিয়ে শরীরটাকে একটু পিছিয়ে নিয়ে গিয়ে ডান পায়ের উপর পিভট করে ২৭০ ডিগ্রি ঘুরে যাওয়া। হোল্ডিং-এর মিডল স্টাম্পে পড়া আউটস্যুইংটা একটুর জন্য ব্যাটের বাইরের এজ মিস করে বোল্ড হবার আগে নামের পাশে ৭৫। ম্যাচ জেতা হয়নি হয় তো, কিন্তু ভিশির লোকগাথায় প্রবেশের পথে আরও একটি শক্ত সিলমোহর।
যেমনটি হয়েছিল ৭৫এ, প্রথম দিন চেন্নাইয়ে। লাল মাটির উইকেট প্রথম দুই দিন সে সময় বেশ বাউন্সি থাকত। আর বাতাসে আর্দ্রতা। জুলিয়েন বা হোল্ডার ছিলেন। কিন্তু অ্যান্ডি রবার্টস তো প্রস্ফুটিত কোবরা লিলি। শিকারকে নিয়ে আসেন খাদের কিনারায় আর তারপর কোথায় তলিয়ে যায় সে খোঁজ নেই কোনও। গাভাস্কারহীন ব্যাটিং লাইনআপকে শুইয়ে ফেলতে সাতটি ডেলিভারি লেগেছিল রবার্টসের। টেস্টটা ভারত জেতে। দ্বিতীয় দিন থেকে প্রসন্ন ও বেদীর স্পিন জালে হাঁসফাঁস করা ওয়েস্ট ইন্ডিজ বেরোতে পারেনি।
আর দ্বিতীয় ইনিংসে যখন উইকেট সহজ হয়ে গেছিল তখন অংশুমান গায়কোয়াড়ও রান পেয়েছিলেন। কিন্তু প্রথম ইনিংসে? আট উইকেট যখন পড়ে যায় তখন স্কোর মাত্র ১১৯। কিন্তু বিশ্বনাথ তখনও নির্বিকার। বেদীকে সঙ্গে নিয়ে এবং শেষ উইকেটে ব্যাট ধরতেই না পারা চন্দ্রশেখরের সঙ্গে জুড়ি বেঁধে উইকেটের চারপাশে ফুলঝুরি ছড়িয়ে রান নিয়ে গেলেন ১৯০এ। রবার্টসের বাউন্সারে চন্দ্রশেখরের প্রাণভোমরা ধরা পড়ল যখন লয়েডের হাতে, তখন তিনসংখ্যার মাইলফলক থেকে তিন রান দূরে ছিলেন ভিশি। কিন্তু তাতে কী ম্যাচ জেতা থেকে আটকাল কিছু?
বস্তুত: স্ট্যাটস ঘাঁটতে বসলে দেখা যাবে, ৯১টা টেস্টে মাত্র ১৪টা সেঞ্চুরি আর মাত্র ৪১ গড়। কিন্তু স্ট্যাটস তো এটা দেখাবে না, উইকেট খারাপ হলে পেস বা স্পিনের আখড়া হলে গাভাসকারের সঙ্গেই কোন ভারতীয়র নাম সর্বাগ্রে চলে আসবে সাতের দশকে? উইকেট না দেখালেও আপামর ভক্তকূল তো রইলই সাক্ষী হিসাবে।
তবে আমার বিশ্বনাথের ভক্ত হওয়া ১৯৮১র মেলবোর্ন টেস্টে। যে মেলবোর্ন টেস্ট কর্টিজেন নিয়ে কপিলের ৫ উইকেট, দিলীপ দোশির টানা ২২ ওভার আর অস্ট্রেলিয়ার ৮৩ রানে ধরাশায়ী হবার গল্প, তার ভিতই রচনা হত না যদি লিলি, প্যাস্কোকে পিটিয়ে জিআরভি শতরান না করতেন প্রথম ইনিংসে। সেখান থেকেই ঘুরে দাঁড়ানো এবং আমার পথ চলা। আমার প্রথম ক্রিকেট হিরো।
