মেসি জাদু, হট্টগোল, ডাচদের কামব্যাক, এমিলিয়ানো মার্টিনেজের চীনের প্রাচীর হয়ে দাঁড়ানো – কী ছিল না এই ম্যাচে! নান্দনিক ফুটবল থেকে শুরু করে ফিজিক্যাল ফুটবলের ভয়ংকর এক প্রদর্শন। ভয়ংকর কেন? কারণ এমন কিছু ম্যাচে মিনিটের পর মিনিট চোখ রাখা মানে চোখেমুখে অনবরত চিন্তার চাহনি আর স্নায়ুবিক আক্রমণে ভোগা। তবে অনুকূল, প্রতিকূল পরিস্থিতির মিশেলে দিনশেষে জয়টা এসেছে আর্জেন্টিনারই। মেসিকে কেন্দ্র করে তাদের জয়োৎসব সহসাই থামছে না। শেষ চার নিশ্চিত করে এখন শিরোপার দিকে চোখ থাকছে আলবিসেলেস্তাদের।
নব্বই মিনিটের ডাচ-আর্জেন্টাইন লড়াইয়ের সারমর্ম কী হতে পারে? ঠিক নব্বই নয়, ১০০ মিনিটই বলা যেতে পারে। আর সেই ১০০ মিনিটের প্রথম ৮০ মিনিট ছিল আর্জেন্টিনার, পরের ২০ মিনিট ছিল নেদারল্যান্ডসের। দুই গোলে পিছিয়ে থাকা ডাচরা ম্যাচে ফেরে ঐ ২০ মিনিটে।
খুব সহজেই সেমি চলে যাওয়ার পথযাত্রায় যখই আর্জেন্টিনার সমর্থকরা আশায় বুক বাঁধছিল ঠিক তখনই ডাচদের আক্রমণে ম্যাচের চিত্রটাই পাল্টে যায়। নির্ভার আর্জেন্টিনার আকাশে হঠাতই দেখা দেয় মেঘের ঘনঘটা। ম্যাচের ৮৩ মিনিটে ম্যাচের আবহ পাল্টে দেন বেগহোর্স্ট। বাঁ দিক থেকে স্টিভেন বের্গহোইসের করা দারুণ এক ক্রসে লাফিয়ে উঠে হেড করে গোল করেন এ ডাচ ফরোয়ার্ড।
ম্যাচের মোমেন্টাম ঘুরে যায় সেখানেই। আর একটি গোলের জন্য জানপ্রাণ দিয়ে আক্রমণ শুরু করে ডাচরা। কিন্তু কোনোভাবেই কাঙ্খিত আরেকটি গোল আসছিল না। তবে ম্যাচের চূড়ান্ত নাটকীয় মুহূর্ত অপেক্ষা করছিল একদম শেষ মিনিটে। ডি বক্সের বাইরে থেকে ফ্রি-কিক পায় নেদারল্যান্ডস।
২২ গজ দূর থেকে ফ্রি কিক। সবারই প্রত্যাশিত ছিল, ফ্রি-কিকের শটটি উড়িয়ে আসবে। কিন্তু ডাচদের এক কৌশলেই ফাঁদে পড়ে যায় আর্জেন্টাইন ডিফেন্ডাররা। ফ্রি-কিক নেওয়া টন কপমাইনার্স সেটি উড়িয়ে শট না মেরে পাস দিলেন বেগহোর্স্টকে। আর সেই বল পেয়েই আর্জেন্টিনার জালে আবারো বল জড়ান বেগহোর্স্ট। এর মধ্য দিয়েই ম্যাচের চূড়ান্ত নাটকীয়তা শেষ হয় ২-২ গোলে।
এরপর সেই অতিরিক্ত ৩০ মিনিটের খেলা। কিন্তু সেখানেও কোনো গোলের দেখা নেই। তাই ম্যাচ গড়াল টাইব্রেকারে। আগের ম্যাচেই লাতিন আমেরিকার আরেক জায়ান্ট ব্রাজিল এই টাইব্রেকারে হেরেই বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিয়েছে। সেই দু:স্বপ্ন কি তবে আর্জেন্টিনার জন্যও অপেক্ষা করছে? না। আর্জেন্টিনার এমন দুর্যোগের দিনে দেয়াল হয়ে দাঁড়ালেন গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্টিনেজ। ডাচদের প্রথম দুই শটই ঠেকিয়ে আর্জেন্টিনাকে জয়ের দ্বারে নিয়ে যান তিনি।
