তুমি আছ, তাই আছি

তিনটা বছর ব্রেন টিউমারের সাথে লড়লেন মোশাররফ হোসেন রুবেল। এই পুরো সময়টাতে আরেকটা মানুষ ছিলেন যিনিও যুদ্ধটা করেছেন। কখনো কখনো হয়তো মোশাররফ রুবেলের চেয়েও বেশি লড়তে হয়েছে। তাঁর যুদ্ধটা ছিল একাকী, নিসঙ্গ। মাঠের তারকা রুবেলের সাথে যে গত তিন বছরে ক্যান্সারের সাথে লড়া রুবেলের পার্থ্যক যে অনেক সেটা শুধু তাঁর স্ত্রী ফারহানা চৈতিই জেনেছেন।

একের পর এক কেমো নিতে থাকা মোশাররফ হোসেন রুবেলের শরীরটা আর পেরে উঠছিল না। পারছিলেন না ফারহানা চৈতিও। এত বড় একটা চিকিৎসা, এত খরচ সব একা হাতে সামলাতে হয়েছে এই নারীকে। হয়তো বিসিবি থেকে আর্থিক সাহায্য পেয়েছেন, কখনো কখনো ক্রিকেটাররাও পাশে এসে দাড়িয়েছেন। তবে এই পুরো সময়টা একাই মানসিক লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন। সঙ্গে ছিল তাঁর ছোট্ট একটা ছেলে।

মাঠের ক্রিকেটের বড় তারকা মোশাররফ হোসেন রুবেলের সাথে বিয়ে হয়েছিল তাঁর। ফলে ছোট হলেও কী ভীষণ সুখের একটা পরিবার হবার কথা ছিল তাঁর। তবে গত তিন বছরে ফারহানা চৈতি দেখেছেন জীবনের কঠিনতম অধ্যায়। তবে তিনি এক মুহূর্তের জন্যেও হার মেনে নেননি। লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন। এমনকি শেষ সময়ে রুবেলের এমন অসহায় জীবন যাপন মানুষের সামনে আসতে দেননি। তিনি তাঁর স্বামীকে একজন হিরো হিসেবেই বাঁচিয়ে রেখেছিলেন।

এই সময়টা ঘরে-বাইরে কত ঝড়ই না গিয়েছে তাঁর উপর। বিসিবির সাহায্যের পরের অনেক বেশি অর্থের প্রয়োজন ছিল এই চিকিৎসা শেষ করতে। সেজন্য নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। এমন দু:সময়ে নিজের চাকরিটা করে গিয়েছেন। ছোট ছেলেটাকে দেখে রেখেছেন। হাসপাতালে দৌড়েছেন।

রুবেলের শেষ দিনগুলোতে তাঁকে খুশি রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। হাসপাতালে রুবলে বই পড়ে শোনানোর দৃশ্যটা অনেকেই দেখেছেন। তবে এটা ছিল শুধু একটা মুহূর্তের ছবি। গত তিন বছরে ফারহানা চৈতি এভাবেই এক প্রান্ত থেকে মোশারফ রুবেলে শেষ দিনগুলো রাঙিয়ে তোলার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন।

একটা মানুষের জীবনে ভালবাসা কত বড় শক্তি হয়ে উঠতে পারে সেটাই যেন বারবার প্রমাণ করে গিয়েছেন তিনি। মোশাররফ রুবেলের শেষ দিনটা পর্যন্ত ফারহানা চৈতি লড়াই করে গেলেন একা। একজন নারী, একজন প্রেমিকা, একজন স্ত্রী বুঝি এরকমই হন। ফারহানা চৈতি জানতেন আর খুব বেশি সময় তাঁর স্বামীর হাতে নেই। তবুও চেষ্টায় এক বিন্দু ছাড় দেননি। একটা সময় চিকিৎসার খরচ চালানো কঠিন হয়ে যাচ্ছিল।

বিসিবি, সাকিব কিংবা মাশরাফিদের সাহায্যের পরেও পেরে উঠছিলেন না, তবুও হাল ছাড়েননি। অসুস্থ স্বামীর যত্ন নিয়েছেন, অফিস করেছেন, নিজের ছোট ছেলেটাকে দেখেছেন।  তারপর ব্যাংকের কাজ সামলেছেন, যেখানে যতটুকু অর্থ ছিল তা দিয়েই স্বামীকে বাঁচানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। এতকিছুর পরেও তাঁর স্বামী যে শুধুই মৃত্যুর দিন গুনছেন সেটা তিনি জানতেন। তবুও হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকা স্বামীকে বই পড়ে শুনিয়েছেন, গল্প করেছেন, শেষ দিনগুলোতেও ভালোবাসায় আগলে রেখেছেন।

খেলা ৭১ কে গত কয়েকমাসে একাধিক বার সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। শেষবার রুবেল ভাইয়ের অবস্থা একেবারেই খারাপ। ঠিক করে আমাদের চিনতেও পারছেন না। তখন এই নারীর প্রতিটা শব্দে ফুটে উঠছিল কী বিশাল একটা লড়াই করছেন নিজের ভিতরে। তিনি তখন জেনে গিয়েছেন আর খুব বেশি সময় নেই হাতে। তবুও ক্যামেরার সামনে এই কথাটা বলেননি। তিনি জানিয়েছিলেন তাঁর স্বামী আবার ফিরে আসবেন।

এই মিথ্যাটুকু ফারহানা চৈতি বলেছিলেন কারণ জীবন যুদ্ধে পরাজিত মোশাররফ রুবলকে তিনি মানুষের সামনে আনতে চাননি। তিনি চেয়েছেন তাঁর স্বামী যতদিন বেঁচে আছেন ততদিন জয়ী হয়েই বাঁচুক। মোশরফ হোসেন রুবেল আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। তবে ফারহান চৈতি, আপনি আপনার স্বামীকে হারতে দেননি। মোশারফ রুবেল চলে গিয়েও আপনার, আমাদের সবার ভালোবাসা জিতে নিয়ে গেলেন।

লেখক পরিচিতি

আমার ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠাই আমার বাইশ গজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link