কিন্তু এই সঙ্গ বেশিদিনের হল না। মাঝে চেন্নাইয়ে ফ্লেচারের ইংল্যন্ডের বিরুদ্ধে ৩১টা চারের ২২২ থাকলেও ইংল্যন্ড সফর পেরিয়ে, জিআরভির নশ্বর রূপ ধরা পড়তে শুরু করেছিল। হয়তো নিয়মানুবর্তিতা, ফিটনেস এবং সিরিয়াসনেস, এই তিনটেরই কোথাও না কোথাও খামতি ছিল। হয়তো বা কেরিয়ারের সায়াহ্নে এসে সরফরাজ ইমরানদের নতুন অস্ত্র রিভার্স স্যুইং-এর জন্য প্রস্তুত ছিলেন না।
পাকিস্তান সফরে ভারত পর্যদুস্ত হল। একমাত্র মহিন্দার অমরনাথ মাথা তুলে দাঁড়ালেন। কিন্তু শিল্পীর ইস্পাত তুলিতেও যেন মরচে পড়তে শুরু করেছে। বার তিনেক স্রেফ স্যুইং বুঝতে না পেরে শিক্ষানবিশী আউট হলেন। ৩-০ সিরিজ হারল ভারত, অধিনায়কত্ব খোয়ালেন সুনীল গাভাসকার। আর এক ভদ্রলোক ক্রিকেটার, এক জাত শিল্পী, এক জাদুকর তাঁর জায়গা হারালেন ভারতীয় দলে। চিরতরে।
ভদ্রলোক বলতেই মনে পড়ে গেল জুবিলি টেস্টের কথা। সেই অধিনায়ক হিসাবে বব টেলরকে আউট হয়ে যাবার পরেও ভুল আউট দেওয়া হয়েছে বলে ফিরিয়ে নেওয়া। অথবা সেই গল্পটা, ইডেন টেস্টে টস করতে গিয়ে দেখলেন মাটিতে হেড না টেল সেটা দেখার আগেই আসিফ ইকবালের কয়েন তুলে নিয়ে ‘তুমি টস জিতেছ’ বলে দেওয়া। যেখান থেকে দুর্গন্ধ আসে ম্যাচ ফিক্সিং-এর।
কিন্তু সে সব ছবি ডিঙিয়ে আমার কাছে শেষ ছবিটা সেই ১৯৮৮সালের সাত মার্চের। অ্যাওয়ে টিমের ড্রেসিংরুমে বসে আছেন তিনি, শেষ ত্রিশ ক্রিকেটের জন্য বৃদ্ধ হয়েছেন তিনি। টেবিলের উপর বসে আছেন তিনি আর আমার মেরুন রঙের রেক্সিনে বাঁধানো অটোগ্রাফ খাতায় স্বাক্ষর দিচ্ছেন। তাঁর কিছুদিনের মধ্যেই লোকগাথার ইতি হবে রঞ্জি কোয়ার্টার ফাইনালে আরেক ভেটারেন পদ্মাকর শিভালকরের হাতে মাত্র সতেরো রানে। কিন্তু অটোগ্রাফটা তো থেকে যাবে।
আর থেকে যাবে সেই দু:সহ ছবিটা। শেষ জুনে, তিরাশির সেই দিনটি।
ভারতীয় দল তখন আপামর নাগরিকের স্বপ্নে ডানা লাগিয়ে উড়াল দিয়েছে বিশ্বকাপ ক্রিকেট জিতে। ফিরেছে সেই কণিষ্ক জাম্বো জেটে করে শহর আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টে। উৎসবের মুহূর্তে কিছু নিনকম্পুফ বিশ্বজয়ীকে দেখার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছে একজনের ট্রলির উপরের স্যুটকেসে। আর আপাদমস্তক ভদ্রলোক সেই ব্যক্তি নিজেই হয় তো সহযোদ্ধাদের আনন্দে আনন্দিত, কিন্তু ভিতরে ভিতরে কোথাও একটা জ্বালা রয়েছে, ক্ষয়ে যাওয়া রয়েছে সেই যুদ্ধে সামিল না হতে পারার। তিনি জিআরভি, আমাদের শৈশবের বাঁশিওয়ালা। খারাপ উইকেটে ভারতের সেরা বাজি আর এক হারিয়ে যাওয়া পৃথিবীর শেষ রঙিন বাদ্যকর।