যদিও এনজো ফার্নান্দেজ পেনাল্টি মিস করে কিছুটা আশঙ্কা বাড়িয়েছিলেন। তবে সেটা জয়ের উৎসব তৈরির জন্য শুধু সময়ই বিলম্ব করেছে মাত্র। এক মার্টিনেজ যখন আর্জেন্টিনার গোলবার সামলেছেন চীনের প্রাচীর হয়ে, আরেক মার্টিনেজ(লাউতারো) শেষ পেনাল্টি শ্যুটটি ডাচদের জালে জড়িয়ে আর্জেন্টিনাকে ম্যাচজয়ের ক্ষণ এনে দেন।
ম্যাচ গিয়েছে পেনাল্টি শ্যুটআউটে। সেখানে এমি মার্টিনেজের বীরত্বে জিতেছে আর্জেন্টিনা। তবে আর্জেন্টিনার হয়ে আরেকজন প্রথম থেকেই তাঁর জাদু দিয়ে হৃদয় কেড়ে নিয়েছিলেন। তিনি লিওনেল মেসি। আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ম্যাচের আগে ডাচ কোচ লুই ফন গাল বলেছিলেন, মেসিকে আপাতত বিশেষ কিছু মনে করছেন না তিনি। প্রতিপক্ষের কোচের এমন মন্তব্য হয়তো তাঁতিয়ে দিয়েছিল স্বয়ং মেসিকে।
মেসিও তাই একটা ম্যাজিক দেখানো শুরু করলেন ম্যাচের শুরু থেকেই। আর্জেন্টিনার প্রথম গোলে হয়তো নাম লেখা থাকবে মলিনার নাম। কিন্তু এই গোলের নেপথ্যে মেসি যা করেছেন তা রীতিমত অবিশ্বাস্য। ডাচ ডিফেন্ডারদের ফাঁকি দিয়ে যে পাসটি তিনি মলিনাকে দিয়েছিলেন তা দেখে ধারাভাষ্যকাররাই বলে উঠেছিলেন, এখান থেকে এমন ম্যাজিকাল টাচ সাধারণ খেলোয়াড়ের পক্ষে স্রেফ অসম্ভব।
গোলে সহায়তা করার দিনে মেসি নিজেও গোল পেয়েছেন। পেনাল্টি থেকে গোল করে ছুঁয়েছেন গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতার রেকর্ড। বাতিস্তুতার মতো মেসিরও এখন বিশ্বকাপের গোলসংখ্যা ১০। যা আর্জেন্টাইন ফুটবলার হিসেবে সর্বোচ্চ।
এক গোল আর এক এসিস্টেই কি তবে মেসি দ্যুতি শেষ হয়েছিল? মোটেই নয়। ম্যাচের সর্বোচ্চ তিনটি সুযোগ তৈরি করেছেন তিনি। আর এখানেই তিনি অনন্য এক রেকর্ড গড়েছেন। ১৯৬৬ বিশ্বকাপ থেকে পরিসংখ্যান নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান অপ্টা বলছে, বিশ্বকাপ ইতিহাসে সর্বোচ্চ চান্স ক্রিয়েট করা ফুটবলারটি এখন মেসি(৭০ টি)। এর আগে এ রেকর্ডটি ছিল ডিয়েগো ম্যারাডোনার(৬৭ টি)।
ব্যক্তি অর্জনের মেসিকে নিয়ে আপাতত বলার মতো বিশেষণ নেই। মেসি বরাবরই ব্যক্তিগত অর্জনে সমৃদ্ধ ছিলেন। ছিল না শুধু আর্জেন্টিনার ঐ আকাশি নীল জার্সিতে কোনো দলগত সাফল্য। গত বছরে কোপা জিতে সেই ফারা কাটিয়েছেন তিনি। এবার তিনি ছুটছেন বিশ্বকাপের দিকে।
আগের ৪ বিশ্বকাপে ৪ বারই ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছেন। এবার এখন পর্যন্ত ফেরার বিষাদময় গল্প লেখা হয়নি। লেখা হচ্ছে এগিয়ে যাওয়ার রোমাঞ্চকর অধ্যায়ের কথা। এই লেখার স্রোত আর কিছুদূর গড়ালেই ব্যক্তি অর্জনে মহীয়ান মেসি পূর্ণতার অধ্যায়ে ঢুকে যাবেন। সেই পূর্ণতার অপেক্ষা অনেকগুলো দিন, মাস পেরিয়ে বছরের।
আলবিসেলেস্তেরা তাই এবার সেই অপেক্ষার অবসান ঘটনার দিকে একদম মুখিয়ে আছে। তবে এখনও আরো কিছুটা পথ বাকি। আরো কিছুটা পথ দৌড়ে পাড়ি দিতে হবে। অপেক্ষাটা তাই আরো কিছু দিনের, আরো কিছুটা রোমাঞ্চকর মুহূর্তের।